মৌলভীবাজারে তৃতীয় দফা বন্যা দীর্ঘস্থায়ী রুপ নিয়েছে : তিন উপজোলার বিস্তৃর্ণ এলাকা প্লাবিত

June 30, 2017,

এস এম উমেদ আলী॥ প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে মৌলভীবাজার জেলায় তৃতীয় বারের মতো বন্যা ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। বন্যায় কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ২০টির বির্স্তৃর্ণ এলাকা সহ জুড়ী ও কুলাউড়া শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ সব এলাকার অধিকাংশ বাড়ী-ঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বড়লেখার সাথে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তিন উপজেলার প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ।
এ বছর মার্চে ২য় সপ্তাহে আকস্মিক ভাবে সোনাই, কন্টিনালা, জুড়ী ও কুশিয়ারা নদী দিয়ে আসা পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যা বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলায় এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একের পর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগে খেটে খাওয়া মানুষ সব হারিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এর আগে ২০০৪ সালে এ ধরনের দীর্ঘ মেয়াদী বন্যা হয়েছিল।
তিন উপজেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের ২০টি, প্রাইমারী ও মাদ্রাসা পর্যায়ে শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি ঢুকেছে। কোন কোনটির মাঠ ছাড়াও স্কুলের শ্রেণী কক্ষ, অফিস রুম তলিয়ে গেছে। ঈদের বন্ধ শেষে প্রতিষ্ঠানগুলো রবিবার খলার কথা রয়েছে।
অকাল বন্যায় যেমনি একমুঠো বোরো ধান ঘরে তুলতে পারেননি। পরে হাওরের মাছের ক্ষতি, সর্ব শেষ আউস ধান ও আমনের বীজতলার ক্ষতিতে এলাকার কৃষি ও মৎস্য জীবিরা পরেছেন মারত্মক ক্ষতিতে।
হাওর পাড়ের ৩ উপজেলার মানুষ দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় রয়েছেন। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে এলাকার অধিকাংশ বাড়ী-ঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, ঈদগাহ, মন্দির ও রাস্তাঘাট। অধিকাংশ বাড়ি-ঘর ২ থেকে ৬ ফুট বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকতে দেখা গেছে। অনেকেই নিজ বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন। দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় জুড়ী উপজেলা পরিষদের ভেতর সহ কুলাউড়া পৌর এলাকার ৩টি ওয়ার্ড প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোঃ গোলাম রাব্বি জানান, কুলাউড়া উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৭০/৮০টি গ্রাম এখন পানি বন্দি। তার উপজেলা পরিষদেও বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এ সব ইউনিয়নের প্রায় ২০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা সম্পুন পানির নিচে। এর ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে গ্রামাঞ্চলের যোগাযোগ। তিনি জানান, কয়েক দফা ত্রান দেয়া হয়েছে এবং এখনও অভ্যাহত আছে। চলমান বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পানি হাকালুকিতে পড়ে হাকালুকি ক্রমশ ফঁসে উটতে শুরু করেছে। নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে উঁচু অংশেও এখন দেখা দিয়েছে বন্যা।
কুলাউড়া উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ভুকশিমইল ইউনিয়ন, জয়চন্ডী, হাজীপুর, কাদিপুর, কুলাউড়া সদর, ব্রাহ্মণবাজার, ভাটেরা ও বরমচাল ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আ.ফ.ম কামরুল ইসলাম জানান, মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া আগাম বন্যায় এ উপজেলায় ধান, মাছ ও সবজির ব্যাপক ক্ষতির হয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে এই এলাকা গুলোকে দূর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষনার দাবী জানান। উপজেলার ভুকশিমইল, জয়চন্ডী, কাদিপুর, কুলাউড়া, ব্রাহ্মণবাজার, ভাটেরা ও বরমচাল ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প¬াবিত হয়েছে। এতে করে ঐ এলাকার মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন। কুলাউড়ায় ৪টি আশ্রয় কেন্দ্রে খোলা হয়েছে।
জুড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিন্টু চৌধুরী জানান, বিগত ১৫/২০ দিন ধরে এ উপজেলার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে এখন শহরে পানি উঠেছে। বর্তমানে উপজেলা প্রাঙ্গনে প্রায় ৩ ফুট পানি। তার বাংলোর এক তলায় পানি উঠেছে। তিনি সিফট করে ২য় তলায় উঠেছেন এবং উপজেলা প্রশাসনের সকল কাজ ২য় তলায় চালাচ্ছেন।
তিনি জানান, জুড়ি উপজেলার জায়ফর নগর, পশ্চিম জুড়ি ইউনিয়নসহ সহ ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৩৫ টি গ্রামের ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি আছেন। এ বছর মার্চের মাঝা মাঝি বন্যা হওয়ায় হাওরের পানি না কমা ও পরবর্তীতে আবারও টানা বর্ষণে বন্যা দেখা দিলে মানুষকে একটু বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
তিনি জানান, মাইকিং করে ও চেয়ারম্যান মেম্বারের মাধ্যমে খবর দিয়ে যাদের বাড়িতে পানি উঠেছে তাদের বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে বলা হয়েছে। তিনি আরো জানান, এই উপজেলায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত পরিমান জিআর, ভিজিডি, ভিজিএফ এর চাল দেয়া হয়েছে। এখনও ৫০ টন চাল বিতরণ করা হচ্ছে। আশ্রয় কেন্দ্রে পরিদর্শন সহ বন্যা আক্রান্ত এলাকা প্রশাসনের সার্বক্ষনিক নজরদারীতে রয়েছে।
এদিকে গাড়ি চলাচলের রাস্তাদিয়ে নৌকা নিয়ে অফিস করছেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও সরকারী কর্মকর্তারা। আর শহরের বাড়িঘরে স্থায়ী জলাবদ্ধতা রীতিমত হতবাক করে দিয়েছে জুড়ি ও বড়লেখা শহর ও শহরতলীর মানুষকে।
জুড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান গুলসানারা মিলি জানান, এতো পানির অভিজ্ঞতা তার প্রথম। কয়েকদিন ধরে গাড়ি রেখে নৌকায় এসে তাকে অফিস করতে হচ্ছে।
বড়লেখা উপজেলার ১০ টি ইউনিয়নে অব্যাহত বন্যায় বর্নি, দক্ষিনবাগ, তালিমপুর ও সুজানগর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এ উপজেলার প্রায় ৬০ টি গ্রামের ৯০ হাজার মানুষ।
প্রতিদিনের বৃষ্টির কারণে হাওরে পানি বাড়ছে আর নতুন বসতি এলাকা নিমজ্জিত হচ্ছে। ঘর-বাড়ি নিমজ্জিত হয়ে রান্ন্াবান্না করার মতো শুকনো কোন জায়গা না থাকায় লোকজন সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
সুজানগর ইউনিয়নের ছিদ্দেক আলী বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানরত ভোলারকান্দি গ্রামের খেলারুন বেগম, মনোয়রা বেগম ও লালী বেগম বলেন, ‘১১দিন থেকে স্কুলে আছি। গত রাত তুফানে আমার ঘরের টিন হাওরে উড়াইয়া নিয়ে গেছে। খুব বেশি তুফান দিছে। আশ্রয় কেন্দ্রে খাবারের সমস্যায় আছি। আশ্রয় কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ৫’শ টাকা, লুঙ্গি, সেমাই, চিনি, তেল, কিছু চিড়া, মুড়ি ছাড়া এখন পর্যন্ত সরকারি কোন সাহায্য পাইনি। খুব কষ্টে আছি আমরা।’
তালিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ কান্তি দাস জানান, তার ইউনিয়নের সবক’টি গ্রামের ঘরবাড়ি বন্যায় তলিয়ে গেছে। গত তিন দিন বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও বৃষ্ঠি হওয়তে পানি বাড়তে থাকে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। রান্না করে খাওয়ারও কোন জায়গা শুকনো নেই। দুর্গত মানুষের মধ্যে হাহাকার চলছে। এখনও আশানুরূপ সরকারী সাহায্য সহযোগিতা মিলেনি।
বড়লেখা উপজেলার ইউএনও এসএম আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘প্রতিদিনের বৃষ্টির কারণে হাওরে পানি বাড়ছে আর বসতি এলাকা নিমজ্জিত করছে। ৩টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে এ পর্যন্ত মোট ১১৫টি দুর্গত পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রেগুলো পরির্দশন করেছি। বন্যা দুর্গতদের জন্য ৩৯ মেট্রিক টন জিআর চাল ও জিআর ক্যাশ ৯৫ হাজার টাকা বরাদ্ধ পাওয়া গেছে। এগুলো দ্রুত বিতরণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এছাড়া আরও বরাদ্ধের প্রাপ্তির জন্য আবেদন করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বড়লেখা ও জুড়ি আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের হুইপ এম সাহাব উদ্দিন এমপি বলেন, কয়েকদফা প্রাকৃতিক দূর্যোগে পড়েছে মৌলভীবাজার জেলায়। ইতিমধ্যে জেলার প্রত্যেক উপজেলায়ই সরকারী ত্রাণ পৌছে দেয়া হয়েছে। আগামীতে আরো ত্রান দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
এদিকে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় রাজনগর উপজেলার কাউয়াদিঘি হাওরের পানি নামতে না পারায় এ উপজেলায় প্রায় ১০টি গ্রামের মানুষ রয়েছেন পানিবন্দি। আর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন রাজনগর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের অন্তেহরি গ্রামের। একই কারনে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আখাইলকুড়া ইউনিয়নের কাদিপুর, নাজিরাবাদ ইউনিয়নের বিস্তৃর্ণ এলাক্ পানির নীচে তলিয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান, বড়লেখা, কুলাউড়া ও জুড়ি উপজেলার সানাই, কন্টিনালা, জুড়ী নদী ও শতাধিক পাহাড়ি ছড়া দিয়ে হাকালুকিতে বৃষ্টির পানি নামে। এ সব ছড়া দিয়ে ভারতের পানিও নামে। আর হাকালুকি হাওরের পানি কুশিয়ারা নদী দিয়ে বের হয়। বর্তমানে কুশিয়ারা নদীর যে স্থান দিয়ে পানি নামে সেখানে বিপদ সীমার ২৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে তাই পানি বের হতে না পেরে পানিতে ফুলে গিয়ে এই তিন উপজেলার গ্রামগুলো পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। কুশিয়ার পানি নেমে গেলে তখন অন্তত শহর ও শহরতলীর পানি নেমে যাবে।
হাকালুকির পাড়ের তিন উপজেলার মানেুষের একটাই দাবী বন্যা নিয়ন্ত্রনে সরকার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগি হবেন এমনটাই প্রত্যাশা করেন তারা।

 

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com