মৌলভীবাজারভূতের বাড়ি রেস্টুরেন্ট
May 28, 2020,
সায়েকা আহমদ॥
এক
গ্রীষ্মের বন্ধে আমরা বড় মামার বাসায় বেড়াতে যাব। সবার মামাবাড়ি থাকে গ্রামে। আমারটা উল্টো। আমার মামা ঢাকায় চাকরি করেন। বাসা গোলাপবাগ পুলিশ কোয়ার্টারে। আমাদের বাসা শ্রীমঙ্গলে। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে। শ্রীমঙ্গল হচ্ছে পর্যটন শহর, চায়ের রাজধানী। কাজেই আমাদের বাসায় শুধু মেহমান আর মেহমান। সবাই বেড়াতে আসলে আমাদের বাসায় একবার ঘুরেই যান। মেহমানদের কারণে আমরা বেড়াতে যাবার সুযোগ কমই পাই। তবে এবার মামার বাসায় বেড়াতে যাবার সুযোগ হল।
আমরা যাব রাতের ট্রেনে। রাতের ট্রেন আমার মোটেও পছন্দ নয়। কারণ রাতের বেলা কিছ্ইু দেখা যায় না। ট্রেনে বসে জানালায় নিবিষ্টমনে তাকিয়ে দৃশ্য দেখা আমার খুবই পছন্দ। ট্রেন সামনে এগিয়ে যায়। গাছপালা পেছনে দৌড়ে পালায়। কিন্তু দূরের গাছপালা এবং বাড়িঘর আমাদের সাথে সাথেই ছুটে চলে। আমার কাছে এটা বেশ অদ্ভুত লাগে। আমার বন্ধুদের কেউই এ রহস্যটুকু বুঝতে পারে না। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলল, ‘এটা ফিজিক্সের গতির ব্যাপার-স্যাপার। এসব তুমি এখন বুঝবে না। একটু বড় হলে বুঝতে পারবে।’ আমার মনে হয় সে নিজেই কিছু জানে না। এজন্য চালাকি করে আমার কথার উত্তরটা দিতে চাইল না।
আমার বাবা খুবই রাগী লোক। আবার খুবই হাসিখুশি মানুষ। একজন লোক একই সাথে রাগী এবং হাসিখুশি হয় কি করে তাও আমি বুঝি না। তবে আমাদেরকে তিনি খুবই পছন্দ করেন। ভাইয়া পড়ে মেডিক্যাল কলেজে। সে ডাকে ‘আব্বু’। কিন্তু আমি ডাকি ‘পাপা’। আমার মা আগে খুবই রাগ করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমার মেয়েটা তার বাবাকে পাপা ডাকা শিখল কোত্থেকে!’ আমিও অবাক হয়ে পাপাকে সে কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। পাপা বলেন আমি নাকি নিজে নিজেই পাপা ডাকা শিখেছি। কেউ শিখিয়ে দেয়নি।
দুই
আমাদের ট্রেন ছাড়বে রাত ১২টা ২০ মিনিটে। উপবন এক্সপ্রেস। আমি টিকেটে লিখা দেখেছি ০০:২০। আমি পাপাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, এটি নাকি টুয়েন্টি ফোর আওয়ার ফরম্যাটের সময়। দুপুর ১২টার পরে ১টা ২টা না হয়ে ১৩টা ১৪টা হতে হতে ২৩টা পর্যন্ত চলে আসে। এভাবে ২৩টা যখন শেষ হয় তখন নিয়মমত ২৪টা আসার কথা। কিন্তু ২৪টাকে ২৪:০০ না লিখে লিখা হয় ০০:০০।
আমরা সাড়ে এগারোটায় বাসা থেকে বের হলাম। মায়ের অনেকগুলো লাগেজ। আমার খুবই বিরক্ত লাগে। ট্রলি ব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ সাথে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাথে আরো কয়েকটি ব্যাগ। এগুলো নাকি বড় মামার বাসায় নেয়া হবে। বাসায় ফলানো সব্জি, কলা, চা বাগানের গাভীর খাঁটি দুধ ইত্যাদি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই থাকে সে ব্যাগগুলোতে। তবে একটি ব্যাগে থাকে হট টিফিন ক্যারিয়ার, পানির বোতল, ফ্লাক্স, গ্লাস-প্লেট ইত্যাদি। এ ব্যাগটাই শুধু আমার পছন্দ। কারণ হট টিফিন ক্যারিয়ারে থাকে মায়ের হাতের রান্না করা সুস্বাদু বিরিয়ানি, ঝালফ্রাই, মাছের কোপ্তা, ডিমভূনা সহ মজাদার সব খাবার।
তিন
বড় মামার বাসা গোলাপবাগ পুলিশ কোয়ার্টারে। বাসার সামনেই একটি অদ্ভুত রেস্টুরেন্ট। নাম ভূতের বাড়ি রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের সামনে একটি কাঁচঘেরা জায়গায় বিভিন্ন অদ্ভুত আকৃতির ভূতেরা দাঁিড়য়ে আছে। এদের লাল লাল চোখ এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে রং বেরংয়ের আলোর ঝলকানি দেখা যায়। দেখলেই গা ছমছম করে।
আমি পাপাকে বললাম, ‘পাপা, আমি ঐ রেস্টুরেন্টে যেতে চাই।’
পাপা বললেন, ‘ঠিক আছে। তোমাকে নিয়ে যাব। কিন্তু ওখানে গেলে তুমি তো ভয় পাবে মা।’
আমি বললম, ‘কেন, একদিন নাকি তুমি ভাইয়াকে নিয়ে ঐ রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু তোমার ভাইয়া তো ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিল।’
‘কেন?’
‘ভূতদেরকে দেখে ভয় পেয়েছিল।’
‘ভাইয়াটা একটু ভীতু। আমি ভাইয়ার মত ভয় পাব না।’
‘ঠিক আছে, নিয়ে যাব। কিন্তু সাবধান! তোমার ভাইয়ার মত যদি ভয়-টয় পাও তবে অনেক ঝামেলা হবে।’
‘আমি মোটেও ভয় পাব না। কারণ ভূত বলে কিছুই নাই। আর আমি ভূত থাকলেও ভূতদেরকে ভয় পাই না।’
‘আচ্ছা, তোমাকে তাহলে নিয়েই যাব। কিন্তু সমস্যা হল, তুমি তো ওখানের খাবার খেতে পারবে না।’
‘কেন?’
‘কারণ, ওখানে তো সব ভূতদের খাবার পাওয়া যায়।’
‘ভূতেরা আবার খায় নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘অদ্ভুত কথা! ভূতেরা আবার কি খায়?’
‘তাদের খাবার একটু স্পেশাল আর কি।’
‘স্পেশাল মানে?’
‘এই ধরো, তেলাপোকার চচ্চড়ি, টিকটিকি ভুনা, ব্যাঙের রোস্ট, মাকড়সার ভর্তা.. .. .. ..’
পাপা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। আমি পাপার মুখে হাত দিয়ে থামিয়ে দিলাম। কারণ, এসব খাবারের নাম শুনেই আমার বমি বমি ভাব চলে এসেছে।
আমি বললাম, ‘আমি মোটেও এসব জিনিস খাব না।’
পাপা বললেন, ‘কেন মা, রেস্টুরেন্টে গিয়ে না খেলে হয় নাকি?’
‘আমি কিছুই খাব না। শুধু দেখেই চলে আসব।’
‘তাহলে তো আমাদেরকে ভেতরে ঢুকতেই দেবে না।’
‘ঠিক আছে। একটা বুদ্ধি বের করি।’
‘কি বুদ্ধি মা?’
‘আমরা এগুলো না খেয়ে পার্সেল করে নিয়ে এসে বড়মামার মোরগগুলোকে খাইয়ে দেব।’
‘কিন্তু ওখানে তো এগুলো পার্সেল করতে দেবে না।’
‘তাহলে আমরা লুকিয়ে নিয়ে আসব। মোটেও খাব না।’
‘কিন্তু তাতো হবে না মা?’
‘কেন পাপা?’
‘ওদের বয়গুলো খুব চালাক। তুমি লুকিয়ে কিছইু আনতেই পারবে না। ওদেরকে ফাঁকি দেয়া খুব কঠিন কাজ!’
‘ওদের আবার বয়ও আছে নাকি?’
‘হ্যাঁ। ওরাও ভূত, আর তাদের চোখগুলোই তো সিসিটিভির কাজ করে।
চার
পাপার এতসব কথার পরও আমি জেদ ধরলাম রেস্টুরেন্টে যাবার জন্য। পাপা আমাকে সেদিনই বিকেলে নিয়ে গেলেন সেখানে। আমি সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় দেখি সিড়ির কোণায় কোণায় দাঁড়িয়ে আছে ভূতগুলো। ভীষণ চেহারা! তাদের চোখ এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে বিভিন্ন রংয়ের আলো জ্বলছে, নিভছে। আমার গা ছমছম করে উঠল। পাপাকে জড়িয়ে ধরে প্রাথমিক ভয়ের ধাক্কাটা সামাল দিলাম। পাপা বললেন, ‘তোমাকে তো আগেই নিষেধ করেছিলাম। এখন বুঝো ঠ্যালা!’
পাপার হাত ধরে আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম। সেখানেও দেয়ালের ভেতরে থেকে অনেকগুলো ভূত আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পাপা আমাকে নিয়ে একটি টেবিলে বসলেন। আমি ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাচ্ছি। কেমন যেন অদ্ভুত অদ্ভুত লাগছে। রেস্টুরেন্টে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। আরো মানুষজন থাকলে সাহস পেতাম।
পাপাকে বললাম, ‘আর মানুষজন কোথায়?’
পাপা বললেন, ‘আছে তো।’
‘তাহলে তারা কোথায়?’
‘এখানেই তো সবাই বসে আছে।’
‘আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন?’
‘দেখবে কিভাবে? ওরা তো সত্যিকারের ভূত?’
পাপার কথা শুনে আমি তো শিউরে উঠলাম। এমন সময় একজন বেয়ারা এগিয়ে এল। চেহারা তো মানুষের মতই দেখা যাচ্ছে!
বেয়ারা পাপাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি খাবেন স্যার?’
পাপা অর্ডার দেয়ার আগেই আমি বলে উঠলাম, ‘তেলাপোকার চচ্চড়ি, টিকটিকি ভুনা, ব্যাঙের রোস্ট, মাকড়সার ভর্তা ইত্যাদি ছাড়া অন্য কিছু থাকলে দিন।’
আমার কথা শুনে বেয়ারা তো হতভম্ব হয়ে গেল। পাপা বেয়ারাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘নাম দিয়েছো ভূতের বাড়ি রেস্টুরেন্ট। এগুলো তো থাকবেই। তবে আমার মেয়ে এগুলো খাবে না।’
সাথে সাথে আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। বেয়ারাকে দ্রুত বলে উঠলাম, ‘আংকেল, গরুর মাংস ভুনা, কবুতরের রোস্ট কিংবা মুরগীর মাংসের ঝালফ্রাই থাকলে দিন।’
বেয়ারা কিছুই বলল না। শুধু মাথা নেড়ে খাবার আনতে চলে গেল।
আমি অধীর আগ্রহে বসে রইলাম। একটু পরই ফ্রায়েড রাইসের সাথে আমার অর্ডারকৃত খাবারগুলো নিয়ে এল। আমি ভয়ে ভয়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম খাবারগুলো ঠিকই আছে।
আমার কান্ড দেখে পাপা হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘সবই ঠিক আছে মা। এটা ভূতদের রেস্টুরেন্ট নয়। মানুষের রেস্টুরেন্ট। নামটাই শুধু ভূতের বাড়ি রেস্টুরেন্ট।
পাপার কথায় আমার ভয়টা কেটে গেল। মহা আনন্দে আমি খাবারগুলো খেলাম। আসার সময় আমার মামাতো ভাই জাওয়াদ ভাইয়া এবং মামাতো বোন ঈশানার জন্য পার্সেলে করে স্পেশাল পাস্তা নিয়ে এলাম।
[সায়েকা আহমদ, ৪র্থ শ্রেণি, বিটিআরআই উচ্চ বিদ্যালয়, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার।]
মন্তব্য করুন