মৌলভীবাজারে আকস্মিক বন্যা, কুশিয়ারা ও মনু তলিয়ে ৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি
স্টাফ রিপোর্টার॥ টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙ্গে ও কুশিয়ারা নদীর দুই পাড় তলিয়ে বাসা-বাড়িতে পানি উঠে মৌলভীবাজার পৌরসভা, সদর, রাজনগর, কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া উপজেলার প্রায় ৫ কোটি টাকার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এছাড়াও পানি বন্দি হয়ে পৌরসভাসহ জেলার চার উপজেলার দুই লক্ষাধিক মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বন্যার পানিতে ডুবে শিশুসহ এ পর্যন্ত ৭ জনের মৃত্যু খবর পাওয়া গেছে। জলমগ্নে শত শত কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বন্যায় আটকা পড়া লোকদের উদ্ধারে সর্বশেষ কয়েকটি স্থানে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয় সেনাবাহিনী। সরকারি ও বেসরকারি মৎস্য প্রদর্শনী খামারসহ দেড় হাজারেরও বেশি পুকুর তলিয়ে যাওয়ায় প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। ৩০টি আশ্রয় কেন্দ্রসহ বন্যা প্লাবিত এলাকায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সংস্থা রান্নাবান্না করে ও শুকনো খাবার বিতরণ করছে।
এদিকে মৌলভীবাজারের আকস্মিক বন্যাকবলিতদের খুজ-খবর নিতে নিতে মৌলভীবাজার ও রাজনগরে এসছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এমপি। তিনি সোমবার দুপুরে মৌলভীবাজার সার্কিট হাউজে এসে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। এর পর শহরের বড়হাট এলাকার (জুগীঢর) মনু নদী ভাঙ্গন পরিদর্শন শেষে ত্রান বিতরণ করেন। এসময় তিনি বলেন, আপনারা অনেক কষ্টে আছেন। এই পানি কবে নাম নামবে জানিনা। তবুও আমরা এসে আপনাদেও পাশে এসে দাড়িয়েছি। আপনাদেও দুঃখ-কষ্ট দেখার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আমরা আপনাদেও পাশে আছি। পৌর মেয়র মোঃ ফজলুর রহমান এর সঞ্চালনায় এসময় উপস্থিত ছিলেন, স্থানীয় সাংসদ সৈয়দা সায়রা মহসীন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, জেলা আ,লীগ সভাপতি নেছার আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মিছবাহুর রহমান।
জানা যায়, ধলাই নদীর ৮টি স্থান দিয়ে ভাঙন দেখা দেয়ায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যায় কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর, আদমপুর, আলীনগর, মাধবপুর, কমলগঞ্জ সদর, পৌরসভা, শমশেরনগর, রহিমপুর, মুন্সীবাজার ও পতনঊষার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকায় বাড়িঘরে চার থেকে পাঁচ ফুট পরিমাণ পানিতে নিমজ্জিত হয়। এসব এলাকার প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। চারদিনের বন্যার প্রবল ¯্রােতে কমলগঞ্জ উপজেলার কাঠালকান্দি গ্রামের আব্দুল ছত্তার (৫০) ও তার ছেলে আব্দুল করিম (২৫), আলীনগর বস্তির সেলিম মিয়া (৩৮), শমশেরনগর ভাদাইরদেউলে প্রতিবন্ধি রমজান আলী (৪০) ও রহিমপুর ইউনিয়নের প্রতাপী গ্রামে মিছির মিয়ার দেড় বছর বয়সি শিশু সন্তান ছাদির মিয়া পানিতে ডুবে মারা যান।
পানির ¯্রােতে ভারতের কৈলাশহরে যাতায়াতে শমশেরনগর-চাতলাপুর সড়কে কালভার্ট ব্রিজ ধ্বসে পড়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বন্যায় আটকা পড়া লোকদের উদ্ধারে সর্বশেষ কয়েকটি স্থানে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয় সেনাবাহিনী টিম।
এদিকে উপজেলার নব্বই শতাংশ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মৎস্য প্রদর্শনী খামারসহ প্রায় ১৫ শ ৫০ টি পুকুর প্লাবিত হয়। ভেসে যাওয়া মাছ ও পোনার পরিমাণ প্রায় ৪৭০ মে.টন। খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা এবং মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় চার কোটি বিশ লক্ষ টাকা বলে মৎস্য অফিস সূত্র নিশ্চিত করে। এছাড়া প্রায় তিন হাজার হেক্টর আউশ ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হক পানিতে ডুবে শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, এ পর্যন্ত উপজেলার প্রায় সহ¯্রাধিক কাঁচা ঘর সম্পূর্ণ ও আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর মেরামতে সরকারিভাবে বরাদ্ধ প্রদান করা হবে। এদিকে কদিনের বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পানিতে কুশিয়ারা নদী জলমগ্ন হয়ে সদর উপজেলার মনুমুখ ও রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ,ফতেপুর ইউনিয়নের আরো অর্ধ্ব লাখ মানুষ আকস্মিক পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন। হঠাৎ এই বন্যার আগমনে মানুষ দিশেহারা হয়ে ঈদেও খুশি বিষর্জন দিয়ে নিজেদের জানমাল ও গবাদি পশু নিরাপদে রাখতে ব্যস্থ সময় পাড় করছেন।
এদিকে রাজনগর উপজেলার সুনামপুর গ্রামে মঙ্গলবার ১২ জুন সকাল সাড়ে ১১টায় নৌকা চড়তে গিয়ে খালে পড়ে ইমাদ উদ্দিন (৫) নামের এক শিশু মারা গেছে। ওই দিন বিকেলে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানকে অবহিত করে তাকে দাফন করেছেন স্বজনরা। নিহত ইমাদ ওই গ্রামের হান্নান মিয়ার পুত্র। এদিকে মনু নদীর বাঁধ ভেঙ্গে রাজনগর উপজেলার ফেঞ্চুগঞ্জ- মৌলভীবাজার সড়কের কদমহাটা এলাকার প্রায় এক কিলোমিটার উপর দিয়ে কাউয়াদিঘি হাওরে পানি ঢুকে। এতে মনসুর নগর ইউনিয়নের ১৫/২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তাৎক্ষনিক সেনাবাহিনী মোতায়েন করে সড়ক মেরামত করা হয়েছে। এতে কুলউড়া ও সিলেটের সাথে মৌলভীবাজারের যান চালাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও মৌলভীবাজার শহরের বড়হাট এলাকায় মনুর প্রবল বেগে মৌলভীবাজার -শেরপুর সড়ক তলিয়ে গিয়ে মোস্তফাপুর,কনকপুর ও কাগাবলা ইউনিয়নে পানি ঢুকে পড়ে। এতে শেরপুরের সাথে যান চলাচল বন্ধ হয়। এদিকে রোববার তাৎক্ষনিক মৌলভীবাজার শহরের বড়হাট এলাকার মৌলভীবাজার-শেরপুর সড়ক পরিদর্শন করেন স্থানীয় রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দরা। জেলা আ’লীগ সভাপতি নেছার আহমদ,পৌর মেয়র ফজলুর রহমান, জেলা বিএনপি সভাপতি নাসের রহমান, সহ-সভাপতি মৌলভী আব্দুল ওয়ালী সিদ্দিকী,এম মুকিতসহ অনেকেই সরেজিমন পরিদর্শন করেন।
এদিকে জেলা ত্রান ও পুনঃবাসন কর্মকর্তা মোঃ আশরাফ আলী সোমবার জানিয়েছেন, জেলায় বন্যার্তদের জন্য ৯ লাখ ৪০ হাজার জিআর নগদ টাকা ও ৭শ ৪৩ মেঃটঃ চাল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও ৩ হাজার মেট্রিকটন শুকনো খাবার বিতরণ চলছে।
মন্তব্য করুন