মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, নতুন এলাকা প্লাবিত, ৪ লাখ মানুষ পানি বন্দি
স্টাফ রিপোর্টার॥ মৌলভীবাজার জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কমলগঞ্জে ধলাই নদীর তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে নতুন করে প্লাবিত করেছে বিন্তিৃর্ণ এলাকা।
কমলগঞ্জে ধলাই নদীর সদর ইউনিয়নের চৈতন্যগঞ্জ এলাকার এবং রহিমপুর ইউনিয়নের চৈত্রঘাট ও মুন্সিবাজার ইউনিয়নের খুশালপুর গ্রামে ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙন দিয়েছে। ভাঙ্গন দিয়ে পানি প্রবেশ করে নারায়নপুর, চৈতন্যগঞ্জ, বাঁধে উবাহাটা, খুশালপুর ছয়কুট, বড়চেগ, জগন্নাথপুর, প্রতাপী, গোপীনগর, আধকানী, কাঁঠালকান্দিসহ প্রায় ৪০টি গ্রামে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি ও বাড়ী ঘরে পানি প্রবেশ করছে।
মনু ও ধলাই নদীর বাঁধের ১৯টি স্থান ঝুকিপূর্ণ রয়েছে। কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে মৌলভীবাজারে ৭টি উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে কুলাউড়া পৌর সভার ৩টি ওয়ার্ড। এছাড়াও বন্যার পানি প্রবেশ করেছে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুলাউড়া উপজেলা পরিষদ ও জুড়ী উপজেলা পরিষদে। বন্যা কবলিত এলাকার অধিকাংশ গ্রামীন রাস্তা তলিয়ে গেছে। আঞ্চলিক সড়কের অনেক স্থানে পানি উঠেছে। বাড়ি ঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি রয়েছেন হাওর ও নদী তীরের প্রায় ৪ লাখ মানুষ। জেলার ৪০ ইউনিয়নের ৪৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ৯৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
বানের পানি গ্রাস করেছে বসতবাড়ি। তাই এখন মাথা গোঁজার ঠাঁইও নেই। পোল্ট্রি ফার্ম, ধান, মাছ, সবজি আর ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব কৃষি ও মৎস্যজীবী লোকজন। বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটে পড়েছেন বানভাসি মানুষ। বানের পানিতে ভেসে গেছে পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ। গবাদিপশুগুলোর খাদ্য সংকটও চরমে। বন্যাকবলিত জেলার ৭টি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর শহরের অধিকাংশ মানুষ। এর মধ্যে অন্যতম বন্যাকবলিত জেলার বড়লেখা, কুলাউড়া, জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওর তীরের মানুষ। মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী রাজনগর, সদর উপজেলা ও কমলগঞ্জ উপজেলার লোকজনও বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন। কমলগঞ্জের ধলাই নদীর তীরবর্তী লোকজন জানালেন কিছুদিন আগের বয়ে যাওয়া বন্যায় তাদের কৃষিজমি ও মৎস্যখামার ডুবে গেলেও এখন ডুবছে তাদের ঘরবাড়ি। বড়লেখা উপজেলায় বন্যায় অন্তত শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যায় অধিকাংশ গ্রামীণ রাস্তা তলিয়ে গেছে। আঞ্চলিক সড়কের অনেক স্থানে পানি উঠেছে। ডুবেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। ফলে জনদুর্ভোগ চরমে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, হাকালুকি হাওর পাড়ের কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল, জয়চণ্ডী, কাদিপুর, কুলাউড়া, ব্রাহ্মণবাজার, ভাটেরা ও বরমচাল ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
জুড়ী উপজেলার ৫ ইউনিয়নের প্রায় ৪৫টি গ্রামে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। কমলগঞ্জ উপজেলায় ধলাই নদীর পাড় ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ৪৫-৫০টি গ্রাম। একই অবস্থা জেলার রাজনগর, মৌলভীবাজার সদর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার।
পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয় বলছে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ নিয়ে তাদের সতর্ক প্রস্তুতি রয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা জানালেন, স্থানীয় হাওর ও নদীগুলোর নাব্য হ্রাসে এমন দুর্যোগ। দীর্ঘদিন থেকে সংস্কারহীন নদীগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ স্থায়ীভাবে মেরামত না করায় বার বার ওই সকল বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন বৃষ্টি ও উজানের ঢল না থামলে নতুন করে অনেক এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা তাদের। এই পরিসংখ্যান ছাড়াও জেলার অনেক উপজেলার নদী ও হাওর তীরবর্তী অনেক গ্রামই আংশিক বানের পানিতে তলিয়ে গেছে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে মনু নদীর পানি শহরের চাঁদনীঘাট এলাকায় বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদী শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ও জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার ২০৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বন্যায় জেলার ৭ উপজেলার ৪৭ ইউনিয়নের ৪৭৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ইতিমধ্যে ২০৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ৬২৫৩ জন বন্যার্ত মানুষ। গবাদিপশুর সংখ্যা ২শ’টি। কার্যরত মেডিকেল টিম রয়েছে ৭০টি। শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে ৪৬৫ প্যাকেট, রান্না করা খাবার ১২শ’ প্যাকেট, জিআর চাল ৪২২ টন, জিআর ক্যাশ ২৮৭৫০০ টাকা, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ৬৫ হাজার পিস। বিশুদ্ধ পানি ২৪০টি ১০ লিটারের বোতল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজার এর নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল জানান, জেলার মনু, কুশিয়ারা ও জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ধলাই নদীর পানি কিছুটা কমেছে। উজানে ভারত অংশে বৃষ্টি না হলে পানি কমতে শুরু করবে। ঝুকি পূর্ণ স্থান গুলো মনিটরিং রাখা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, যেসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে আমরা সবসময় তা সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। বন্যা কবলিতদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। আরও বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকায় আমরা সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রতিটি উপজেলার ইউএনওদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের সব প্রস্তুতি আছে।
মন্তব্য করুন