মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলোয় চলছে প্রুনিং কার্যক্রম
এহসান বিন মুজাহির॥ মৌলভীবাজারের চা শিল্পাঞ্চলের চা বাগানগুলোয় শুরু হয়েছে চা-গাছ ছাঁটাই কার্যক্রম। শীতকাল এলেই চা গাছ ছাঁটাই শুরু হয়। দেখা যায় সেকশনব্যাপী চা বাগানের গাছগুলোর মাথা কাটা। অসংখ্য চা গাছে এই একই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। ফলে দূর থেকে দেখা যায় পত্রশূন্য বৃক্ষের সম্মিলিত সারি। এভাবে মাথা কেটে ফেলার নাম প্রুনিং (Pruning)| বাংলায় যাকে ছাঁটাই বলা হয়। বাণিজ্যিক চায়ের গাছে এভাবেই চলে মাথা-ছাঁটাই। রবিবার ৩১ ডিসেম্বর দিনভর জেলার বিভিন্ন চা বাগানগুলো সরজমিন ঘুরে এমন চিত্র চোখে পড়ে। ফলে চা বাগানে সেই সবুজের সমারোহ এখন আর নেই। এসময় বাগানের সেকশনজুড়ে চা গাছগুলোর মাথা কেটে ছেঁটে ফেলা হয়। প্রাকৃতিক কারণে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে চা বাগানের উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে। চা গাছ ছেঁটে ফেলার এই পদ্ধতিকে বলা হয় প্রুনিং। স্থানীয় ভাষায় ছাঁটাই।
মূলত চায়ের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে এমন পদ্ধতি দেশের ১৬৭টি চা বাগানের প্রায় সবগুলোতেই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। প্রুনিং করা হয় কয়েকটি পদ্ধতিতে। এর মধ্যে চা গাছের বয়স হিসাব করে চা গাছের মাথা ছাঁটাই করা হয়ে থাকে। এছাড়া চা পাতা চয়নে সুবিধার জন্য একজন মানুষের কোমর উচ্চতায় ছাঁটাই করা হয়ে থাকে। আবার কলম করার কাজেও প্রুনিং করতে হয়। কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা যায় নতুন পদ্ধতির ছাঁটাই। পুরো চা গাছ ছাঁটাই না করে প্রতিটি চা গাছে একটি করে ডাল রেখে দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে টি-প্ল্যান্টার গোলাম মোহাম্মদ শিবলি বলেন, চা বাগানের ভাষায় প্রুনিংয়ের আরেকটি অর্থ কলম করা। এ ধরনের প্রুনিংয়ের নাম ব্রিদার। এই পদ্ধতিটি হচ্ছে মাটি থেকে যে গাছগুলো ২৪ ইঞ্চি ছাঁটাই করা হয় সে গাছগুলোতে অতিরিক্ত একটি ডাল রাখা হয়। এর উপকারিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ব্রিদারের আরেকটি অর্থ হচ্ছে শ্বাস নেওয়া। অর্থাৎ, এই ডালের ফলে চা গাছগুলো সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে সূর্যোলোক থেকে তার প্রয়োজনীয় খাদ্য-পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে। প্রুনিং রয়েছে নানা ধরনের। যেমন- কলার প্রুনিং (গলাকাটা ছাঁটাই), মিডিয়াম প্রুনিং (মধ্যম ছাঁটাই), লাইট প্রুনিং (হালকা ছাঁটাই), লো প্রুনিং (নিচু ছাঁটাই), ক্লিন প্রুনিং (পরিষ্কার ছাঁটাই)। গাছের বয়স, মাটির উর্বরতা প্রভৃতি দিক বিবেচনা করে প্রতিটি সেকশনের জন্য আলাদা আলাদা প্রুনিং নির্বাচন করা হয় বলে জানান এ অভিজ্ঞ টি-প্ল্যান্টার। মাসখানেক পর যখন বুশ থেকে (কাটা ডালগুলোর অংশ) কুঁড়ি আসতে শুরু করে তখন সেই আগে থেকে রাখা বাড়তি ডালটি কেটে ফেলা হয়। তাতে এই কম বয়সী চা গাছগুলো মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তারা পরিপূর্ণভাবে নতুন পাতা গজিয়ে বড় হওয়ার সুযোগ পায়।
চা বাগান সংশ্লিষ্টরা জানান-আগামী ২-৩ মাস সেকশনব্যাপী চা বাগানের গাছগুলোর মাথা কাটা দেখা যাবে। কয়েক মাস পর বৃষ্টি হলে আবার ফিরে আসবে প্রাণচাঞ্চল্য। দেখা মিলবে অবারিত সবুজের সমারোহ। প্রকৃতির এ সহজাত নিয়মে এসময়টিতে চা গাছের শাখায় শাখায় শুভ্র ফুল আসে। গাছে ফুল আসার কারণে চা পাতার উৎপাদন কমে যায়। বছরের এসময়টি চা গাছের মাথা প্রায় আড়াই ফুট উচ্চতায় ছেঁটে রং লাগিয়ে পলিথিন দিয়ে মাথা বেধে দেয়া হয়। এরপর ফাঙ্গাস থেকে চা গাছ রক্ষায় শৈলচূন ছিটিয়ে দেয়া হয়।
প্রুনিং করার পর চা বাগানের চিরাচরিত সবুজের প্রকৃতি ধূসর বর্ণ ধারণ করে। এরপর বৃষ্টির আগে ভাগে বাগানে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এতে করে বর্ষার শুরুতে চা গাছগুলো নতুন পত্র পল্লবীতে ছেয়ে যায়। আবার চেনা সবুজ প্রকৃতির রূপ ধারণ করে। এই চিরচারিত নিয়মের মধ্যে দিয়ে চা বাগানগুলোতে আরো এক নতুন বছরের উৎপাদনের পথে যাত্রা শুরু হয়।
বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিকদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, এক বছর পরপর আমরা প্রুনিং করি। এরপর খুব সুন্দর পাতা আসে।
শনিবার দুপুরে শ্রীমঙ্গল উপজেলার জেমস ফিনলের ভাড়াউড়া চা বাগান, বিটিআরআই চা বাগান, রাজঘাট চা বাগান, ইস্পাহানি মালিকানাধীন জেরিন চা বাগান, কমলগঞ্জ উপজেলার ন্যাশনাল টি কোম্পানিসহ, ব্যক্তি মালিকানাধীন গোবিন্দশ্রী চা বাগানের সেকশনগুলোতে প্রুনিং করার চিত্র দেখা গেছে। বিভিন্ন চা বাগানে দেখা যায় নারী-পুরুষ চা শ্রমিকরা প্রুনিং এর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে জেরিন চা বাগানের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সেলিম রেজা চৌধুরী বলেন, প্রতি বছরই নিয়মানুযায়ী ডিসেম্বরে চা উৎপাদন মৌসুম শেষে লাইট প্রুনিং বা চা গাছের মাথা ছাটাই শুরু হয় এবং মধ্য জানুয়ারির মধ্যে ‘ডিপ স্কিপ’ করে দিতে হয়। তখন চা বাগানের সেই সবুজের সমারোহ আর থাকে না। গত নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বিভিন্ন বাগানে প্রুনিং শুরু হয়েছে। কোনো বাগানে আবার জানুয়ারিতেও শুরু হবে, চলবে দুই তিন মাস। আর চা গাছে প্রুনিং মানেই হলো নতুন জীবন দান। এজন্য প্রয়োজনীয় সেচের ব্যবস্থা, মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য উপাদান প্রভৃতি বিষয়গুলো প্রুনিং পরবর্তী সময়ে নজরে রাখতে হয়। চায়ের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রুনিং করা হয়ে থাকে বলে তিনি জানান।
শ্রীমঙ্গলের ফিনলে চা কোম্পানির ভাড়াউড়া টি ডিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার গোলাম মোহাম্মদ শিবলী জানান-চায়ের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে অনেক বাগানে সেকশনজুড়ে শুরু হয়েছে প্রুনিং। আবার অনেক বাগানে জানুয়ারি থেকেও শুরু হয়। চা গাছকে দীর্ঘস্থায়ী ও সতেজ রাখতে চা গাছের ছাঁটাই করা হয়।
প্রতি বছর মার্চের শুরু থেকে প্রায় ৯ মাস চা উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু থাকলেও ডিসেম্বরে এসে তা বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক এই সময় জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাগানগুলোতে চায়ের উৎপাদনসক্ষমতা বাড়াতে আধুনিক পদ্ধতির প্রুনিং কাজ করা হয়। গাছের বয়স, মাটির উর্বরতাসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় রেখে প্রতিটি বাগানে প্রুনিং করা হয়। এরপর গাছের গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করে সার প্রয়োগ করা হয়। পরে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি পেয়ে গাছ সতেজ হয়ে কচি পাতায় ভরে ওঠে। নিয়ম অনুযায়ী, লম্বায় আট ইঞ্চি পরিমাণের পাতা জন্মালে মার্চ বা এপ্রিলে পাতা তোলা শুরু হয়।
চায়ের উৎপাদন বাড়াতে চা গাছে প্রুনিংয়ের বিকল্প কিছু নেই বলে জানিয়েছেন বাগান সংশ্লিষ্টরা। চায়ের পাতাই হচ্ছে আসল জিনিস। যত পাতা গজাবে তত ভালো। তাই প্রুনিং করা হচ্ছে। জেলায় জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ৯১টি চা বাগানে এ প্রুনিংয়ের কাজ চলবে বলেও তারা জানান।
বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়,
চলতি মৌসুমে ১০২ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ৯৫ মিলিয়ন কেজির বেশি চা উৎপাদন ছাড়িয়েছে। এতে প্রতিয়মান হয় চলতি মৌসুমের চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার প্রত্যাশা ছাড়িয়ে দেশে চা উৎপাদনের একটি নয়া রেকর্ড হিসেবে পরিগণিত হবে। চা বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী দেশে মোট নিবন্ধনকৃত ১৬৮টি টি এস্টেট ও চা বাগান রয়েছে। এতে দুই লাখ ৭৯ হাজার ৫০৬.৮৮ একর বাগানে চা উৎপাদন হয়ে আসছে বলে জানা গেছে।
মন্তব্য করুন