মুক্তিযুদ্ধার পাঁচশত টাকা ও আমার ঋণ: জীবদদশায় মুক্তিযুদ্ধার স্বীকৃতিটুকু পাবেন তো মৌলভীবাজারের আব্দুর রহিম

March 14, 2017,

বিকুল চক্রবতী॥ শ্রীমঙ্গলে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির পাওয়ার দাবীদার এক যুদ্ধার ৫শত টাকা আমার ঋণ না পুরস্কার তা জানিনা, তবে তার দেশ প্রেম ও ত্যাগের কাছে এ প্রজন্মের একজন হিসেবে ঋণবোধ আছে বলে আমি মনে করি। প্রশ্ন হলো রিপোর্ট করার জন্য তার দেয়া পাঁচশত টাকা আমার কাছে বড় না তিনিসহ শত শত মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগে পাওয়া আমাদের গর্বের স্বাধীন বাংলাদেশ। এ গল্পে, পরে আসছি প্রথমে আসি তাঁর কথায়। যার আক্ষেপ করা আহবান বাংলাদেশ তুমি কি আমার প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু দেবে।
মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধার দাবিদার এক যোদ্ধা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য। একাত্তরের যুদ্ধে জয় লাভ করলেও এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয় পাবেন তো। গল্পটি শ্রীমঙ্গল আশিদ্রোন ইউনিয়নের চির কুমার আব্দুর রহিমের।
শ্রীমঙ্গলের আশীদ্রোণ ইউনিয়নের টিকরিয়া গ্রামের মোঃ আবদুর রহিম স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এত বছরেও মুক্তিযোদ্ধার খাতায় তাঁর নাম আসেনি, বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করে ক্লান্ত হয়ে সর্বশেষ চেষ্টার অংশ হিসেবে ৭ মার্চ এসেছিলেন শ্রীমঙ্গলের প্রগতিশীল সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের সাংবাদিক অঙ্গন নিউজ কর্ণারে।
এই প্রতিবেদকের সাথে তাঁর আলাপকালে কখনো চোখেমুখে ফুটে উঠে আলোর ঝলকানি আবার কখনোবা কথায় বেরিয়ে আসে আক্ষেপ, ক্ষোভ, চাপা অভিমান।
তিনি উচ্চকিত কন্ঠে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলতে লাগলেন, বিগত কয়েক বছর আগে ‘সংবাদ’ পত্রিকায় শ্রীমঙ্গলের মুক্তিযুদ্ধা হিসেবে তাঁর নাম উল্লেখ করে খবর প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ পুর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে দেশমাতৃকার প্রতি তাঁর ও তাঁর দেখা তখনকার সময় সমগ্র সিলেট বিভাগের ত্যাগী রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের অবদানের কথা। তিনি বলেন, ৪৬ বছর পর যখন কেউ কেউ প্রকৃত-অপ্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার প্রশ্ন তুলে, বিতর্ক সৃষ্টি করেন তখন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট বেড়ে যায়। সম্মানসূচক স্বীকৃতির জন্য এরকম ভাবে দ্বারে দ্বারে ঘোরে বাঁচার চেয়ে যুদ্ধে প্রাণ যাওয়াটাই কি সম্মানের ছিল না? দেশকে রক্ষা করতে ’৭১ এ যুদ্ধে গিয়েছিলেন। আজও তিনি যুদ্ধ করে চলেছেন। তবে তা টিকে থাকার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে ৪৫ বছর আগে। তখন বিজয়ীর বেশে ঘরে ফিরেছিলেন আজকের সত্তর ছুঁই ছুঁই বীর। মহান মুক্তিযুদ্ধপূর্ব এবং যুদ্ধকালীন সেদিনের নানা স্মৃতিকথা আর আজকের দিনের আক্ষেপ তিনি প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, কিশোর বয়সে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীনিতিতে প্রবেশ করেন সুনির্মল কুমার দেবমিন্দা, শওকুতুল ওয়াহেদ, সুবোধ দাশ (ভারতের ত্রিপুরার প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা) মাধ্যমে। তখন শ্রীমঙ্গলে আওয়ামীলীগ এর কোন কার্যক্রম ছিলনা বললে ভুল হবে না। এ সময় আইয়ুব খান, ‘হিন্দুদের জমি ক্রয়/বিক্রয়’ বন্ধ করে দিল। তিনি সহ রাসেন্দ্র দত্ত, সৈয়দ মতিউর রহমান, শাহজাহান ভাই, সৈয়দ শওকুতুল ওয়াহেদ এ প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। এর ফলে রাসেন্দ্র দত্ত ও তার উপর হুলিয়া জারি করে তৎকালীন পাক সরকার। তখন তাদেরকে এদের হাত থেকে রক্ষা পেতে বাধ্য হয়ে আত্মগোপন করতে হয়। তিনি বলেন, “ আত্মগোপন থেকে ফিরে ১৯৬৬ সালে আবারো বাঙ্গালী জাতির মুক্তির সনদ শেখ মুজিবের ছয়দফা’র পক্ষে মিছিল-স্লোগানে আত্মমগ্ন থাকতাম। ১৯৬৭ সালে ’কোহিনুর ক্যামিকেল কোম্পানী’তে বারশত টাকা বেতনে চাকুরির সুবাদে প্রায় এক বছর রাজনীতির ময়দানে অনুপস্থিত ছিলাম তবে যোগাযোগ ছিল। এক বছর চাকুরীর পর পীর হাবিবুর রহমান এবং আব্দুস সামাদ আজাদ স্বশরীরে মৌলভীবাজার পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান রসিদ সাহেবের বাড়িতে গিয়ে আমাকে দেশের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করেন এবং আমি চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১৯৬৮ সালে যখন শেখ সাহেব কারান্তরিন, তখন শেখ সাহেবের নিঃশর্ত মুক্তির জন্য সিলেট আওয়ামীলীগের নেতা মো: সিরাজ, হবিগঞ্জের দেওয়ান ফরিদ গাজী, ছাত্র ইউনিয়নের বেদানন্দ ভট্টাচার্য্য এবং সদ্য প্রয়াত আওয়ামীলীগ নেতা, বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত প্রিয় (যদিও দাদা তখন আওয়ামীলীগে যোগ দেননি) সুরঞ্জিত সেন, কুলাউরার আব্দুল মালেক প্রমুখকের সাথে গন আন্দোলন গড়ে তুলতে কাজ করি। কিছুদিন পর তখনকার সময় পুর্ব পাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়নের ১ম সাধারণ সম্পাদক আমার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু মরহুম ইলিয়াস সাহেব (পরবর্তীতে ১৯৭০,১৯৭৩, সালের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন), আসাম গণপরিষদের প্রজাসত্ব বিল পাশ করানোর নেপথ্যের কারিগর করুণা সিন্ধু রায় এর ছেলে প্রসুন কান্তি রায়, আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য পীর হাবিবুর রহমান, গফরগাঁওয়ের আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ, সুনামগঞ্জের গোলজার ভাই, অগ্নিযোগের বীরমাতা মনোরমা বসু, অত্যন্ত ক্ষিপ্র ও নির্ভীক মুয়িজুর রহমান, মৌলভীবাজার তথা সমগ্র সিলেটের অবিসংবাদিত আন্দোলন সংগ্রামের অকুতোভয় সংগঠক আজিজুর রহমান, কমলেষ ভট্টাচার্য্য, কনক লাল দেব চৌধুরী, আওয়ামীলীগের নেতা সৈয়দ আব্দুল মুজিব, শ্রীমঙ্গল ছাত্রলীগের আব্দুল মন্নান, তরুন সেন, এম.এ. রহিম, আবদুল মতলিব, রাধাকান্ত তাঁতী, বড়লেখার তবারক হোসেন, অপুর্ব কান্তি ধর সহ অন্যদের সাথে একাত্ম হয়ে ‘শেখ মুজিবের মুক্তির’ ইস্যুতে বৃহত্তর সিলেট এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন সংগ্রামে সরাসরি অংশ নিই। এ সময় এস.কে রায় ও গোপাল সেন আমাকে ৫০০ টাকা দিয়ে আর্শীবাদ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে প্রেরণা দেন। তখন বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন বয়সে তরুণ, প্রচন্ড দেশপ্রেমের উদগ্রীব বাসনায় শারীরিক কোন বাধাই কাজ করতনা তাঁদের ভেতরে। দেশ স্বাধীন করার মানসিক ইচ্ছা এতটাই সুতীব্র ছিল যে, এর সামনে শারীরিক কষ্ট কোন কষ্টই ছিলো না। তখনকার সময় আমাদের স্লোগান ছিল – ‘ইত্তেফাকের তালা খোল, শেখ মুজিবকে মুক্ত কর’। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমি সুনামগঞ্জের সদ্য প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পক্ষে নির্বাচনে কাজ করি। এর পর শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ‘এক দেশ, এক নেতা’ মেনে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
৭ মার্চের পরই আমরা ভৈরববাজার পর্যন্ত মুয়িজুর রহমান, এম.এ রহিম ও মন্নান সাহেবের একদল লোক মিলে পুল, কালভার্ট, ইত্যাদি ভাঙ্গতে থাকি। মে মাসের শেষদিকে সুরেশ তাতীঁ, কালিদাশ পাংখ্যা, কৃষ্ণ র‌্যালি, কুল তাঁতী, কুনকুনিয়া রুদ্র পাল (শহীদ ড্রাইভার), হরি নায়েক, মিলে আমরা বিলাসছড়া ২৬ নং লাইন দিয়ে গেলাম বাঘাইছড়ি এবং সেখানে ছন দিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরী করি । পঞ্চাচায়েত কমিটির সদস্য পঞ্চু তাঁতী খাবার দিতেন। আমি একদিন ভুলতথ্যে খবর পেলাম বর্তমান কৃষিমন্ত্রি অগ্নিকণ্যা মতিয়া চৌধুরী ও পংকজ ভট্টাচার্য্য মিটিং করবেন আগরতলা। আমি মিটিং এ যাওয়ার উদ্দেশ্যে আগরতলা যাওয়ার সময় ভারতবাহিনীর নিকট সন্দেহজনকভাবে ধরা পড়ি তারা জিঞ্জাসাবাদ করলেন, তখন হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের এক কর্মীর মাধ্যমে (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী) ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিন চেীধুরী জিঞ্জাসাবাদস্থলে আসেন এবং আমাকে মুক্ত করেন ও ইন্ডিয়ান অফিসার আমাকে একটি পাস কার্ড প্রদান করেন। আসলে ঐদিন মিটিং হয়নি। কয়েকদিন পরে মিটিং হয়েছিল, তবে আমি যেতে পারিনি তখন হঠাৎ আমার উরুদেশে কাবার্ঙ্কুল হয়েছে। এর পরে সৈয়দ মতিউর রহমানের সাহায্যে ভারতের বালিগাঁও এ ট্রেনিং এ যোগ দিলাম। ২-৩ দিন এখানে ট্রেনিং করার পর অমিয়নগরে ট্রেনিং এ গেলাম। কিন্তু সেখানে ২ দিন সামরিক ট্রেনিং করার পর অসুস্থতার জন্য আমাকে বালিগাঁ ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হল। ঐ সময় আমাকে দম ধরে রাখা এবং প্রতিকুল চৈতন্য উত্তেজনাকর ট্যাবলেট খাওয়ানো হত। তখন সেক্টর -৪ এর কমান্ডার কর্ণেল সি.আর. দত্ত স্যার (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আমাকে ১৫০ রুপি দিয়ে চিকিৎসার জন্য বলেন এবং আমাকে গোয়েন্দা তথ্য নেওয়া, এদেশের জনগনকে আশ্বস্ত করা, র‌্যাকি করা, অস্ত্রধারী মুক্তিযুদ্ধাদের শত্রু সম্পর্কে তথ্য দেওয়া, আহত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা করা, হাতবোমা ও এক্সপ্লোসিভ বহন করতাম। এরপর সেপ্টেম্বর – অক্টোবর মাসে সেক্টর – ৩ এ চলে আসি এবং দুর্গেশবাবুর অধীনে অস্ত্রধারী যোদ্ধা সামাদ, জাহির, আবদুল জলিল এদের সাথে হবিগঞ্জের ৪০ কিমিঃ পর্যন্ত ভিতরে ঢুকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ঠান্ডা পানির ভেতরে প্রচন্ড শীতে, মশা মাছির কামড়, জোঁকের রক্তচোষায়- এগুলোর কোনওকিছুই আমাদের আটকাতে পারতনা। এরপর নভেম্বরের শেষ দিকে আমাদের কয়েকজনকে বেঁচে ফুলতলাতে এক প্রলয়ংকরী সম্মুখ যুদ্ধে পাঠানো হল। ধলাই সীমান্তে জঙ্গলে এক সময় আমি গুলি খাই (গুলিটি একটি গাছে লেগে রিটান করে আমার পায়ে লাগে) এবং আমাকে কমলপুরে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর পর ৬ ডিসেম্বরে আমি ভানুগাছ এ আসি এবং হেঁটে হেঁটে ৭ ডিসেম্বরে বিদ্ধস্ত শ্রীমঙ্গলে আসি। এ সময় আমি সহ আরও মুক্তিযোদ্ধা মেশিন দিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সাথে পুতে রাখা মাইন উত্তোলনে সাহায্য করি এবং বর্তমান র‌্যাব – ৯ ক্যাম্পের ছাদের উপর একজন হিন্দু মেয়ের ক্ষতবিক্ষত লাশ পাই। এছাড়া, সাধুবাবার থলিতে অনেক লাশ ও হাড়গোর দেখলাম। এরপর বাড়িতে গেলাম এবং মা’এর সাণিধ্যে গিয়ে স্বাধীন বাংলার স্বাদ উপভোগ করি। পরবর্তীতে সংবাদ পত্রিকায় রাসেন্দ্র দত্তের সাথে থেকে বেশ কিছু দিন লেখালেখি করি।
এদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে একবারই । মুক্তিযোদ্ধারাও তাতে অংশ নিয়েছেন একবারই। আমাদের দেশে তো প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধ হয় না। তবু নিত্য দেখি নতুন মুক্তিযোদ্ধারা তালিকাভুক্ত হন। এতে করে যারা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা, তাদেরকে বার বার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, কজন মুক্তিযোদ্ধা আর বেঁচে আছে? যারা আছে তারাও নিভু নিভু প্রায়। জাতির এই সূর্যসন্তানদের জীবন প্রদীপ নিভে গেলে, চাইলেও তখন তাদের আর পাওয়া যাবে না। এজন্য ভাগ্যাহত-অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। যাচাই বাছাই প্রসঙ্গে আমার একটি ক্ষুদ্র অভিমত হলো মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। কেউ হঠাৎ করে হুইসেলের বাঁশি বাজিয়ে দিলেন আর তাতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো- আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিশ্চয়ই সেভাবে আরম্ভ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিলো; বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও সাধনায় তিল তিল করে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের জন্য জাতিকে প্রস্তুত করেছেন; বাঙালি একটি জাতি, এই বোধ, চেতনা জাগিয়ে দিয়ে তিনি বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণ করেন; আসলে ৪৮ সালে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা, ৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, ৪৮-৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র ঐতিহাসিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়, ৫৭ সালে যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন, ’৬২’র ছাত্র আন্দোলন, ৬৪’র দাঙ্গা প্রতিরোধ, ৬৫ সালে আইয়ুবের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাকে প্রার্থী করে বিরোধী দলের নির্বাচন, ৬৬ সালে বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা পেশ, ৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলায় প্রধান আসামী করে ফাঁসি দানের চেষ্টা, ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংঙ্কুশ বিজয়, ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনকালে ৭ মার্চ রেসকোর্সে ময়দানে প্রদত্ত সুচতুর নির্দেশনা সংবলিত ভাষণে বঙ্গবন্ধুর প্রকারান্তরে স্বাধীনতা ঘোষণা, তারপর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এভাবেই দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শুরু হয়েছিলো। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার, যাকে আমরা বলতে পারি স্বাধীনতা সংগ্রাম, তারই অংশ এবং যৌক্তিক পরিণতি। আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা।
বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার কন্যার নিকট আবেদন, মৃত্যুর পুর্বে মুক্তিযোদ্ধার প্রাপ্য স্বীকৃতিটি যেন উনি আমাকে দেন যাতে করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমার মৃত্যুপরবর্তী দাফন হয়। স্বীকৃতির সহিত ভাতা পেলেও আমার ইচ্ছা এ টাকা দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের লেখাপড়া এবং গরীবদের দাফনকার্য এবং সংকারকার্যের জন্য ব্যয় করব। কারন, আমি অভ্যাসগতভাবে একবেলা খাই, আমার যা যৎসামান্য সম্পদ আছে তা দিয়েই আমার চলে এবং চলবে।
নতুন প্রজন্মের প্রতি তাঁর আহবান, তোমরা মূল্যায়ন করতে শেখো এক সাগর রক্তের বিনিময় অর্জিত দেশের, এ দেশের জন্য তোমাদের কী করা দরকার তোমরা একবার ভেবে দেখ। একটি দেশের বর্তমানকে চেনা যায় তার গৌরবময় সঠিক ইতিহাস দ্বারা। অতীত দিয়ে অর্থাৎ অতীতের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে গঠিত হয় বর্তমান। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা মানুষের মনে জোগায় চেতনা। আর এই চেতনা দিয়েই তৈরি হবে সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। তাই আমাদের সকলকে একাত্তরের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে, তাঁর আদর্শেই গড়ে তুলতে হবে সোনার বাংলা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যার সরকার স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর হলেও মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত তালিকা প্রণয়নের যে উদ্যোগ অভ্যাহত রেখেছেন এ জন্য তাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
আলাপ কালে তার কাছ থেকে আরো জানা গেলো তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকা ভুক্তির জন্য এখনও নিয়মতান্তিক ভাবে আবেদন করেননি। তাকে এলাকার মানুষ এমনিতেই মুক্তিযোদ্ধা বলে সম্মান দেখায়। পর পর ৩বার বিপুল ভোটে এলাকাবাসী তাকে শ্রীমঙ্গল আশিদ্রোন ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য নির্বাচিত করেছে। শাররীক অসুস্থতার কারনে নিজে থেকেই তিনি আর নির্বাচনে অংশ গ্রহন করেন নি। এ সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অর্ন্তভুক্তির জন্য তার কাছে কি ডকুমেন্ট আছে জানতে চাইলে তিনি অনেকটা মনোক্ষুন্ন হন। পরে তিনি বলেন, যুদ্ধের পূর্বে, যুদ্ধে ও যুদ্ধ পরবর্তী আমার কর্মকান্ড তো দৃশ্যমান। এ বিশাল আন্দোলনে অংশ নেয়া প্রায় সকল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের তো তা জানা। যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত তাদের চোখের সামনেই তো আমার কর্মকান্ড। আমি এতো দিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির প্রয়োজন পড়বে তা তো মনে করিনি। আর আমার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানী ভাতা প্রয়োজন এমনও না। আমি সংসার করিনি। একা মানুষ। নিজে এক বেলা খাই। আমার এখনও যা আছে তা দিয়েই বাকী জীবন চলে যাবে। অনেকেই তাঁকে আগ্রহ করছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি সরকার দিচ্ছে তা হলে আপনি সে সনদ নিচ্ছেন না কেন। তাই তিনি জীবনের এ বেলায় এসে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে অনেকটা আবেগাফ্লুত হয়ে পড়েছেন। তিনি জেনেছেন আমি মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করি, মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র প্রদর্শন করি। আমার কাছে আসলে তাঁর এ কাজ সহজ হবে। তাই আমার কাছে আসা। তিনি যখন আমার কাছে আসেন তখন আমি আমার পেশাগত কারণে প্রচন্ড ব্যাস্ত। প্রথমদফা তাঁর কিছু কথা শুনে আমি তাঁকে ৭/৮ দিন পর তাঁর সমস্ত কথা শোনে একটি প্রতিবেদন করবো বলি। তিনি রাজি হন। কিন্তু ৭/৮ দিনের সকাল বিকালই তিনি আমার অফিসে আসেন। আর প্রতিদিনই আমার পাশেবসে তিনি একটু একটু করে সে সময়ে গল্প বলেন। এর ভিতরে তিনি বেশ কিছু ডকুমেন্টও আমাকে এনে দেন। ৭/৮দিন গড়িয়ে ১০/১৫ দিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও আমি তাঁর কাজ ধরতে পারিনি, নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছিলো। এক সময় তিনি এসে বললেন, আমি কিছু খরচাপাতি দিবো আমার রিপোর্টটা একটু করেন। জানালাম রিপোর্ট করতে খরচ লাগেনা, এর মধ্যেই রিপোর্টটি করবো। ঐদিন তার কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য নোট করি এবং তা কম্পিউটারে কúোজের জন্য আমার এক প্রিয় ছোট ভাই সব্যসাচিকে দেই। কম্পোজের সময় উনাকেও কাছে বসতে অনুরোধ করি। শনিবার দুপুরে হঠাৎ করে চোখে পড়ে আমার অফিসে ও পাশের চায়ের দোখানে তিনি নিচ দিকে তাকিয়ে বিষন্ন মনে কি খোঁজছেন। কি খোঁজছেন জানতে চাইলে তিনি কিছু বলেন না। কয়েকবার চাপা পাপি করার পর তিনি বলেন, কম্পোজ করার সময় চা নাস্তা খেতে এবং রিপোর্টটি পাঠাতে অবশ্যই কিছু খরছ আছে। তাই আপনাকে দেয়ার জন্য পাঁচশত টাকা এনেছিলাম। এখন পকেটে খোঁজে পাচ্ছিনা। তাঁর কাছ থেকে তা শোনার পর নিজেও চা য়ের দেকান ও আমার অফিসে খোঁজি এবং অন্যদের খোঁজতে বলি। কিন্তু তা মিলেনি। এ সময় আমিও অভিমানে তাঁকে বলি টাকা লাগেনা বলেছিলাম এর পরও আপনি টাকা এনেছেন এ জন্যই তা হারিয়েছে। তাঁকে হারানো টাকা নিয়ে মন খারাপ না করতে বলে, ঐ টাকা আমার জন্য এনেছিলেন আমি নিয়েছি মনে করেন বলে জানালাম। সে সময় তাঁর খরছের জন্য আমি কিছু টাকা দিতে চাইলে দেখলাম তাঁর মন খারাপ হচ্ছে। তাই আর তাঁকে টাকা দেয়ার সুযোগ পেলাম না। মুক্তিযোদ্ধার পাঁচশত টাকাই আমি গ্রহন করলাম। তবে আসলেই কি পাঁচশত টাকা গ্রহন করলাম। না নিজে চলতে গিয়ে ও নিজের প্রয়োজনে এ স্বাধীন দেশে খরচ করা লক্ষ লক্ষ টাকা সবই তাদের অবদান?
মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধার মুখের বিবরন আমি শুনেছি। আমার কাছে তার এ বক্তব্যকে মনে হয়েছে খাদহীন। তা ছাড়া তিনি যে, কাগজ এনেছেন আশিদ্রোন ইউনিয়ন পরিষদের প্যাডে প্রয়াত চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ চৌধুরীর স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম নামে একটি প্রত্যায়ন পত্র। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি-কমান্ডার দুর্গেশ বাবু কর্তৃক স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একটি প্রত্যায়ন পত্র, যে খানে লেখা আছে তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩ নং সেক্টর এলাকায় আমার সঙ্গীয় যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহন করেছেন। শ্রীমঙ্গল সিন্দুর খান ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ ময়না মিয়া স্বাক্ষরিত এক প্যাডে দেখা যায় আব্দুর রহিম ভারতে যাওয়ার আগে মুক্তিযুদ্ধের সকল আন্দোলনে অংশ নেন এবং তাদের সাথে ট্রেনিংএ যোগ দেন। শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ন্যাপ নেতা মুক্তিযোদ্ধা রাসেন্দ্র দত্ত সাক্ষরিত প্রত্যয়ন পত্রে তিনি বলে আব্দুর রাহিম একজন প্রকৃত স্বাধিনতা সংগ্রামী তার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া নায্য অধিকার। মৌলভীবাজার জজ কোটের আইনজীবি মুক্তিযোদ্ধা শান্তিপদ ঘোষও লিখিত ভাবে তাকে ন্যাপের একজন সক্রীয় কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করেন। এ ছাড়াও ১০/ ১৫ বছর আগে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে নিয়ে একটি রিপোর্ট এবং আরো কিছু কাগজ এবং বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণদের বর্ননাসহ আনুসাঙ্গিক অনান্য তথ্য তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রাপ্তিতে সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com