মায়ের মতো আপন এ জগতে আর কেউ নেই
এহসান বিন মুজাহির॥ আজ বিশ্ব মা দিবস। মে মাসের দ্বিতীয় রোববার সারা বিশ্বেই ‘বিশ্ব মা দিবস’ পালিত হয়। অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব মা দিবস। মাকে যথাযথ সম্মান ও ভালোবাসাদেয়াই দিবসটির মূল উদ্দেশ্য। যদিও মায়েদের ভালোবাসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন বা বিশেষ সময়ের প্রয়োজন হয় না। বিশ্বজুড়ে এই মা দিবসটি আসে মূলত আমেরিকানদের হাত ধরে। উইকিপিডিয়া তুলে ধরেছে দুটি ইতিহাস। একটি ইতিহাসে বলা হয় ‘মা দিবসের’ প্রচলন শুরু হয় প্রাচীন গ্রিসে। অপর ইতিহাস হলো সর্ব প্রথম ১৯১১ সালের মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার আমেরিকাজুড়ে ‘মাদারিং সানডে’ নামে একটি বিশেষ দিন উদযাপন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আনা জার্ভিস ও তার মেয়ে আনা মারিয়া রিভস জার্ভিসের উদ্যোগে প্রথম মা দিবস পালিত হয়। আনা জার্ভিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর ও ওহাইওর মাঝামাঝি ওয়েবস্টার জংশন এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তার মা অ্যান মেরি রিভস জার্ভিস সারা জীবন অনাথদের সেবায় জীবন ব্যয় করেছেন। ১৯০৫ সালে মারা যান মেরি। অনাথদের জন্য মেরির এই নিঃস্বার্থ উৎসর্গিত জীবনের কথা অজানাই থেকে যায়। লোকচক্ষুর অগোচরে কাজ করা মেরিকে সম্মান দিতে চাইলেন মেয়ে আনা জার্ভিস। তাই নতুন এক উদ্যোগ নেন তিনি। অ্যান মেরি রিভস জার্ভিসের মতো দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব মাকে স্বীকৃতি দিতে আনা জার্ভিস প্রচার শুরু করেন। তার সাত বছরেরচেষ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় মা দিবস। ১৯১১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্িিরতটি রাজ্যে মা দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এভাবেই শুরু হয় মা দিবসের যাত্রা।
এরপর পৃথিবীর দেশে দেশে মা দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমেরিকার পাশাপাশি মা দিবস এখন বাংলাদেশসহ অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, রাশিয়া ও জার্মানসহ শতাধিক দেশে মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ সারাবিশ্বের প্রায় ৬০টির মতোে দশে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার একসঙ্গে মা দিবস পালিত হয়ে আসছে বহু যুগ ধরেই। মা জাতি সম্মানি জাতি। মায়ের তুলনা একমাত্র মা। মাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানোর নির্দিষ্ট কোনো দিন নেই। মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রতি মুহূর্তের। সারাবছর মায়ের হক আদায়ে বেখবর আর ‘মা দিবস’ এলেই মায়ের প্রতি আবেগের ভালবাসা ঢেলে দেওয়া হয়!
মা সন্তানের জন্য পৃথিবীতে একটি বেহেশতের ফোটা ফুল। যার কাছে রয়েছে অসীম স্নেহ-মায়া-মমতা, আদর-ভালোবাসা আর শান্তনা। মায়ের মতো আপন এ জগতে আর কেউ নেই। মায়ের তুলনা একমাত্র মা। একজন সন্তানের কাছে মা শব্দটির কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথে মায়ের মায়া-মমতার তুলনা হয় না। মায়ের আদর এবং লালন-পালনের কষ্ট সন্তান কোনো দিন শোধ করতে পারবে না। শীত, তাপ, ক্ষুধা ও তৃষ্ণার জ্বালা যিনি সন্তানকে শৈশবে অনুধাবন করতে দেননি তিনি হলেন মা। সন্তানের অসুখে যিনি সারারাত জেগে থাকেন, সন্তান বাড়ি থেকে বের হয়ে ফেরার আগ পর্যন্ত যার চোখে ঘুম আসে না, সন্তানের বিপদ-মছিবতে সকল সুখ-শান্তি যিনি বিসর্জন করে সর্বোচ্চ ত্যাগ দিয়ে সন্তানের বিপদ মুসিবত অসুখসহ যাবতীয় সমস্যা মোকাবেলা করে থাকেন তিনি হলেন মা। সন্তানের উপর ফরজ কর্তব্য হলো সর্বদা মাকে যথাযথ সম্মান ও সেবা করা। সার্বিক বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখা।
মাকে যথাযথ সম্মান ও ভালোবাসার কথা স্বয়ং কুরআনুল কারীমে আল্লাহপাক নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা কেবলমাত্র তারই ইবাদত করবে এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্বব্যবহার করবে। যদি তাদের মধ্যে একজন কিংবা দুজনই তোমার নিকটে বৃদ্ধ বয়সে উপনিত হয়ে যান তখন তাদেরকে ‘উফ’ শব্দও বলবে না এবং তাদেরকে ধমকও দিবে না। আর তাদের জন্য দয়ার মধ্য থেকে নম্রতার বাহু ঝুঁকিয়ে দাও। আর তাদের জন্য দোয়াস্বরপ একথা বলবে, রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানী ছগীরা’। (হে আমার পালনকর্তা! তাদের দু’জনের ওপর এরকম দয়া কর যেরকম তারা আমাকে ছোট বেলায় লালন-পালন করেছিলেন)। (সুরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪)।
অন্যত্র আল্লাহপাক বলেন, ‘আমি মানুষকে বিশেষ তাগিদ দিয়েছি তার পিতামাতার সাথে সদয় ব্যবহার করার। তার মা তাকে (গর্ভে) রেখেছেন এবং তাকে দুধপান ছাড়ানোর সময় দিয়েছেন ত্রিশ মাস। পরিশেষে যখন সে পূর্ণশক্তিতে পৌঁছে যায় এবং চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হয় তখন সে যেনো বলে, হে আমার পালনকর্তা আপনি আমাকে শক্তি দান করুন যাতে আমি আপনার সেই সম্পদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি যা আপনি আমাকে এবং আমার মাতাপিতাকে পুরষ্কার দিয়েছেন। আর আমি যেন এমন ভালো কাজ করতে পারি যা আপনি পছন্দ করেন। আর আমার সন্তান-সন্তুতিদের মধ্যেও আপনি ওই যোগ্যতা দান করুন। আমি আপনার কাছেই ফিরে এসেছি এবং আমি আপনার কাছে আত্মসমর্পণকারিদের মধ্যেও রয়েছি। (সূরা আহকাফ : ১৫)।
কোরআনে আল্লাহ বলেন-আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করো। (সূরা নিসা : ৩৬)। কোরআনের অন্যত্র ঘোষণা করেন, ‘আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেন এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার (আল্লাহর) প্রতি এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে। (সুরা লুকমান : ১৪)।
হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা এক সাহাবি রাসূল (সা.) এর খেদমতে হাজির হয়ে প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি সর্বাগ্রে কার সঙ্গে সদাচরণ করবো? রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তয়ে বললেন, তোমার মা। সাহাবি আবার বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবি আবার জিজ্ঞেস করল তারপর কে? উত্তরে তিনি বললেন, তোমার মা। (বোখারি : ৫৯৭১)। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, মাতা-পিতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর সন্তুষ্টি। মাতা-পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (তিরমিজি : ২/১২)।
বোখারি শরিফের হাদিসে বর্ণিত, একদা জনৈক সাহাবি (নবীজি স.)-এর কাছে জিহাদে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা প্রকাশ করলেন। রাসুল (স.) প্রশ্ন করলেন, তোমার মা-বাবা কেউ কী জীবিত আছেন? সাহাবি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন বাড়িতে গিয়ে তাঁদের সেবা করো। (বোখারি ২৮৪২)। একদা মহানবী (সা.) বললেন ‘সে দুর্ভাগা! সে দুর্ভাগা! সে দুর্ভাগা! উপস্থিত সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, সে কে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি মাতা-পিতা উভয়কে অথবা যে কোনো একজনকে বৃদ্ধ পেয়েও (তাদের সেবা করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না। (মুসলিম : ৬৬৭৫)
মাতা-পিতা মারা যাওয়ার পরও সন্তানের ওপর তাদের হক রয়ে যায়। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, এক সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রসুল! মা-বাবার মৃত্যুর পর তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার এমন কোন উপায় আছে কি, যা আমি অনুসরণ করতে পারি? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, হ্যাঁ! চারটে উপায় আছে। তা হলো : ১. তাদের জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। ২. তাদের কৃত ওয়াদা পূরণ করা। ৩. তাদের বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সম্মান করা। এবং ৪. তাদের মাধ্যমে তোমাদের সঙ্গে যে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা অক্ষুন্ন রাখা। (আবু দাউদ : ৫১৪২)।
মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, মায়া, মমতা, ভালোবাসা ও দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন একটি বিশেষ দিনের জন্য নয়; বরং তা প্রতিদিনের জন্য। মায়ের প্রতি আনুগত্য, মায়ের খেদমত, মায়ের হক আদায় ও বৃদ্ধাবস্থায় সেবা-যত্ন করা এবং পরকালীন মুক্তির জন্য দোয়া ও মাগফিরাত কামনা করা আমাদের সবার একান্ত কর্তব্য। যাদের মা জীবিত নেই তাদের জন্য মাগফিরাত কামনায় বেশি বেশি তেলাওয়াত কোরআন, নফল নামাজ, দান সদকা ও দোয়া দুরুদ পাঠ করা সন্তানের কর্তব্য।
মাতাপিতাকে রুহের মাগাফরাত কামনায় নফল নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, দান সদকা করা অতি উত্তম কাজ। মা আমাদের জন্য আল্লাহর এক বিরাট নেয়ামত। আমাদের প্রধান কর্তব্য হলো জীবিত মায়ের খেদমত এবং কবরবাসী মায়ের জন্য রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি ছগীরার মাধ্যমে সর্বদা দোয়া করা।
লেখক : সংবাদিক, কলামিস্ট ও প্রধান শিক্ষক, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার।
মন্তব্য করুন