মুক্তিযুদ্ধে আনসার কেরানি মহিব উদ্দিন আহমদ চৌধুরীর অবদান
সোহেল আহমদ চৌধুরী॥ ১৯৭১ সালের ২৭ই মার্চ সন্ধা ৭টা। যুদ্ধের আশংকায় চারিদিকে ভৌতিক নিরবতা। পাকিস্তানিদের অতরর্কিত আক্রমণের ভয়ে শুনসান রাস্তা ঘাট। চারিদিকে অন্ধকার, রাস্তাঘাটে রিক্সা গাড়ীর কোন চলাচল নেই বললেই চলে । পাশের জঙ্গল ও বাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে শিয়াল কুকুরের আওয়াজ আসছে । দুর থেকে মাঝে মধ্যে গুলির শব্দের মত আওয়াজ শুনা যায়। মাঝে মধ্যে হাতল ওয়ালা সাইরেনের আওয়াজও শুনা যায় । লোকজনের চলাচল একদম নেই বললেই চলে।
হঠাৎ আমাদের বাসার ভিতরে এসে থামলো একটি আর্মির জীপ। সেই জীপ থেকে নেমে এলেন ৫ জন যুবক, একজন এসে দরজায় কড়া নাড়লেন। চারিদিকে যুদ্ধের দামামা তাঁর উপর আর্মির জীপ । অজানা ভয়ে সবার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। জোরে কেহ শ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছেন।
তখন দক্ষিণ কলিমাবাদের বিদ্যুৎ ছিল আমাদের বাসা পর্যন্ত। বিদ্যুতের খুঁটিও ছিল আমাদের বাসার সীমানার মধ্যে। এর পর আর বিদ্যুৎ সংযোগ ছিলনা দক্ষিণ দিকে। আবার গাড়ী আসার রাস্তাও ছিল আমাদের বাসা পর্যন্ত শেষ । এর পর আর গাড়ী যেত না। তবে দক্ষিণদিকের মানুষের রিক্সা বা পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা ছিল।
আব্বা বরাবরই সাহসী মানুষ। বৃটিশ আর্মিতে চাকরীর সুবাদে উনার আলাদা কিছু ট্রেনিং ও সাহস ছিল । উনার অর্জিত দুইটি মেডেল ও সার্ভিস বুকটা আজও আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে। তিনি সহজে ঘাবড়ে যেতেন না বা ভয়ে চুপসে যেতেন না। সাহসের সাথে যে কোন সমস্যা মোকাবেলা করতেন। তিনি নিঃসংকোচে গিয়ে দরজা খোলে দিলেন। তখন উনার সামনে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ছাত্রলীগের তৎকালিন ৫ জন শীর্ষ ছাত্র নেতৃবৃন্দ। পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত একটি আর্মি জীপ গাড়ী চালিয়ে নিয়ে এসেছেন তাহারা। আনসার অফিসের উত্তরে ও শিক্ষা অফিসের পুর্বদিকের ছোট অফিস ঘরটি ছিল এনিমি অফিস। মছদ্দর আলী সাহেব তৃতীয় ছেলে ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল মুকিত। উনি ছাত্রলীগের খুব সাহসী ও ত্যাগী নেতা ছিলেন। মুক্তি যুদ্ধকালিন সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাস আগে মৌলভীবাজারের এই বীর সন্তান একটি অনভিপ্রেত ঘটনার শিকার হন। তার সাথে ছিলেন দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ শহিদ ও শহীদ রানু। চরম পৈশাচিক নির্যাতনের পরও হানাদার বাহিনীর কাছে, সহযোগী কারও নাম না বলায়পাকিস্থানি বাহিনীর নির্মম অত্যাচারে শিকার হয়ে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মুকিত, শহিদ ও রানু ।
মৌলবীবাজার মহকুমা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক তুখোর ছাত্রনেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এ. কে. সুজাউল করিম আব্বার কাছে এসে শহরের বর্তমান সার্বিক পরিস্হিতি ব্যাখ্যা করে এবং জানানন তারা এসেছেন অস্ত্রের সন্ধানে। আনসারের রাইফেল ক্লাবের যে সমস্ত অস্ত্র ও রাইফেল আছে তা ছাত্রনেতৃবৃন্দকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আরও অস্ত্র বা রাইফেল কোথায় আছে তা বলার জন্য অনুরোধ করা হয়। ছাত্রনেতৃবৃন্দ আব্বাকে জানালেন যে রাইফেল ক্লাব ও আনসারের সকল ২.২ বোরের রাইফেল সভাপতির তত্বাবধানে অফিসের ভিতরের ট্রেজারির মধ্যে সংরক্ষিত আছে তা উনারা অবগত আছেন।
এ,কে,সুজাউল করিমের সাথে ছিলেন শহরের রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ মৌলবীবাজার মহকুমা ছাত্রলীগের তৎকালিন মেধাবী সাহসী সিনিয়র নেতা প্রখ্যাত সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশিদ। ছাত্রলীগের অত্যন্ত জনপ্রিয় সাহসী ছাত্রনেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল মুকিত। ছাত্রলীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সোবহান (মসো)। ছাত্রলীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজনগর উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ চৌধুরী (রানা)।
আমার আব্বা মহিব উদ্দিন আহমদ চৌধুরী ডাক নাম ছিল সোলেমান। মৌলবীবাজার মহকুমা আনসার অফিসের তৎসময়ের স্থানীয় লোক হিসাবে চাকরিপ্রাপ্ত প্রথম ও শেষ ব্যক্তি। আব্বা আনসার অফিসে একই সাথে দুইটি পদে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন একাউনটেন্ট ও হেড ক্লার্ক। দীর্ঘ ২৫ বৎসর চাকরি করার পর অবসরে যান।
বাংলাদেশ সরকার উনার অবসর গ্রহন করার পর পরই। আব্বা দুই পদে চাকরি করতেন এবং একাই সামলাতেন। আব্বা কোনদিন প্রমোশনও নিতেন না কারন প্রমোশন নিলেই বদলি বাধ্যতামূলক । আর পরিবার রেখে বদলি তিনি পছন্দ করতেন না । যদি বদলি হই তা হলে পরিবার পরিজন নিয়ে কি ভাবে একা থাকবেন। যার কারনে চাকরির প্রথম জীবনে বদলিও হয়নি প্রমোশনও হয়নি। তবে শেষ দিকে হয়েছিল, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন আব্বা। এখানে উল্লেখ্য যে নিয়ম মাফিক অবসরে যাওয়ার কয়েক বছর পুর্বে, উনাকে সরকার এসিস্ট্যান্ট এডজুটেন্ট হিসাবে প্রমোশন দেয়। নতুন ঐ পদ থেকে কয়েক বছর চাকরি করে চুরান্ত অবসরে যান।
আনসারের অনেক গুলি থ্রি নট থ্রি (৩০৩) রাইফেল ছিল। তা সব সময় সংরক্ষিত ছিল জেলখানার পশ্চিম পাশে ও কোর্ট বিল্ডিয়ের পূর্ব দিকের ট্রেজারির মধ্যে ২৪ ঘন্টা পুলিশ প্রহরায়। আমার আব্বা কেরানিসাহেব ছিলেন তৎকালিন পুর্ব পাকিস্তানের মৌলবীবাজার মহকুমার রাইফেল ক্লাবের সভাপতি।
আনসারের প্রাথমিক ট্রেনিংয়ের যে কোন প্রয়োজনে সরকারি অফিসের কর্মকর্তারা এবং সমাজের বিশেষ শ্রেনীর মানুষ রাইফেল ক্লাবের সদস্য ছিলেন । উনাদের সুবিধার জন্য আনসার অফিসের ভিতরে ২.২ বোরের রাইফেল সংরক্ষণ করার জন্য সভাপতির দায়িত্বে একটি ট্রেজারি ছিল।
আব্বা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্মকান্ডে সব সময় নিজকে জড়িত রাখতেন । জেলা জামে মসজিদের (কোর্ট মসজিদ) প্রতিষ্টাকালিন সময় থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন জেলা জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্য । পারিবারিক ভাবে আমার সেজভাই সমেছ আহমদ চৌধুরীও সদস্য ছিলেন আব্বার মৃত্যুর পর।
অফিসের ট্রেজারির মধ্যে প্রায় ২০০ শত ২.২ বোরের রাইফেল, আব্বার (আনসার কেরানি সাহেব ) কাছে সংরক্ষিত আছে। আব্বা ছাত্র নেতাদের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনে পারিপার্শ্বিক অবস্হা বিবেচনা করে সবাইকে আশ্বস্ত করেন। সরকারি চাকরিজীবি ও রাইফেল ক্লাবের সভাপতি হিসাবে প্রতিশ্রুতি দেন। দেশের জন্য জনগণের জন্য মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিজের জীবনের যত ঝুঁকি আসুক সব কিছুকে তুচ্ছ করে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে রাজি হয়ে যান। মনস্থির করেন এ, কে, সুজাউল করিম ও উনার সঙ্গী ছাত্রনেতাদের যে কোন মূল্যে সাহায্য করার জন্য। যে কোন সময় যে কোন ধরনের আক্রমণের মোকাবেলা সংঘবদ্ধ ভাবে প্রতিহত করার জন্য ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ মানসিক ভাবে বেশ প্রস্তুত ছিলেন। তাই আব্বা সময় ক্ষেপন না করে তৎক্ষনাৎ রাতেই জীপে উনাদের সাথে অফিসে গিয়ে ট্রেজারির তালা খুলে দেন।
আনসার অফিসও আমাদের বাসা থেকে বেশী দুর নয় পায়ে হেঁটে আসা যায়। আব্বা এ, কে সুজাউল করিম, সাংবাদিক হারুনুর রশিদ,শহীদ আব্দুল মুকিত,আব্দুস সোবহান (মসো) ও মোহাম্মদ চৌধুরী রানাদের হাতে একে একে তোলে দেন ২.২ বোরের রাইফেল গুলো। বললেন ভাল করে দেখে যত গুলো প্রয়োজন নিয়ে যাও। বাসায় উপস্থিত ৫ জন ছাত্রনেতাদের সাথে এবং উনাদের বাবাদের সাথেও আব্বার ভাল সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব ছিল।
১৯৭১ সালের ৫ই শেরপুর-সাদিপুরের যুদ্ধে পাকিস্তানিদের সফলভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় ছাত্র-জনতার সম্মেলিত প্রচেস্টা ও ছাত্রনেতাদের বিচক্ষণতার জন্য। সঠিক সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাইফেল ক্লাবের সভাপতি আনসার কেরানি সাহেবের বাসায় গিয়ে উনাকে সাথে নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৭ই মার্চ রাতেই অফিসের ট্রেজারি থেকে রাইফেল সংগ্রহ করা। সবার সর্বাত্মক প্রতিরোধে হানাদার বাহিনী পিছু হঠে শেষ পর্যন্ত সিলেটে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
এ,কে, সুজাউল করিম ৭১ সালের যুদ্ধকালিন সময়ে তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের কারিশমাটিক লিডার । ১৯৭১ সালের জুন মাসের কোন এক সকাল অফিস সবেমাত্র শুরু হয়েছে। তারিকটা সঠিক মনে নেই আব্বা বা বড় ভাই(মরহুম খসরু আহমদ চৌধুরী) বেঁচে নেই যে জিজ্ঞাসা করবো। আনুমানিক সকাল সাড়ে ৯টা বা ১০টার দিকে হবে। অতর্কিত ভাবে এক দল সশস্ত পাকিস্তানি আর্মি আনসার অফিসে ঢোকে পড়ে। তবে এর আগে সরকারি ভাবে ঘোষনা করা হয়। যে যেখানেই থাকুন না কেন সবাই এসে অবশ্যই কাজে যোগ দিতে হবে। আসল উদ্দেশ্য সবাইকে অফিসে নিয়ে আসা এবং পরে সুযোগ মত অফিসে ঢোকে সবাইকে বন্দি করা।
আনসার অফিসে ঢোকে অফিসারদের খোঁজতে থাকে। আর্মি আসার সাথে সাথে এসিস্ট্যান্ট এডজুটেন্ট ( নাম ভুলে গিয়েছি, শহীদ অফিসার ছিলেন কুমিল্লা এলাকার লোক। তাড়াতাড়ি স্ট্রিলের আলমারির পিছনে গিয়ে লুকিয়ে যান। সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছা ঠিক ঐ সময় আব্বা বুদ্ধি করে সাথে সাথে অফিসের পশ্চিম দিকের দরজা দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে যান। পাশেই প্রচুর ঘন জঙ্গল উনি জঙ্গলের ভিতরে ঢোকে পড়েন।
আর্মিরা অফিস সার্চ করে আব্বাকে না পেয়ে আলমারির পিছন থেকে এসিস্ট্যান্ট এডজুটেন্টকে বের করে ধরে নিয়ে যায়। আব্বা (আনসার কেরানিসাহেব) প্রথম থেকে উনার উপর যে কোন সময় বিপদ আসতে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের বা ছাত্রনেতৃবৃন্দকে রাইফেল দেওয়া ও নানা ভাবে গোপনে সাহায্য করার কারনে।
পাকিস্তানি আর্মিরা অফিস থেকে যে এসিস্ট্যান্ট এডজুটেন্টকে ধরে নিয়ে গিয়ে ছিল। সাড়া দিন সার্কিট হাউজের টর্চার রুমে বন্দি রেখে প্রচন্ড অমানুষিক নির্যাতন শেষে বিকালে চাঁদনীঘাটের ব্রিজের উপর পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে নিরপরাধ এসিস্ট্যান্ট এডজুটেন্টকে। হতভাগ্য ব্যক্তিটির লাশ সংগ্রহ বা খোঁজে এনে দাফন করার কাহারও সাহস হয়নি। লাশ পানির মধ্যে ভেসে ভেসে ভাটির দিকে চলে যায়। কখনও উনাকে খোঁজে পায়নি উনার স্ত্রী ও অসহায় সন্তানেরা ।
আব্বার সমান পরিণতি হত যদি তিনি অফিসের ভিতর লুকিয়ে থাকতেন। আমাদের ভাগ্য ভাল আল্লাহ আমাদের উপর সহায় ছিলেন। যার জন্য দীর্ঘ দিন আব্বার সান্নিধ্য আমরা পেয়েছি। আর ঐ দিকে আব্বার সহকর্মী এসিস্ট্যান্ট এডজুটেন্টের পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত কেহ ছিলনা বা সেই সুযোগও ছিলনা যুদ্ধ পরিস্হিতির জন্য। মানুষের চলাচল ছিল খুব সীমিত। পাক আর্মির ভয়ে কেহ সহজে ঘর থেকে বাহির হত না।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের এক শান্ত সকাল আব্বা উনার প্রতিদিনের অভ্যাস মত সকালে গোসল সেরে নাস্তা করতে বসেছেন। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত নানা বাড়ির মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আশ্রাকাপন নানার বাড়িতে সকালে সাদা পোশাকে পাকিস্তানি আর্মি এবং দেশিও কিছু রাজাকার ও দালাল সহ এসে হাজির হয়। একাটুনা ইউনিয়ন পরিষদের যুদ্ধকালিন সময়ের ভাইস চেয়ারম্যান আছকির মিয়া।
আব্বার গায়ে সাদা হাত ওয়ালা গেঞ্জি আর পরনে ছিল সাদা লুংগি। তিনি তখন সকালের নাস্তা খাচ্ছেন। আছকির মিয়ার নেতৃত্বে সাদা পোশাকের আর্মি ও রাজাকারের দলটি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে উঠানে অপেক্ষা করতে থাকে। আছকির মিয়া বড় মামা (হাবিবুর রহমান চৌধুরী) আব্বা ও নানার (হাজী আব্দুল মস্তাব চৌধুরী) সাথে কথা বলে এবং পাকিস্তানি বড় আর্মির অফিসার আব্বাকে তাঁর সাথে এই মুহুর্তে মৌলবী বাজার সার্কিট হাউসে গিয়ে অবশ্যই দেখা করতে হবে বলে জানায়।
আব্বাকে ওরা খাবার শেষ করতে দেয়নি বা লুংঙ্গি বদলে প্যান্ট পরতেও পারেননি। কোন সুযোগ না দিয়ে একপ্রকার জোড় করেই পিকআপ ভ্যানে তোলে আছকির মিয়া ও তাঁর রাজাকার সাথীরা। আব্বাকে নিয়ে মৌলবী বাজারের সার্কিট হাউসের উদ্দেশ্যে তাড়াহুড়া করে দ্রুত নানা বাড়ি আশ্রাকাপন ত্যাগ করে আছকির মিয়া গংরা।
সাড়া বাড়ির মানুষ আর্মির ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। সব কিছুর মধ্যে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা,আর অনিশ্চয়তায় ঘেরা। অজানা বিপদ ও নির্যাতন মৃত্যু ভয়ে তটস্থ সবাই। চারিদিকে কান্নার আওয়াজ। নানা সাথে সাথে পুর্ব বাড়ির হাফিজ নানা (আমরু চৌধুরী) সহ আত্মীয় স্বজন সবাই কে নিয়ে বড় তসবিহ বা খতমে ইউনুস পড়তে বসলেন। ইতিমধ্যে ছদগা হিসাবে একটি ছাগল দেওয়া হল আল্লাহর নামে। আম্মাসহ বাড়ির সবাই আল্লাপাকের কাছে নফল নামাজ পড়ে। কোরআন খতম করে দোয়া দুরুদ পড়ছেন কান্নাকাটি করছেন। আগেকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্হা ছিল খুবই খারাপ, এর মধ্যে যুদ্ধকালিন অবস্হা। তখনকার সময়ে মৌলবীবাজার কুলাউড়ার রাস্তার অবস্হা ছিল খুবই নাজুক । নানার জীপ গাড়ী থাকার পরও আর্মির ভয়ে রাস্তায় বাহির হওয়া অসম্ভব ছিল। যদি দেখে তা হলে মৃত্যু অনিবার্য, ওরা সব সময় সন্দেহ করতো। এই গাড়ী দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে হয়ত বা সাহায্য করা হচ্ছ। আব্বার জন্য আমাদের আত্নীয়স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাই খুবই অস্থির উদ্বিগ্ন আতঙ্কগ্রস্ত। বাস্তবে এমন অনভিপ্রেত অনাকাক্ষিত ঘটনার জন্য তিন মাস পর পরিবার আত্মীয় স্বজন কেহ প্রস্তুত ছিলেন না ।
মৌলবীবাজার সার্কিট হাউসের মধ্যে পাকিস্তানি আর্মিরা ওদের টর্চার রুমের মধ্যে আব্বাকে খুব নির্দয় ভাবে অমানুষের মত আচরণ করে। আব্বার জন্য সেটা ছিল খুবই ভয়ংকর ও যন্ত্রনাদায়ক।
আমার আব্বা ছিলেন খুব দয়ালু নির্লোভ অকুতোভয় একজন মানুষ । তিনি সাড়া জীবন সাদাসিধা সৎ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তবে খুব ভোজন প্রিয় মানুষ ছিলেন। ভাল দামি মজাদার খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে।
বিগত দিনের বিভিন্ন ঘটনায় পরিপ্রেক্ষিতে আব্বা সার্কিট হাউসের পাকিস্তানি আর্মির টর্চার রুম থেকে জীবিত অবস্থায় আমাদের মধ্যে ফিরে আসার সম্ভবনা খুবই কম। উনার আগে যাদেরকে আর্মি ধরে নিয়ে গেছে, তাদের আর কেউ জীবিত ফেরত আসেননি। আব্বার হাত-পা, চোখ বাঁধা। পাক আর্মির প্রচন্ড নির্যাতনের কারনে আববার চলার শক্তি নেই। এমন সময় একজন পাকিস্তানি আর্মি এসে উনাকে একহাতে ধরে নিয়ে সার্কিট হাউসের গেইটের পাশের দক্ষিণ দিকে একটি বিরাট বট গাছের নিচে নিয়ে গিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসায়। পিছনে মেশিনগান তাক করা, যে কোন সময় ব্রাশ ফায়ারে শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। সব কিছু প্রস্তুত, পাকিস্তানি আর্মিও মেশিনগানের পিছনে, হাঁটু ভেঙ্গে পজিশন নিয়ে বসে আছে নির্দেশের অপেক্ষায়। অন্তিম সময়ে বার বার আল্লাহকে স্বরণ করে বিভিন্ন দোয়া দুরুদ পড়ছেন। চোখের সামনে পরিবারের সবার চেহারা ভেসে আসছে।
ঠিক সেই মুহুর্তে আসমানের ফেরেশতার মত জীপ নিয়ে হাজির এক ব্যক্তি। তিনি বন্দি ব্যক্তিকে দেখে তাড়াতাড়ি জীপ থেকে লাফ দিয়ে নেমে চিৎকার করে হাত উপরে তোলে বললেন। ”সিপাহি রুখ কিচকো মাররাহে। এ আদমি হামারা ভাতিজাহে। ইছকো মারনেহি ছাকতা ছুরদো উছকো । অফিসার হাম দেখরা-হে এ আদমি বেকুসুর হে, আমারা জান পেচান হে”। কথা গুলি উর্দুতে উচ্চস্বরে বলতে বলতে সামনে এসে দাঁড়ালেন। মৌলবীবাজারের ৫০ ও ৬০ দশকের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, মৌলভীবাজার মহকুমা মুসলিমলীগের সভাপতি স্থানীয় এম, এল , এ , ইনাম উল্লা সাহেব। উনি অফিসারকে বলা মাত্র আব্বার হাতের ও চোখের বাঁধন খোলে দেওয়া হল। আব্বা দেখেন ফেরেশতার মত সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের এম, এল, এ, ইনাম উল্লা। আব্বা আর উনি ছিলেন চাচা ভাতিজার মত সম্পর্ক। সপ্তাহে কম হলে ১/২ দিন উনি আমাদের বাসায় আসতেন জীপ নিয়ে। আমাদের উত্তর কলিমাবাদের সোনাই মিয়া ছিলেন উনার জীপের ড্রাইভার। প্রতিদিন সন্ধায় আমাদের বাসায় আব্বার বন্ধুদের বিরাট আড্ডা বসতো। শহরের নেতা ব্যবসায়ী অনেকেই এবং কিছু সরকারি অফিসারও আসতেন এই আড্ডায়। জমিয়ে চলতো চা নাস্তা পান, খাওয়া দাওয়া আর হুক্কা টানা। এই আড্ডার সব চেয়ে জনপ্রিয় ছিল হুক্কা টানা । হুক্কার লম্বা নল ধরে টানতে টানতে চলতো বিভিন্ন বিষয়ে অনেক গভীর আলাপ আলোচনা। আব্বা উনাকে দেখে খুশিতে একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। বেঁচে আছেন যে বিশ্বাস হচ্ছেনা। উনি এক মুহুর্ত দেরি না করে আব্বাকে জীপে তোলে তাড়াতাড়ি সার্কিট হাউস ত্যাগ করে বাসায় পৌছে দিয়ে আসলেন। যাতে নতুন কোন সমস্যা না হয়, বা পাকিস্তানি আর্মিরা তাদের মত বদল করে আব্বাকে আবার আটকে ফেলে।
আব্বা হতভম্ব হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছেন সাড়া শরীর অবসন্ন ক্লান্ত, চলার শক্তি নেই। বেঁচে থাকার অফুরন্ত আনন্দে বিধ্বস্ত অবসন্ন ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়েও মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। সন্ধা নামার পুর্বেই আব্বা কলিমাবাদের বাসা থেকে আশ্রাকাপনে নানার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়াদেন। উদ্দেশ্য পরিবারের সবার সাথে আত্মীয় স্বজন শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে বেঁচে যাওয়ার আনন্দকে ভাগ করে নিতে । সাধারন কাজের মানুষের ছদ্মবেশে রওনা দিলেন নিরবে অতি সন্তর্পণে ।
তথ্য সংগ্রহ : – এই ঘটনার ভিকটিম ও সাক্ষী মহিব উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, মৌলবীবাজার মহকুমা ছাত্রলীগের সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা সুইডেন প্রবাসী এ, কে, সুজাউল করিম, বীর মুক্তিযোদ্ধা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মোহাম্মদ চৌধুরী রানার নিজ হাতে লিখা মন্তব্য।
মন্তব্য করুন