মৌলভীবাজারে নারী শিক্ষিকাকে প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ ও ভিডিও ধারনের অভিযোগ, মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল গ্রেপ্তার
স্টাফ রিপোর্টার : মৌলভীবাজারে মাদ্রাসা শিক্ষিকা ধর্ষণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষনের ভিডিও ছেড়ে দেয়ার হুমকি ও অপহরণের অভিযোগে একই মাদ্রাসার প্রিন্সিপালকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বিতর্কিত প্রিন্সিপাল মাওলানা আলতাফুর রহমান সাদেকী শহরতলীর আয়েশা সিদ্দিকা নামক মহিলা টাইটেল মাদরাসায় কর্মরত প্রিন্সিপাল ছিলেন।
পুলিশ জানায়, ১ অক্টোবর নারী শিক্ষিকা বাদী হয়ে আলতাফুর রহমান সাদেকী এর বিরুদ্ধে মৌলভীবাজার মডেল থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। পরদিন ২ অক্টোবর শহরতলীর মোস্তফাপুর ইউনিয়নের খিদুর এলাকার মহিলা মাদ্রাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার ককরা হয়। বৃহস্পতিবার ৩ অক্টোবর দুপুরে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে মৌলভীবাজার সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ গাজী মোঃ মাহবুর রহমান জানান, ধর্ষণ ও অপহরণের অভিযোগে মাওলানা আলতাফুরকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, দেড় বছর আগে ওই ঘটনা ঘটলেও আলতাফুর রহমান ভুক্তভুগি ওই নারীর শিক্ষিকার পিছু ছাড়েননি। সম্প্রতি তাঁকে অপহরণের চেষ্টাও চালান।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগী শিক্ষিকা গ্রেপ্তারকৃত মাওলানা আলতাফুর রহমানের মাদ্রাসায় চাকরি করতেন। চাকরিকালীন সময়ে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ২০২২ সালের ২০ মার্চ মাদ্রাসা বন্ধ দিলে শিক্ষার্থী ও অন্যান্য শিক্ষকরা বাড়িতে চলে গেলেও আলতাফুর রহমান ওই শিক্ষিকাকে বাড়িতে যেতে দেননি। মাদ্রাসায় একা রেখে রাতে ধর্ষণ করে ভিডিও ধারণ করেন। পরবর্তীতে ওই শিক্ষিকা মাদ্রাসা থেকে চাকরি ছেড়ে দেন। কিছু দিন পর ২০২২ সালের মে মাসে সামাজিকভাবে ওই শিক্ষিকার বিয়ে হয়। বিয়ের পরেও ধর্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার হুমকি ও শিক্ষিকার স্বামীর মোবাইলে ছাড়ার ভয় দেখিয়ে আলতাফুর প্রায়ই শিক্ষিকার সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন। শিক্ষিকার স্বামী বিষয়গুলো বুঝে জেলার শীর্ষ আলেমদের সংগঠন মৌলভীবাজার ওলামা পরিষদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
সূত্রে জানা যায়, আলতাফুরকে গত বছরের শেষের দিকে একই প্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষিকার সাথে অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেন জেলার কওমীপন্থি শীর্ষ আলেমদের সংগঠন ‘উলামা পরিষদ মৌলভীবাজার’ এর নেতৃবৃন্দ। অবাঞ্চিত ঘোষনা করা হলেও সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে তা প্রকাশ পায়। এর পর কওমী অঙ্গণ সহ নানা মহলে শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। অভিযোগের বিষয়টি ওই সময় স্বীকার করে পরবর্তীতে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি নেয়ার পর ফের স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের দ্বায়িত্বে বসালে আলেমদের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় শহরের জামেয়া দ্বীনিয়া মাদ্রাসায় জেলার শীর্ষ আলেম ও বরুনার পীর মূফতি রশদিুর রহমান ফারুক এর সভাপতিত্বে উলামা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলার শীর্ষ আলেমদের উপস্থিতিতে ওই সভায় উলামা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাওঃ গিয়াস উদ্দিন মাওঃ আলতাফুর রহমান সাদেকির বিরুদ্ধে ওই মাদ্রাসার নারী শিক্ষিকার সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলেন বলে অভিযোগ করেন।
এর আগে মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি ও সাবেক পৌর কাউন্সিলর আয়াছ আহমদ এর বাসায় ২০২৩ সালের ১৩ আগষ্ট মাওঃ মনসুরুল হাছান রায়পুরী, মুফতি শামছুদ্দোহা, মুফতি হাবিবুর রহমানসহ অভিযুক্ত মাওঃ আলতাফুর রহমান সাদেকীর উপস্থিতিতে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে মাওঃ আলতাফুর রহমান সাদেকী স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী দেন এবং লিখিতভাবে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি নেন। এ ঘটনার কিছুদিন যেতে না যেতেই ফের নানা কোট-কৌশলে মাদ্রাসার মুহতামিম হিসেবে দ্বায়িত্ব নিলে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। ওই বৈঠকে মাওলানা গিয়াস উদ্দিন বলেন, দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা রক্ষা ও নিরিহ মহিলাদের ইজ্জত রক্ষার স্বার্থে বার বার পদ থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করা সত্ত্বেও মাওঃ আলতাফুর রহমান সাদেকী তা আমলে নেননি। এতে জেলার কওমী অঙ্গণের আলেমদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ভুক্তভুগি নারী শিক্ষিকা ও তাঁর স্বামী ক্ষিপ্ত হয়ে উলামা পরিষদের সভাপতি বরাবর লিখিত ও মৌখিক বিচারপ্রার্থী হন।
এমন পরিস্থিতিতে উলামা পরিষদের সভাপতির নির্দেশে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। ওই কমিটি তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেলে মাওঃ আলতাফুর রহমান সাদেকীকে কওমী অঙ্গণে অবাঞ্চিত ঘোষনাসহ পাঁচদফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন জেলার আলেমরা।
জানা যায়, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পিছনে অন্যতম ভুমিকা পালন করেন মৌলভীবাজার পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আলহাজ্ব আয়াছ আহমদ। গত বছরের আগষ্ট মাসে মাওঃ আলতাফুর রহমান সাদেকিকে নিয়ে সৃষ্ট ঘটনার জন্য তাঁর বাসায় ডাকা হলে সেখানে অভিযোগ প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করেন বলে আয়াছ আহমদ জানান। ওই সময় তিনি নিজের অপকর্মের কথা স্বীকার করে মাফও চান। পরবর্তীতে আমরা তাঁকে মাদ্রাসার দ্বায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে বলার পর তিনি কৌশলে লিখিত আবেদনে অসুস্থতার বিষয়টি উল্লেখ করলেও ঘটনার বিষয়টি লিখিত আবেদনে এড়িয়ে যান। আমরা তাঁর এই কৌশলের বিষয়টি ওই সময় বুঝতে পারিনি।
অপরদিকে মাওঃ আলতাফুর রহমানের বিরুদ্ধে নানা বিতর্ক,আলেমদের মধ্যে ক্ষোভ আর অভিযোগের পাহাড় তৈরি হলেও আদালত কিংবা থানায় ভুক্তভুগি ওই নারী সম্মান হারানোর ভয়ে কোন অভিযোগ দায়ের করার সাহস পাননি। ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর অবশেষে বিতর্কিক প্রিন্সিপাল মাওঃ আলতাফুর রহমানের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করলেন ওই ভুক্তভুগি নারী শিক্ষিকা। এর পরই তাঁকে গ্রেফতার করে থানা পুলিশ।
মন্তব্য করুন