মেধাবীদের দেশত্যাগ, দেশ হারাচ্ছে উন্নত মানবসম্পদ
সাবিনা ইয়াছমিন॥ দেশে উচচ শিক্ষিতদের বেকার হার ক্রমেই বাড়ছে। বলা হয় যে যত বেশি শিক্ষিত তার চাকুরী পাওয়ার সম্ভাবনা তত কম। সেই ভাবনা থেকেই হয়ত দেশ থেকে মেধাবীদের একটা বড় অংশ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। আমি অবাক হচ্ছি যেছাত্রটিকে ১ বছর আগেও ভাল ফল করবে এই আশায় খুব যত্ন করে পড়িয়েছি ক দিন পরেই শুনি সে প্রবাসে। আমার এক নিকটাত্মীয় বুয়েট থেকে পাশ করে গত বিসিএসে তথ্য ক্যাডারে তার চাকুরী হয়েছে কিন্তু সবাইকে অবাক করে তার সিদ্ধান্ত সে দেশে থাকবেনা বিদেশ চলে যাবে! এভাবেই দেশ হারাচ্ছে আমাদের জাতীয় সম্পদ তথা মানব সম্পদ।
বিশ্বের বৃহত্তম ভিসা আউটসোর্সিং ভিএফএস এবং অন্যান্য সূত্রে প্রকাশ, বাংলাদেশ হতে সাম্প্রতিক সময়ে ভিসা আবেদন বেড়েছে প্রায় ১৭০ শতাংশ, যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেকগুণ বেশি, যার সিংহভাগ স্টুডেন্ট ভিসার। অন্যদিকে ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে ২শ’টিরও বেশি দেশ থেকে ৯ লাখ ৪৮ হাজার ৫১৯ জন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় যার ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বর্তমানে স্টুডেন্ট ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে। এভাবে প্রতিদিনই দেশ ছাড়ছে তরুণ মেধাবীরা, যারা আর দেশে ফিরে আসছে না।
দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, গণিত ও প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অন্যতম গন্তব্য যুক্তরাজ্য। একসময় কেবল ধনী পরিবার, বড় ব্যবসায়ী, মন্ত্রী-মিনিস্টার আর আমলা-পুত্র-কন্যারাই বিদেশে পড়াশোনার চেষ্টা করতেন। কিন্তু বর্তমানে দেশে কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে না পেয়ে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত অভিভাবকরাও ছেলে-মেয়েদের ধারদেনা করে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ফলে এখন মধ্যবিত্ত তো বটেই, সাধারণ গরিব ঘরের; এমনকি কৃষক পরিবারের সন্তানরাও উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন। বিষয়টি অনেকেই পজিটিভলি দেখলেও সুদূরপ্রসারী দেশ ভেতর ভেতর নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। কারণ এ সকল মানবসম্পদ আর দেশে আসবে না বললেই চলে। এক হিসাবে দেখা গেছে, এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে প্রতি বছর গড়ে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে দেশ। রাষ্ট্র এসব ব্যয় জনগণের টাকা থেকে ব্যয় করে, কিন্তু মেধাবীরা অন্য দেশে গিয়ে দেশের জন্য তেমন কোনো অবদানই রাখতে পারেন না।
এক হিসাবে দেখা যায়, বুয়েট থেকে প্রতি বছর যে শিক্ষার্থীরা বের হচ্ছেন, তাদের শতকরা ৮০ ভাগই কোনো না কোনো পর্যায়ে বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছেন। বুয়েট বিশ্বে পরিচিত হওয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থীই উন্নত দেশে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ছুটছেন। এভাবেই পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের মেধা। মেধাবী এসব শিক্ষার্থী অনেক ক্ষেত্রেই সফল হচ্ছেন বাইরের দেশে। তৈরি করছেন নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র। অধিকাংশই আর ফিরছেন না দেশে। বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের কার্যালয় ও অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬-এর ব্যাচে মোট শিক্ষার্থী ছিলেন ৩১ জন। তাদের ২৫ জনই এখন বিদেশে। একই বিভাগের ১৯৯৪-এর ব্যাচের ৪৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ জন রয়েছেন দেশের বাইরে। ১৯৯৮-এর ব্যাচের ৬৫ জনের মধ্যে ৩০ জনই প্রবাসী। ইন্টেল, ইয়াহু, গুগল, মাইক্রোসফট, আইবিএম, নোকিয়ার মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন তাদের অনেকেই। এমনকি ইন্টেলের বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যান বাংলাদেশের বুয়েট পাশ করা ওমর ইশরাক। বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম সম্প্রতি বুয়েটের মেধা পাচার নিয়ে একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সেখানে বলা হয়, বুয়েট থেকে পাস করার পর শিক্ষার্থীদের ৮০ ভাগ বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়সাপেক্ষে বিদেশ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ভাড়া করে আনছে।
ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পলিসি-২০১০ (সংশোধিত)-এ বলা হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকার বেশ কয়েকটি কারণের অন্যতম ‘মেধা পাচার’ প্রবণতা। এতে বলা হয়, দেশে বিজ্ঞান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্র সীমিত। ফলে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখার আগ্রহ কমছে। দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব ও মেধার স্বীকৃতি না দেওয়ায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশে থাকছেন না। দেশে একটি মিডিয়ার জরিপেও দেখা গেছে যে বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ তরুণই উদ্বিগ্ন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে তারা নানা ধরনের অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। জরিপ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল পরিষ্কারভাবেই জানান দেয় যে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম তেমন একটা ভালো নেই এ দেশে। তরুণরাই যখন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত, তখন তা আমাদের একটি বার্তা দেয়; আর তা হলো দেশের জন্য অপেক্ষা করছে হতাশাজনক একটি সময়। মেধার কদর না করতে পারলে একদিন এ জাতির মধ্যে হয়তো মেধাবী জন্ম নেয়াই বন্ধ হয়ে যাবে।
আগে স্কুলপড়ুয়া শিশুদের যখন প্রশ্ন করা হতো, তারা ভবিষ্যতে কী হতে চায়, তারা নির্দ্বিধায় উত্তর দিত, ‘ডাক্তার হব, ইঞ্জিনিয়ার হব, শিক্ষক কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট হব।’ কেউ কেউ সাহস করে বলে বসত, ‘পাইলট হব, প্লেন চালাব।’ কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েদের প্রশ্ন করলে তাদের অর্ধেকের বেশি যে উত্তর দেয়, তা তাদের দেশের বাইরে ভবিষ্যৎ গড়ারই ইঙ্গিত দেয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ুয়া প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থীই উত্তর দেয়, ‘এ’ লেভেল শেষ করে দেশের বাইরে যাবে। আর বাংলা মাধ্যমে পড়ুয়ারা প্রায়ই বলে, ‘অনার্স শেষ করে দেশের বাইরে গিয়ে মাস্টার্স করব। তারপর ওই দেশে সুবিধা করতে পারলে দেশে আর ফিরব না।’ কী ভয়াবহ এক অবস্থা অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য। আগে চাকরির ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীদের প্রথম পছন্দ ছিল বিসিএস। প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার জন্য একবুক স্বপ্ন নিয়ে প্রচুর ছেলেমেয়ে অবতীর্ণ হতেন বিসিএস পরীক্ষায়। কিন্তু এখন অনেক ছেলেমেয়ে ক্যারিয়ার গড়তে বিসিএসের কথা ও ভাবেন না। কারণ তাদের অনেকেরই ধারণা বিসিএসে যোগদান করে সৎ থাকা যাবে না। আবার যারা বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছেন, তাদেরও মেলাতে হচ্ছে কোটার জটিল সমীকরণ। তরুণদের অর্ধেকের বেশি মনে করেন, তাদের স্বপ্ন আর প্রত্যাশা নিয়ে ভাবেন না দেশের নীতিনির্ধারকরা।
তারা উৎকণ্ঠিত নীতিনির্ধারকদের বৈষম্যমূলক নীতিনির্ধারণ নিয়ে। সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এপ্লয়মেন্ট রিসার্চ (সিডার) ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শিরোনামে যে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে বেরিয়ে আসে যার শিক্ষাগত যোগ্যতা যত বেশি, তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তত কম। প্রতিবেদনটি যেসব তরুণ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে চান, তাদের জন্য এক হতাশাজনক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। এ ধরনের নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত তরুণ প্রজন্ম হতাশা থেকে বাঁচতে নিচ্ছেন দেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত। বৈধ বা অবৈধ যেকোনো প্রকারে হোক তারা পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে।
একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ থেকে পাশ করা একজন জানান, ১৪-১৫ বছর চাকরি করেও আমরা যে বেতন এবং সুবিধা পাই আমাদের সাথে যারা দেশত্যাগ করেছিল, তারা সবাই এখন অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পায়। বুয়েট, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে দেশের বাছাই করা মেধাবীরা ভর্তি হয়। তাদের দেশের কাজে লাগানো জরুরি। মেধা পাচার রোধে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া উচিত। বুয়েটের অনেক ছাত্রই এখন বিভিন্ন দেশের বিশ্বস্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। দেশেও তাদের কাজে লাগানো যেত। এজন্য যথাযথ নীতিমালা দরকার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২৫তম বিসিএসের এক কর্মকর্তা জানান, আমরা অনেক আশা নিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেছিলাম। কিন্তু মূল্যায়নের সব কিছুতেই দলীয় বিবেচনা পুরো দেশটিকে শেষ করে দিয়েছে। যত মেধাবীই আপনি হোন না কেন, সংশ্লিষ্ট দলীয় লোক না হলে কোনো মূল্যায়ন নেই। মেধাবীকে মেধা দিয়ে মূল্যায়ন করলেই দেশ এগিয়ে যাবে। মেধা পাচার রোধে সর্বপ্রথমে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে মেধাবীদের মূল্যায়ন, গবেষণা খাতে অর্থের বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ, শিক্ষাক্ষেত্রে আধিপত্যের রাজনীতি দূরীকরণ, শিক্ষার মান্নোয়নে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ এবং ভালো বেতনের নিশ্চয়তা, তাদের সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়া।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে বিভিন্ন দেশ মেধাবীদের মূল্যায়ন করে তাদের দেশের মেধা পাচার রোধ করেছে। তার মধ্যে চীন, ভারত, তুরস্ক, ইরানসহ বিভিন্ন দেশ অন্যতম। তারা মেধাবী তরুণদের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দক্ষ করে তুলছে, সেসব মেধাবী তরুণ নিজ দেশে গিয়ে তাদের সকল প্রকার ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করছেন। ফলে তাদের ব্রেইন ড্রেন হচ্ছে না; উল্টো তাদের ব্রেইন গেইন হচ্ছে। তাই আমাদের দেশেও ব্রেইন ড্রেন না করে এমন সুযোগ কাজে লাগিয়ে উন্নত দেশগুলো থেকে দক্ষতা অর্জন করে এসে তরুণরা নিজের দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে পারে। আমরা দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে তাকালে দেখি, তারা তাদের মেধাবীদের ফিরিয়ে আনতে ব্রেন কোরিয়া (বিকে-২১) প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় তারা গবেষণা ও শিক্ষা প্রোগ্রামের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের তারা উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বৃত্তি প্রদান করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে প্রবাসী ভারতীয় কমিম্পউটার বিশেষজ্ঞদের সাহায্য চেয়েছিলেন। তাদের যথাযথভাবে মূল্যায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যাঙ্গালোরে প্রতিষ্ঠা করেন কম্পিউটার পল্লী। যার মাধ্যমে ভারত এখন কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। ভারতের আরেক শিল্পপতি বিড়লার উদাহরণ তুলে ধরা প্রয়োজন। তিনি হার্টের চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন লন্ডনে। চিকিৎসা নিতে গিয়ে দেখলেন ডাক্তারদের অধিকাংশই ভারতীয়। তিনি উপলব্ধি করলেন এসব চিকিৎসকরা যদি ভারতেই থাকতেন, তাহলে এত দূরে তাকে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য আসতে হতো না। সুস্থ হয়ে তিনি ভারতীয় চিকিৎসকদের দাওয়াত করলেন। এসব ডাক্তারকে কলকাতায় অনুরূপ একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুরোধ করলেন। বিড়লা আশ্বস্ত করলেন, লন্ডনের প্রাপ্ত সুবিধা কলকাতাতেই এসব চিকিৎসা দেয়া হবে। বিড়লার সেই পদক্ষেপ হয়েছে সফল। এখন পৃথিবীর বহু দেশ থেকে হার্টের রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন কলকাতার এই বিড়লা হাসপাতালে। এতে বোঝা যায়, কাজের স্বীকৃতি, সুযোগ-সুবিধা, গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করলে মেধাবীদেরও দেশে ধরে রেখে কাজে লাগানো সম্ভব। আমাদের দেশে মেধা পাচার রোধে উল্লেখিত কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের দেশকে উন্নত দেশ গড়ে তুলতে মেধাবীদের মনে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। সর্বোপরি সরকারের নানামুখী যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করার মাধ্যমে অনেকাংশেই মেধা পাচার রোধ করা সম্ভব। তারুণ্যের দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বছরের নিচে। ত্রিশকেও যদি ধরা হয় তরুণ, তাহলে বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষই তরুণ। এত বিপুল তরুণ প্রজন্ম বিশ্বের খুব কম দেশেরই আছে। তাই সময় থাকতে আমাদের বিপুল সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে বিদেশমুখিতা বন্ধ করে দেশে কাজে লাগাতে পারলে এ দেশ উন্নতদেশে পরিণত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিজ্ঞানের অগ্রগতির এ যুগে যখন বিশ্বের অনেক দেশই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে এবং বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন প্রণোদনা বৃদ্ধিসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে, তখন আমাদের দেশ বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাতে পারছে না। সৃজনশীল গবেষণা খাতে নেই কাংখিত মাত্রায় বরাদ্দ। ফলে ঘটছে অনিবার্য মেধা পাচার।
বাংলাদেশের মতো উদীয়মান একটি মুসলিম দেশ থেকে মেধা পাচার প্রসঙ্গে খ্যাতিমান ইসলামিক চিন্তাবিদগণ বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলোয় বিপুল তরুণ প্রজন্ম থাকলেও যথাযথ পরিকল্পনা আর দূরদর্শিতার অভাবে আজো মুসলিম জাতি পিছিয়ে রয়েছে। তাদের মতে, বিশ্বের দুই শতাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে মুসলিম রাষ্ট্র সংখ্যা এক-চতুর্থাংশের অধিক আর মুসলমানের সংখ্যাও বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চুতর্থাংশ। প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকেও মুসলিম বিশ্ব সমৃদ্ধ। তেল রফতানিকারক দেশের সংস্থা ওপেকভুক্ত ১২টি দেশে তেল রয়েছে ৮১ শতাংশ এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই রয়েছে ৬৬ শতাংশ। গ্যাস মজুদের দিক দিয়ে বিশ্বের প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে ছয়টিই মুসলিম দেশ। এভাবে স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, জিঙ্ক থেকে শুরু করে অনেক ধাতব ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলো। জিডিপির দিক থেকেও বিশে^র প্রথম ৬০টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৫টি মুসলিম দেশ। জনসংখ্যা, রাষ্ট্র সংখ্যা এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান ওয়ার্ল্ড অর্ডার তথা বিশ্ব ব্যবস্থায় মুসলিম দেশগুলোর তেমন অবস্থান নেই। শুধু রাজনৈতিকভাবেই পিছিয়ে পড়ছে না, অর্থনৈতিকভাবেও মুসলিম দেশগুলো দুর্বল। এর অনেকগুলো কারণের মাঝে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা তথা মেধা পাচার অন্যতম। মুসলিম দেশগুলো থেকে বিভিন্ন কারণে পাশ্চাত্যে তথা উন্নত দেশগুলোয় মেধা পাচার বস্তুত পাশ্চাত্যের আর এক গভীর ষড়যন্ত্র। মুসলিম দেশের নেতৃত্ব ও মুসলিম যুবকরা এ ষড়যন্ত্রের শিকার। পাশ্চাত্য তথা উন্নত দেশগুলো তাদের দেশগুলো নিয়ে এমন প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে যে, বিশ্বে তাদের দেশগুলো যেন স্বর্গরাজ্য। এভাবে দেখা গেছে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আর মুসলিম থাকছে না। এই অবস্থার অবসানের জন্য প্রয়োজন মেধাবীদের যথাযথ মুল্যায়ন নিশ্চিত করে তাদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উন্নত করা, বিদেশের পরামর্শক আনা বন্ধ করে দেশীয় মুদ্রা রক্ষা করা। সর্বোপরি ৩০ লাখ লোকের জীবন আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মর্যাদাকে বিশ্ব দরবারে উচু করে তুলে ধরা।
লেখক : মোছাঃ সাবিনা ইয়াছমিন, প্রভাষক (ইংরেজি) এম এ গনি আদর্শ কলেজ, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার।
মন্তব্য করুন