মো. মোবারক হোসেন: নবীন-প্রবীণের সেতুবন্ধন
সায়েক আহমদ॥ তারুণ্যের দীপ্ত আলোয় উদ্ভাসিত মনটা তখন চ্যালেঞ্জ গ্রহণে বদ্ধ পরিকর। অনেকটা সখের বশে ১৯৮৯ সালে কানিহাটি বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলাম। তারপর সে সখ রূপান্তরিত হল নেশায়। শিক্ষকতা পেশায় পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করার মানসে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব এডুকেশন ডিগ্রী ঝুলিতে ভরে নিলাম। সিলেট বিভাগের মুখ উজ্জ্বল করে এবং সবাইকে চমকে দিয়েই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। কাজেই বিভিন্ন স্কুলে যোগদান করার জন্য লোভনীয় অফার আসতে থাকলেও স্থানীয় হাজী মো. উস্তওয়ার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলাম। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৯২ সালের ১৫ আগষ্ট শমশেরনগর এএটিএম বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ের সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলাম। ইতোমধ্যে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে উচ্চতর গণিতের পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েও সবাইকে চমকে দিয়েছি। কারণ তখন সিলেট বিভাগে হাতে গোণা ৫/৬ জন মাত্র উচ্চতর গণিতের পরীক্ষক ছিলেন।
তৎকালীন সময়ে কমলগঞ্জ উপজেলার একমাত্র এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল কমলগঞ্জ বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়। প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মো. মোবারক হোসেন। হঠাৎ তার সাথে দেখা করার জন্য তিনি আমার কাছে খবর পাঠালেন। তখন মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করায় জেলা-উপজেলার বিভিন্ন স্কুলে বিশেষ পরিচিতি অর্জন করেছিলাম। ভেবেছিলাম সম্ভবত শিক্ষক সমিতির প্রয়োজনে আলোচনা করার জন্য খবর পাঠিয়েছেন। যথাসময়ে তার সাথে দেখা করলাম। শিক্ষক সমিতির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় শলা-পরামর্শ করার পর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি তো উচ্চতর গণিতের পরীক্ষক?’
আমি হেসে উত্তর দিলাম, ‘জ্বী।’
তিনি বললেন, ‘আমি শুনেছি তুমি নাকি উচ্চতর গণিতের পরীক্ষক?’
আমি বললাম, ‘সঠিক শুনেছেন।’
সাথে সাথে তিনি বললেন, ‘তোমার তো যথেষ্ট সাহস আছে। সিলেট বিভাগেই তো উচ্চতর গণিতের পরীক্ষক খুঁজে পাওয়া যায় না।’
আমি বললাম, ‘আমিও চিন্তা করিনি কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে উচ্চতর গণিতের পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাব।’
মোবারক হোসেন বললেন, ‘তুমি তো কুমিল্লা থেকেই বিএড করেছো, ভাল ফলাফল করেছো। কাজেই তারা তোমাকে গুরুত্ব দেবে এটাই স্বাভাবিক। আমিও খুব খুশি হয়েছি। তবে এবার তোমাকে একটা বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হবে?’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী দায়িত্ব?’
তিনি বললেন, ‘তোমাকে বিজ্ঞান-১ম পত্র ব্যবহারিক পরীক্ষার বহিঃপরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
প্রস্তাবটি পেয়ে আমি খুবই অবাক হলাম। কারণ মৌলভীবাজার জেলা তথা সিলেট বিভাগে তৎকালীন সময়ে তরুণ এক্সটার্নেলের কথা চিন্তাই করা যেত না। কমলগঞ্জ পরীক্ষাকেন্দ্রেও ইন্টারনেল-এক্সটার্নেলরা ছিলেন প্রবীণ শিক্ষকরা। সবাই আমাদের শিক্ষক অথবা শিক্ষকতুল্য। আমি সে কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘সময় বদলাচ্ছে। এখন তো তোমাদেরকেই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। পুরাতনরা বিদায় নেবেন, এটাই স্বাভাবিক।’
প্রধান শিক্ষক মো. মোবারক হোসেনের মন-মানসিকতা তখনই আমার কাছে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। আমি উপলব্ধি করলাম তিনি নবীন-প্রবীণের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রচনা করতে চাইছেন। তাঁর অগ্রসর চিন্তা-চেতনায় আমি অবাক হয়েছিলাম। তবে এর প্রতিফলনও ঘটেছিল কমলগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে। প্রবীণ এবং নবীন শিক্ষকবৃন্দের কাছে তিনি সমভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন।
পতনঊষার উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ের শিক্ষক দুরূদ আহমদকেও তিনি আমার মত বহিঃপরীক্ষকের দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। তাঁর এ বিচক্ষণতা তাঁেক উক্ত সময়ে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমি এবং দুরূদ তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপেই তাঁকে নিঃশর্ত সহযোগিতা করায় তিনিও মানসিকভাবে অনেক শক্তি অর্জন করেছিলেন।
ব্যবহারিক পরীক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হল। আন্তঃপরীক্ষক হিসেবে প্রবীণ শিক্ষকরাই রয়ে গিয়েছিলেন। তারা সারাজীবন শিক্ষার্থীদেরকে নম্বর প্রদান করতে পুরাতন মন-মানসিকতাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইতেন। এ কারণে তাদের নম্বর প্রদানে বিরাট কার্পণ্য ছিল। তারা ব্যবহারিক পরীক্ষায় কোন শিক্ষার্থীকেই ২৫ নম্বর দিতে রাজী ছিলেন না। হাতে গোণা কয়েকজনকে ২৪ অথবা ২৩ নম্বর দিতেন, তাও অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর। ব্যবহারিক পরীক্ষায় পাশ নম্বর ছিল ৮। কাজেই শিক্ষার্থীরা কী পরিমাণ নম্বর পেত তা পুরাতন শিক্ষার্থীরাই বলতে পারবে। আমিও শিক্ষাজীবনে এ পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম। মাত্র ২/৩ নম্বর কম পেলেই যেখানে লেটার মার্ক (বর্তমান এ+) পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার, সেখানে তো বিজ্ঞান বিষয়ের মার্কগুলো ব্যবহারিক পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার কারণে ৭০ এরও নিচে নেমে যেত। আমি ইতোপূর্বে এসএসসি পরীক্ষার উচ্চতর গণিত বিষয়ে প্রচুর পরীক্ষার্থীকে পূর্ণ ১০০ (আগে উচ্চতর গণিত বিষয়ে ব্যবহারিক এবং বহুনির্বাচনী অংশ ছিল না।) নম্বর দিয়েছিলাম। তা দেখে আমারই সম্মানিত শিক্ষকরা আতংকিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা আশংকা করেছিলেন কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে এত অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীকে পূর্ণ ১০০ নম্বর দেয়ায় অবশ্যই আমার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কারণ তৎকালীন সময়ে প্রবীণ শিক্ষকদের নিকট হতে নম্বর আদায় করে নেয়াটা ছিল ভয়াবহ কঠিন ব্যাপার। অধিকাংশ শিক্ষকই যত ভাল শিক্ষার্থীই হোক তাকে পূর্ণ ১০০ নম্বর না দিয়ে ৯৯ নম্বর দেয়াটাই কৃতিত্বের মনে করতেন। যাক যথাসময়ে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পরও আমার বিরুদ্ধে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সবাই বরং অবাকই হয়েছিলেন। তবে নাম্বার প্রদানের ক্ষেত্রে আমার আত্মবিশ্বাসটা বরং আরো জোরদার হয়েছিল। সেই আত্মবিশ্বাস থেকেই আমি অর্ধেক শিক্ষার্থীকে ব্যবহারিক পরীক্ষায় পূর্ণ ২৫ নম্বর দিয়ে বসলাম। ব্যস, সাথে সাথেই তুলকালাম কাণ্ড সৃষ্টি হয়ে গেল। প্রবীণ শিক্ষকরা অভিযোগ করলেন শুধুমাত্র এ কারণে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রয়োজনে পরীক্ষাকেন্দ্রও বাতিল করতে পারেন। ঠিক ঐ মুহূর্তে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে এলেন প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব মো. মোবারক হোসেন। তিনি একজন দক্ষ বিচারকের মত রায় দিলেন, ‘যদি কোন সমস্যার সৃষ্টি হয় সে দায় নেবো আমি, সায়েক এবং দুরূদ। আপনাদের চিন্তার কিছু নেই।’ দুরূদ আহমদও আমার সাথে পরামর্শ করে একই রকম নম্বর দিয়েছিল। মোবারক সাহেবের ঐ সময়ের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে আজ হাজার হাজার এসএসসি পরীক্ষার্থী সে সুফল তুলে নিচ্ছে। গবেষণা করলেই দেখা যাবে, এসএসসি পরীক্ষার জিপিএ ফাইভের ৬০% ই আসে ব্যবহারিক পরীক্ষায় পূর্ণ নম্বর পাবার সুবাদে। কারণ অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ব্যবহারিকসহ ৮০, ৮১, ৮২, ৮৩ কিংবা ৮৪ নম্বর পেয়ে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিতে এ+ অর্জন করে থাকে। ১ বা ২ নম্বর কম পেলেই তাদের মধ্যে অনেকেই ৭৯ নম্বর পেয়ে এ+ অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হয়। তৎকালীন সময়ে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের পরিবর্তে বিজ্ঞান-১ম পত্র ও বিজ্ঞান-২য় পত্র বিষয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হত।
মরহুম মো. মোবারক হোসেন কমলগঞ্জ উপজেলার নারাযণপুর গ্রামে ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম শুকুর মোহাম্মদ ছিলেন গ্রামের জনপ্রিয় সালিশ বিচারক। পিতার পদাংক অনুসরণ করে তিনিও সালিশ বিচারে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যে কোন সমস্যার সৃষ্টি হলেই মোবারক হোসেনের কাছে ছুটে যেত সবাই। সমস্যাটি সমাধান হলেই তবে শান্তি মিলত। মরহুম মোবারক হোসেনের মাতা মোছাম্মৎ হাফিজা খাতুন ছিলেন একজন সুগৃহিণী।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মোবারক হোসেন নিজ এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাঠশালা পাশ করেন। কমলগঞ্জ বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ থেকে মুখ এইচএসসি ও বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এজন্য তিনি এলাকায় ‘বিএসসি স্যার’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি বিএড পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন।
মরহুম মো. মোবারক হোসেন ১৯৬৯ সালে কমলগঞ্জ বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি একই বিদ্যালয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। অতঃপর ১৯৯৫ সালে তিনি কমলগঞ্জ বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বিদ্যালয়কে একটি আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। কর্মদক্ষতা ও সুযোগ্য নেতৃত্বের দ্বারা তিনি বিদ্যালয়টিকে মডেল উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। একই ধারাবাহিকতায় বিদ্যালয়টি এখন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়ায় এলাকার শিক্ষার্থীরা এর সুফল ভোগ করছে।
শিক্ষকতা জীবনে মরহুম মোবারক হোসেন বিভিন্ন বিভাগে তাঁর দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। কমলগঞ্জ উপজেলা স্কাউট কমিশনার হিসেবে তিনি উপজেলার স্কাউট দলকে বিশেষ উচ্চতায় উন্নীত করেছিলেন। কমলগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবেও তিনি দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। সিলেট বিভাগের একমাত্র গণমহাবিদ্যালয়ে (বর্তমানে কমলগঞ্জ সরকারি গণমহাবিদ্যালয়) সহ-সভাপতির দায়িত্ব সুচারূরুপে সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া এলাকার সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করাটা তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছিল। তিনি নারায়নপুর মসজিদ কমিটির মোতাওয়াল্লী এবং নারায়নপুর ওয়াজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবেও যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। কমলগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী নজরনা ট্রাস্টের সদস্য হিসেবেও তিনি সমাজসেবামূলক কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। প্রায় ৪১ বছর শিক্ষকতা করার পর ২০১০ সালে তাঁর সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ইতোমধ্যে স্ট্রোকসহ নানাবিধ অসুস্থায়ও ভূগছিলেন। অবশেষে ২০১৪ সালের ১৪ মার্চ এ প্রচারবিমুখ ব্যক্তিত্ব মৃত্যুবরণ করেন।
মরহুম মো. মোবারক হোসেনের সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পরবর্তীতে ২০০০ সালে আমিও প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। রাজনগর উপজেলায় তখন একটিমাত্র পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল। রাজনগর পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমিও কেন্দ্র সচিব হলাম। তারপরও তাঁর সাথে সম্পর্ক অক্ষুন্ন ছিলো। রাজনগর পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সংবাদ পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। বিভিন্ন দায়িত্ব গ্রহণে আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন। তখন শ্রীমঙ্গলেও একটিমাত্র পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল। সে পরীক্ষাকেন্দ্রের কেন্দ্র সচিব ছিলেন শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মরহুম আব্দুন নূর। পরস্পরের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকার সুবাদে আমরা তিনজন মিলে কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল-রাজনগর এ তিন কেন্দ্রের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করেছিলাম। আমরা এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র কমিটির সভায় সিলেট শিক্ষাবোর্ডে একসাথে যাওয়া আসা করতাম। পরীক্ষার উত্তরপত্র গ্রহণ থেকে শুরু করে উত্তরপত্র জমাদান করার কাজটিও আমরা একসাথে করতাম। একটি মিনিবাস নিয়ে আমরা তিন পরীক্ষাকেন্দ্রের কেন্দ্রসচিব কর্মচারীসহ যাত্রা করতাম। আমার বাসা ছিল তখন মৌলভীবাজার। যাবার সময় নূর সাহেব শ্রীমঙ্গল থেকে একটি মিনিবাস নিয়ে কমলগঞ্জ চলে যেতেন। সেখান থেকে মোবারক সাহেবকে নিয়ে মৌলভীবাজার চলে আসতেন। মৌলভীবাজার থেকে আমি তাদের সঙ্গী হতাম। বেশিরভাগ সময় আমার বাসায় নাস্তা করে সবাই সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হতাম। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার কাজ শিক্ষাবোর্ডেই সারা হয়ে যেত। আসার সময় আমরা রাজনগর হয়ে আসতাম। প্রথমে রাজনগরে আমার কেন্দ্রের মালামাল নামিয়ে তাদের সাথে আমি চলে আসতাম মৌলভীবাজার। আবার আমার বাসায় সংক্ষিপ্ত চা-চক্রের পর্ব শেষ করে আমি তাদেরকে বিদায় জানাতাম। সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে আমি তাদের বাসায় গিয়ে তাদের সাথে দেখা করে আসতাম।
আজ নূর সাহেবও নেই, মোবারক সাহেবও নেই। তবে তাদের অসংখ্য স্মৃতি আমার মনে খুব কষ্ট দেয়। সে সময়ে আমাদের মধ্যে যে আন্তরিক সম্পর্ক বিরাজমান ছিল তা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি বয়সে তাদের চেয়ে অনেক ছোট হলেও তাঁরা কখনো আমাকে ছোট হিসেবে দেখেননি। আমাকে বন্ধু হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে সর্বদা সঙ্গ দিয়ে গেছেন।
কমলগঞ্জ উপজেলায় বিজ্ঞ, দক্ষ, যোগ্য, অভিজ্ঞ, মেধাবী ও তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়ার গুণসম্পন্ন যে কয়জন প্রতিষ্ঠান প্রধান ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মরহুম মো. মোবারক হোসেন। তাঁর ছেলেমেয়েদের সাথেও আমার বেশ অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে লাভলী এবং শায়েকের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি ছিল। লাভলীর স্বামী মো. সলমান আলীকে আমিই প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলাম এবং হাবিবুর রহমান জুনিয়র হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলাম। তাদের বিয়ের ব্যাপারেও আমার নেপথ্য ভূমিকা ছিল। কারণ বিয়ের আগেই মোবারক সাহেব আমাকে বারবার ফোন করে বিয়ের ব্যাপারে মতামত জানতে চাইছিলেন। সলমানের সাথেও আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার কারণে আমি তাকে বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিলাম। তাঁর ছেলে শায়েকের সাথে আমার নামের মিল থাকায় ছেলেটিকে আমি খুবই পছন্দ করতাম। সে বর্তমানে সুনামের সাথে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করে পিতার স্বপ্ন পূরণ করছে। কিছুদিন আগে মোবারক হোসেনের পক্ষ থেকে করোনা মহামারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্থ অসহায় পরিবারকে সহায়তা করার সংবাদ ফেসবুক এবং পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম। যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তানরা এখনো পিতার পদাংক অনুসরণ করে সমাজসেবায় নিয়োজিত আছে, এর চেয়ে বড় সুসংবাদ আর কি হতে পারে?
মরহুম মো. মোবারক হোসেনের মৃত্যুর পর তাঁর শূণ্যতা এখনো পূরণ হয়নি। একটি পরীক্ষাকেন্দ্র ভেঙ্গে চারটি পরীক্ষাকেন্দ্রে বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু তার কথা মনে হলেই আমার অবিভক্ত পরীক্ষাকেন্দ্রটির কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ে ব্যবহারিক পরীক্ষার আধুনিকায়নে তার সেই দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কথা। তিনি সে সময়েই বুঝতে পেরেছিলেন বিপ্লব ঘটাতে হলে অবশ্যই নবীন শিক্ষকদের সাথে প্রবীণ শিক্ষকদের একটি মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। সেই সেতুবন্ধন তৈরি করার কাজ তিনি সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে বেহেশত নসীব করুন।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন