মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বদরুজ্জামান বদরুল, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবী
বিশেষ প্রতিনিধি॥ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ এক পিতার সাহসী সন্তান যুক্তরাজ্য প্রবাসী কমিউনিটি লিডার বদরুজ্জামান বদরুল। ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া বাঙালিদের ওপর পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা ও নির্যাতনের ঘটনা তাঁকে বার বার পীঁড়িত করে। স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের জন্য কিছু করার প্রয়োজনার্থে জীবন ঝুঁকি নিয়ে তিনি নিবেদিত হয়েছিলেন বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুদূর প্রবাসে থেকেও নিজ মাতৃভূমির মুক্তির জন্য আন্দোলন সংগ্রামের প্রথম সারিতেও ছিলেন সাহসী এই বদরুজ্জামান।
বদরুজ্জামান বদরুলের জন্ম ২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার ৬নং একাটুনা ইউনিয়নের মল্লিকসরাই গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন আবু সুফিয়ান ওরফে আসকির মিয়া। মাতা ছিলেন রহিমা বানু। এলাকায় তাঁর পিতা একজন সুপরিচিত ও বিশিষ্ট সালিসি ব্যক্তি ছিলেন। পিতামাতার আট সন্তানদের মধ্যে বদরুজ্জামান বদরুল হচ্ছেন সবার বড়। ১৯৫৫ সালে চাঁদনীঘাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষা জীবনের শুরু হয়। পরবর্তীতে জুনিয়র হাইস্কুল ও ঐতিহ্যবাহী মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি পড়াশোনা করেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত সাহসী, মেধাবী, উদ্যমী ও কর্মঠ ছিলেন। সক্রিয় ছিলেন ছাত্র রাজনীতিতেও। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে লালন করে জড়িয়ে পরেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। কিন্তু পারিবারিক কারণে ১৯৬৫ সালে তিনি পাড়ি জমান সুদূর লন্ডনে। ১৯৭১ সালে সেখান থেকেই একাত্ম হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের লড়াইয়ে। যোগ দেন তৎকালীণ সিলেটের বৃহত্তর প্রবাসীদের সামাজিক সংগঠন মৌলভীবাজার জেলা জনসেবা উন্নয়ন সমিতিতে। তৎকালীন সেই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তার নিজ একাটুনা ইউনিয়নের আরেক কৃতি সন্তান মঈনুদ্দিন মনাফ মিয়া। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ-মাতৃকার টানে, তারুণ্যে টগবগ যৌবন নিয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়েন ক্লান্তিহীন মুক্তিসংগ্রাম আন্দোলনে। এই ত্যাগী সৈনিক শুধু মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনেই যুক্ত ছিলেন না, বরং প্রবাসে নিজ কষ্টে উপার্জিত টাকার বেশিরভাগই একটি অংশ দান করে দিতেন নিজ দেশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনরত বিভিন্ন সংগঠনসমূহে।
রক্তাত্ত সাল ১৯৭১। এরই মধ্যে জানতে পারেন বিশ্ব ব্যাংক থেকে আর্থিক অনুদান নিচ্ছে পাকিস্তান। যেটি কিনা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হওয়ার আশংকা করছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনরত রাজনৈতিক নেতারা। তাৎক্ষণিক মৌলভীবাজার জেলা উন্নয়ন জনসেবা সংগঠনের সবাইকে নিয়ে ফ্রান্সে বিশ্বব্যাংকের সামনে জড়ো হওয়ার পরিকল্পনা নেন। সেখানে অবস্থান নিয়ে গড়ে তুলেন তীব্র বিক্ষোভ ও আন্দোলন । ‘এইড টু পাকিস্তান মিনস্ ভুলেট ফর বাংলাদেশ’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয় প্যারিস শহর। তাঁদের আন্দোলনের মুখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় বিশ্ব ব্যাংক।
বিশ্ব ব্যাংকের তৎকালীন পাকিস্তানকে অর্থ প্রদান বন্ধের সিদ্ধান্তের পর দেশে বাঙালি মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বিপুল উৎসাহের জন্ম দেয়। প্যারিস থেকে লন্ডনে ফিরে গিয়ে জানতে পারেন দেশে পাকিস্তানি মিলিটারিরা তাঁর বাবাকে তোলে নিয়ে যায় (তৎকালীণ টর্চার সেল হিসেবে খ্যাত) মৌলভীবাজার সার্কিট হাউজে। সেখানেই রাতভর টর্চার করে তার বাবাকে হত্যা করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। তখন তার দেশে ফেরার ইচ্ছে থাকলেও পাক হানাদার বাহিনী তাকেও প্রাণে মেরে ফেলতে পারে স্বজনদের এমন আশংকায় তিনি আর দেশে ফেরেননি ।
অবশেষে দীর্ঘ ৯মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বহু প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে যান। ৯ জানুয়ারি লন্ডনের তৎকালীণ মুগলশাহী রেষ্টুরেন্টে বঙ্গবন্ধু যাবেন শুনে বদরুজ্জামান সেখানে ছুটে যান তার সান্নিধ্য পেতে। তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা হয় বদরুজ্জামানের। তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন প্রবাসে মুক্তি সংগ্রাম আন্দোলনের অন্যতম কুটনৈতিক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তখন দেশে ঘটে যাওয়া তার পিতার ঘটনাবলী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করলে তিনি বদরুুজ্জামান কে বুকে জড়িয়ে ধরেন পরম মমতায়। সদ্য বাবা হারানো ব্যাকুল হওয়া বদরুজ্জামানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিনের মুঘলশাহী রেস্টুরেন্টে বঙ্গবন্ধুকে নিজ হাতে খাওয়ানোর সেই স্মৃতি আজও আবেগে-আপ্লুত করে বদরুজ্জামান কে। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পাওয়া সেই বদরুজ্জামান আজও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালণ করে মানুষের সেবায় নিমিষেই কাজ করে যাচ্ছেন। প্রবাসে থাকলেও প্রতিবছর তিনি ছুটে আসেন তাঁর নিজ মাতৃভূমিতে। সাধারণ মানুষের প্রতি সর্বদা বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন গ্রাম হবে শহর। সেই স্বপ্নের সাথে একাট্টা হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন নিজ গ্রাম উন্নয়নে নিরবে নিভৃতে। তাঁর কাছে দল মত, ধর্ম-বর্ণ শ্রেণি পেশা কোন কিছুর পার্থক্য নেই, মানবতার সেবাই তাঁর পরম উদ্দেশ্য। তিনি নিজ অর্থায়নে গরীব মেয়েদের বিয়ে, গরীব অসহায়দের ফ্রি চিকিৎসা, মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মান সহ অসংখ্য ভাল কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তি সংগ্রামে নিজ দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছেন সেটা নিয়ে তিনি সর্বদা গর্ববোধ করেন।
জীবনের বাকি সময় তিনি এভাবেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সোনারবাংলা বিনির্মাণে দেশের জন্য কাজ করে যেতে চান। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আজও তিনি ও তার পিতার মুক্তিযুদ্ধের কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি। তিনি প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধের সকল সংগঠকদেরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোড় আহ্বান জানান।
তিনি ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ও আট সন্তানের জনক। তার ছেলেমেয়ে সবাই প্রবাসে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবীত হয়ে দেশপ্রেমে ব্রত হওয়ার আহ্বান জানান।
মন্তব্য করুন