মাহে রমজান, দ্রব্যমূল্য ও দূর্নীতিমুক্ত সমাজ
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ পবিত্র রমজান মাস মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ন। ধনী গরীব নির্বিশেষে প্রতি বছর বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে এ মাসটি মুসলমানদের নিকট হাজির হয়। রমজান আত্মশুদ্ধি ও সংযমের মাস। এ মাসে মুসলমানগন আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করে। এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে পরবর্তী ১১ মাস যাতে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি সহকারে চলতে পারে সে চেষ্টাই করে থাকে। কিন্তু এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী এই রমজান মাসকে কেন্দ্র করে অতি মুনাফা লাভের আশায় দ্রব্যমূল্যের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করে। তাছাড়া দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বিষয়ে আমাদের দেশের মানুষের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যেভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ে ঠিক সেভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না। সীমিত আয়ের মানুষের কোনরকম খেয়েপরে বেঁচে থাকাটাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। রমজানকে সামনে রেখে প্রতি বছর পণ্যের দাম বাড়ে। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। রমজান মাস শুরু হওয়ার পূর্বেই পণ্যের দাম বেড়ে চলছে। রমজান শুরু হওয়ার আগে থেকেই নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতা সত্যিই দুঃখজনক। এবার যেন ভোক্তাগণ ন্যায্যমূল্যে খাদ্যপণ্য ক্রয় করতে পারেন সেদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমূহের দৃষ্টি রাখা খুবই প্রয়োজন। অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট যাতে না করতে পারে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সরকারী উদ্যোগে। বিশেষ করে এই মাসে যেসব পণ্যের চাহিদা খুব বেশী থাকে সেগুলোর দামই সাধারনত রমজানকে সামনে রেখে বেড়ে থাকে।
রমজান সিয়াম সাধনার মাস। অভাবী মানুষেরও প্রত্যাশা থাকে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকবে যাতে তারা নির্বিঘেœ রমজান পালন করতে পারেন। বিশ্বের অনেক দেশেই রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা হয়। কিছু কিছু দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়েও দেয়া হয় যেমন সৌদি আরব, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে পণ্যের দাম কমিয়ে রোজাদারদের নির্বিঘেœ প্রশান্তি সহকারে সিয়াম সাধনার সুযোগ করে দেয়া হয়।
ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে মুনাফা করবেন তা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু রমজান মাসে ভোক্তাদের বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে অতিমুনাফা করবেন তা গ্রহনযোগ্য হতে পারেনা। আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। প্রতি বছর, প্রতিমাস এবং প্রতিদিনেও জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি হয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থার উপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রন ও নজরদারী আরও জোরদার করতে হবে। দেশ প্রেম ও মানবিকতা এবং তাকওয়া সহকারে ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনা করলে কোন মানুষ অতি মুনাফা করার জন্য সচেষ্ট হবেনা। রোজা সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষনা করেন “হে ঈমানদারনগ! পূর্ববর্তী উম্মতের ন্যায় তোমাদের উপরও রোজা ফরজ করা হয়েছে যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (রোজা ফরজ করা হয়েছে) কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনের জন্য, (তারপরও) কেউ যদি সে (দিনগুলোতে) অসুস্থ হয়ে যায় কিংবা কেউ যদি (তখন) সফরে থাকে, সে ব্যক্তি সমপরিমান দিনের রোজা (সুস্থ হয়ে অথবা সফর থেকে ফিরে এসে) আদায় করে নেবে, (এরপরও) যাদের ওপর (রোজা) একান্ত কষ্টকর হবে, তাদের জন্য এর বিনিময়ে ফেদিয়া থাকবে (এবং তা) হচ্ছে একজন গরীব মানুষকে (তৃপ্তিভরে) খাবার দেয়া, অবশ্য যদি কোনো ব্যক্তি (এর চাইতে বেশী দিয়ে) ভালো কাজ করতে চায় তাহলে এ (অতিরিক্ত) কাজ তার জন্য হবে একান্ত কল্যাণকর, তবে (এ সময়) তোমরা যদি রোজা রাখতে পারো তাই তোমাদের জন্য ভালো, তোমরা যদি রোজার উপকারিতা সম্পর্কে জানতে (যে, এতে কি পরিমান কল্যান রয়েছে।) রোজার মাস (এমন একটি মাস)- যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে আর এই কোরআন (হচ্ছে) মানব জাতির জন্যে পথের দিশা, সৎপথের সুষ্পষ্ট নিদর্শন, (মানুষের জন্য হক বাতিলের) পার্থক্যকারী। অতএব, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসটি পাবে, সে এতে রোজা রাখবে, (তবে) সে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা সফরে থাকে, সে পরবর্তী (কোনো সময়ে) গুনে গুনে সেই পরিমান দিন পূরন করে নেবে (এ সুযোগ দিয়ে) আল্লাহ তায়ালা তোমাদের (কোরআনের মাধ্যমে জীবন যাপনের যে পদ্ধতি শিখিয়েছেন তার জন্যে তোমরা তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করো”। (সুরা বাকারা, আয়াত- ১৮৩-১৮৫)
রোজার মাধ্যমে সংযম সাধনায় প্রকৃত লক্ষ্যই হলো তাকওয়া অর্জন। আর তাকওয়া অর্জন করলেই সমাজ থেকে সকল প্রকার অন্যায় অন্যাচার দূর হবে। সমাজ হবে অপরাধমুক্ত ও দূর্নীতিমুক্ত। আদর্শ সমাজ গঠনের প্রধান শর্ত হচ্ছে মানুষের আত্মশুদ্ধি। মানুষের অন্তরাত্মা যখন কদর্যমুক্ত হবে তখনই দূর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কোন মানুষের মধ্যে যদি খোদাভীতি ঢুকে পড়ে তখন সে মানুষ অপরাধ করতে পারেনা। রোজা মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে কারন রমজানের রোজাগুলো মানুষ একমাত্র আল্লাহর ভয়েই রাখে। যে কেউ ইচ্ছে করলেই লোক চক্ষুর অন্তরালে পানাহার করতে পারে এবং অন্য মানুষের সামনে নিজেকে রোজাদার বলে প্রকাশ করতে পারে কিন্তু প্রকৃত রোজাদার তা করে না। তার একমাত্র কারন এ রোজাদারগন আল্লাহর ভয়েই রোজা রাখেন। রোজার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে আল্লাহর প্রতি ভয় এবং তাকওয়া অর্জিত হয় তা যদি সারা বছর বিদ্যমান থাকে তাহলে এ মানুষের দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হওয়া অসম্ভব। রোজা মানুষকে মিথ্যা বর্জন করে ও সত্য বলতে অভ্যস্ত করে। কারন রোজা রেখে মিথ্যা কথা বললে রোজার মাধ্যমে কোন প্রকার ফায়দা পাওয়া যায়না। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সঃ) এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং সে অনুসারে কাজ করা বর্জন করল না তার পানাহার বর্জনের আল্লাহর কোন প্রয়োজন নাই। অনেক অপরাধের মূলেই দেখা যায় অবাধ যৌনাচার। রোজা অবৈধ যৌনাচার দমনেরও প্রশিক্ষন। রসুল (সঃ) বলেছেন- হে যুব সমাজ তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করতে সক্ষম তারা যেন বিয়ে করে। আর যারা বিয়ে করতে অক্ষম তারা যেন রোজা রাখে। কারন রোজা তার যৌনক্ষুধা দমন করবে। অনেক সময় ধর্মহীনতা থেকেও বহু অন্যায় অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। সত্যিকার অর্থে রোজা ধর্মেরও প্রশিক্ষণ।
রমজান মাসে আল্লাহভীতির গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে মানুষের পাপাচারের প্রতি আকর্ষণ হ্রাস পায়। ইমাম গাজ্জালী(রঃ) বলেছেন জীবসত্তা যা দ্বারা প্রবল হয়, সেসব রিপুকে অবদমন করে রূহের শক্তিকে বৃদ্ধি করা হচ্ছে রোযার সাধনা। রমজান ত্যাগ ও সংযমের মাস, সমবেদনা ও সংযমের মাস। রহমত, মাগফেরাত ও জাহান্নাম থেকে নাজাবের মাস। মহানবী(সঃ) বলেছেন প্রতিটি জিনিসের যাকাত রয়েছে। শরীরের যাকাত হলো রোজা। রমজান হলো কোরআন নাজিলের মাস। শুধু কোরআন নাজিলই নয়, রমজান মাসের প্রথম তারিখে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর উপর সহীফা অবতীর্ণ হয়। ছয় তারিখে মুসা(আঃ) এর উপর, তাওরাত ১২ তারিখে দাউদ (আঃ) এর উপর জবুর কিতাব ও ১৩ তারিখে ঈসা (আঃ) এর উপর ইনজিল কিতাব অবতীর্ণ হয়।
হাদিছ শরীফে আছে পবিত্র রমজান মাস হচ্ছে ধর্মের মাস। পবিত্র রমজানের দীর্ঘ এ মাসে তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে দূর্নীতিমুক্ত ও আদর্শ সমাজ গঠন সম্ভব। রোজাকে সামনে রেখে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে সরকারকে অবিলম্বে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টি.সি.বি.-কে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ক্রেতা-ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষনের জন্য আইন রয়েছে। বিদ্যমান আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তরের অনেক পরিদর্শক দল রয়েছে। এসব তদারকি দল বাজার পরিদর্শন করলে ভোক্তারা উপকৃত হবেন। জেলা প্রশাসনকেও রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করলে অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনতে হবে। অর্থনীতির একটি সূত্র হলো চাহিদার তুলনায় উৎপাদন যত কম পণ্যের দাম বাজারে তত বেশী হবে। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কাজটি কঠিন হলেও ভোক্তাদের স্বার্থে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। টি.সি.বি.’র কার্যক্রম ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে। দেশের স্বল্প আয়ের মানুষ যাতে ন্যায্য মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারে সেজন্য রেশন কার্ড সরবরাহ করে রেশনিং প্রথা চালু করা যেতে পারে। আমাদের দেশে ঈদ আর রোজা মানেই পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়া। বাজারে মনিটরিং এ সরকারের আরও কঠোর হতে হবে। রমজান মাসে ইফতারি ও সেহরীতে ব্যবহৃত খাদ্যপণ্যকে ভেজালমুক্ত রাখতে সরকারের তদারকি কার্যক্রম বাড়াতে হবে।
সত্যিকার অর্থে দেশে বিদ্যমান সকল আইনি ব্যবস্থা সরকারকেই কার্যকর করতে হবে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে যে সমস্ত মুসলমান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চান ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে তারা যেন তাদের অধিকারের পূর্ন প্রয়োগ সহ নায্য মূল্যে ও ভেজালমুক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে পারেন সদাশয় সরকার সে ব্যাপারে আরও বেশী আন্তরিক হবেন সে আশা রাখছি।
লেখক- মোহাম্মদ আবু তাহের এডভোকেট, ব্যাংকার ও কলামিস্ট
এবং সভাপতি কনজুমারস্ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) মৌলভীবাজার জেলা শাখা, মৌলভীবাজার।
মন্তব্য করুন