মৌলভীবাজারে বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পে হরিলুট
ইমাদ উদ দীন॥ বিদ্যুৎ স্টেশনটি সাবস্টেশন থেকে উন্নীত হয়েছে গ্রীড স্টেশনে। কিন্তু তারপরও কারণে অকারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট থেকে সহসাই মুক্তি না পাওয়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন তিন উপজেলার কয়েক হাজার উপকার ভোগী। এর অন্যতম কারণ স্টেশনটির উন্নয়ন কর্মকান্ডে হয়েছে নয় ছয়। উন্নয়ন প্রকল্পের পুরো কাজে অভিযোগ উঠেছে ব্যাপক অনিয়মের। এমন অভিযোগ গ্রাহক ও এ প্রকল্পে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানালেন কুলাউড়া বিদ্যুৎ গ্রীড স্টেশনের বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ না করেই কি ভাবে হরিলুট হচ্ছে বরাদ্ধকৃত টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে থাকায় নাম মাত্র কাজে সমাপ্ত হচ্ছে কুলাউড়া বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের উন্নয়ন প্রকল্পের।
বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও খুঁটি (খাম্বা) স্থাপন, আর্থিক সুবিধা নিয়ে পুরোনো বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সংস্কার এবং নতুন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন, নি¤œ মানের তার ও যন্ত্রাংশ,নতুনের পরির্বতে পুরোনো ব্যবহৃত ব্রেকার ও ট্রান্সফরমার স্থাপন করে লুটপাট হচ্ছে এ প্রকল্পের টাকা। প্রকল্পে বিনামূল্যে পুরোনো জরাজীর্ণ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সংস্কার, নতুন খুঁটি, সঞ্চালন লাইন ও ট্রান্সফরমার স্থাপনের। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগের এই উন্নয়ন প্রকল্পের নামে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার, ইঞ্জিনিয়ার ও পিডিবির কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চলছে হরিলুট। গ্রাহকদের অভিযোগ নতুন লাইন, খুঁটি, ট্রান্সফরমার বসিয়ে দেয়া ও এমনকি পুরাতন লাইন সংস্কারের নামে তারা ইতিমধ্যেই তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন বড় অংকের টাকা। তারা জানান অনেক এলাকায় জরাজীর্ণ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সংস্কার না করে উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে আলাদা ট্রান্সফরমারসহ নতুন সঞ্চালন লাইন স্থাপন করে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের ৪০টি উপজেলায় পিডিবির জরাজীর্ণ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন আমূল সংস্কারে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) অর্থায়নে ‘সেন্ট্রাল জোন পাওয়ার ড্রিস্ট্রিবিউশন প্রজেক্ট’ নামে পাঁচ বছর মেয়াদী বিশেষ এই প্রকল্প ঠিকাদারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে পিডিবি। ডিভিশন-৩ (মৌলভীবাজার ও কিশোরগঞ্জ) এর অধীনে ২য় দফার প্রকল্পের মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজ শেষ না হওয়ায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। যা শেষ হচ্ছে চলতি মাসের ৩০ তারিখে। অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকল্পের আওতাভুক্ত উপজেলা শহর, ইসলামগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাজার ফিডারের কুলাউড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ৩৩ কেভির ব্রেকারগুলো নতুন ডিজিটাল স্থাপন করা হলেও ১১ কেভির ব্রেকারগুলো পুরোনো এবং এনালগ। এগুলো সিলেটের শিবগঞ্জ ও উপশহরে প্রায় ২২ থেকে ২৫ বছর ব্যবহৃত হয়েছে।এই ব্রেকারগুলো সংস্কার (রিপিয়ারিং) করে এখানে স্থাপন করা হয়েছে। কুলাউড়া পিডিবির একাধিক সূত্র জানায়, ব্রেকারগুলো ব্যবহৃত ও রিপায়ারিং হওয়ায় এগুলো দিয়ে বেশি দিন সার্ভিস দেয়া সম্ভব হবে না। কুলাউড়া পৌর শহরে দক্ষিণ বাজার থানা রোডস্থ আবাসিক এলাকা ও সোনাপুর ও শিবির এলাকায় জরাজীর্ণ ও ঝুকিপূর্ণ সঞ্চালন লাইন পরিবর্তন হয়নি। এসব এলাকার গ্রাহকদের অভিযোগ চাহীদানুযায়ী টাকা দিতে না পারায় তাদের এলাকায় নতুন বিদ্যুৎ লাইন ও খুঁটি বসানো হয়নি। উৎকোচের বিনিময়ে বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কুলাউড়ার হাজীনগর চা বাগানে নতুন ২৫টি খুঁটি বসিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনসহ আলাদা ট্রান্সফরমার স্থাপন করে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। লস্করপুর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নতুন বিদ্যুৎ লাইন, খুঁটি ও ট্রান্সফরমার বসানোর জন্য দালালদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক লক্ষ টাকা। বেহাল দশায় ইসলামগঞ্জ ফিডারের বিভিন্ন এলাকা। তবে পিডিবির স্থানীয় কর্মকর্তারা এই ব্যাপক অনিয়মের বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। প্রকল্পের বরাদ্দ কত টাকা, কর্মপরিধি, ড্রয়িং এসব ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা করছেন লুকোচুরি। ফলে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এ উন্নয়ন কর্মকান্ড। প্রকল্পের উপ-সহকারী ইঞ্জিনিয়ার বকুল হোসেনের কাছে প্রকল্পের ড্রয়িংসহ কাজের কর্মপরিধির ব্যাপারে তথ্য জানতে চাইলে তিনি তা দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, প্রকল্প সংক্রান্ত বিষয়ে পিডিসহ (প্রকল্প পরিচালক) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানেন। কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলায় ১২ মিটারের ১ হাজার ৫শ’ ২৯টি, ৯ মিটারের ৬শ’ ৮টি, ১৫ মিটারের ২শ’ ১০টি খুঁটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কিন্তু কতটি ট্রান্সফরমার ও কত কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হবে সেটা তিনি জানেন না বলেও জানান। এ বিষয়ে কুলাউড়া বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে হচ্ছেনা।এ ব্যাপারে আমারা বেশ কয়েকবার চিঠির মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কুলাউড়া বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী দুলাল বলেন, এই প্রকল্পে তদারকির দায়িত্ব আমার নেই। এর সাথে জড়িত কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন। তবে প্রকল্প থেকে আমি যেই মানের ও চাহিদার কাজ চেয়েছিলাম তা পাইনি। প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাব ডিভিশনাল সহকারী প্রকৌশলী শামছ্-ই আরিফিন মুঠোফোনে জানান, প্রকল্পে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় পুরোপুরিভাবে কাজ করা সম্ভব হচ্ছেনা। প্রকল্পের কত কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও কতটি ট্রান্সফরমার তা নির্দিষ্ট থাকেনা। চাহিদা অনুযায়ী সঞ্চালন লাইন ও ট্রান্সফরমার স্থাপন করা হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিও লেটারের ভিত্তিতে হাজীনগর চা বাগানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান। প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মাহবুবুর রহমানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,আমার অধীনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এরকম বেশ কয়েকটি প্রজেক্টের কাজ চলছে। তাই আলাদা করে ওখানে (কুলাউড়ায়) কত টাকা বরাদ্দ সেটা বলা যাচ্ছে না। তবে কাজে কোন অনিয়ম হলে তা খতিয়ে দেখে দায়ী দের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।
মন্তব্য করুন