মৌসুমী ফলের হাঁট পাকা ফলের মৌ মৌ ঘ্রাণ ধুম লেগেছে “জৈষ্ঠ হাঁড়ির”
ইমাদ উদ দীন॥ মৌলভীবাজারের স্থানীয় হাঁট বাজার গুলোতে এখন জমে উঠেছে মৌসুমী ফলের কেনা বেচা। দোকানীদের নানা জাতের ফলের পসরাই জানান দিচ্ছে এখন চলছে মধু মাস। সকাল থেকেই ক্রেতা বিক্রেতাদের পদভারে মুখোরিত স্থানীয় হাট বাজার। ক্রেতা বিক্রেতার এমন ব্যাস্ততা এখন হররোজ। পসরা সাজানো পাকা আধপাকা এসকল মৌসুমী ফলের মৌ মৌ ঘ্রাণ বিমোহীত করছে ভোজন রসিকদের। জ্যৈষ্ঠ মাসের “জৈষ্ঠ হাঁড়ি” বা “খৈ কাঠালী” সিলেট
অঞ্চলের রেওয়াজী ঐতিহ্য। তাই মধু মাস এলেই এদৃশ্য পাহাড়ী টিলা বেষ্টিত এ অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে সবার ঘরে ঘরে। প্রতিটি বাড়ির চারপাশ থেকে আসা পাকা ফলের মৌ মৌ ঘ্রানই জানিয়ে দেয় এখন গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে চলছে খৈ কাঠালী উৎসব। মধু মাসে পাঁকা ফল ভক্ষণের স্বাদে গভীর হয় আতœীয়তার বন্ধন। এমন বিশ্বাস আর ঐতিহ্যের ঠানে এ অঞ্চলে জ্যৈষ্ঠ মাসেই ধুম লাগে (আতœীয় স্বজনের বাড়িতে ফল উপহার দেওয়ার) জৈষ্ঠ হাঁড়ির। মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে জৈষ্ঠ হাঁড়ি দেওয়া যেন অনেকটাই বাধ্যতামূলক। বিশেষ করে নতুন বিবাহীত মেয়ের জামাইর বাড়ি হলে তো আর কথাই নেই। জৈষ্ঠ হাঁড়ি পাঠানোর এমন রেওয়াজ অনেক পুরানো। এসময়টাতে গ্রামীণ জনপদের প্রতিটি বাড়িতে চলে ফল উৎসব। আতœীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীরা বেড়াতে এলে বরণ করা হয় পাকা ফল খাইয়ে। এ অঞ্চলের গ্রাম গুলোতে পুরো জ্যৈষ্ঠ মাস ও আষাঢ় মাসের ১০-১৫ তারিখ পর্যন্ত জুড়ে চলে এমন ফল ভক্ষনীয় আতীথেয়তা। যুগ যুগ থেকে চলা এ গ্রামীণ ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছেন এ অঞ্চলের লোকজন। আতœীয় স্বজনকে মধু মাসের পাকা ফল খাওয়ানো বা তাদের বাড়িতে পাঠনোর রেওয়াজ এখনো গ্রাম গুলোতে আছে বহাল তবিয়তে। যার বাড়িতে যে ফল নেই তিনি হচ্ছেন বাজার মুখি। হাতের নাগালেই সাধ ও সাধ্যের মধ্যেই মিলছে এসকল মওসুমী ফল।
জেলার হাট বাজার গুলোতে সরাসরি চাষীদের বাগান থেকে আসা বিক্রির জন্য স্থুপ করে রাখা পাকা-আধপাকা ফলের মৌ মৌ ঘ্রান বিমোহীত করছে ক্রেতাদের। পাকা ফলের মৌ মৌ ঘ্রান জানান দিচ্ছে সিলেটিদের ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজের। তাই রেওয়াজী ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখন ধুম লেগেছে ‘জ্যৈষ্ঠ হাঁড়ির’ (খৈই, কাঠালি দেওয়ার)। মধু মাসে এ অঞ্চলের রেওয়াজ হল এ মওসুমে সবজাতের পাকা- আধপাকা ফল সাথে মন্ডা-মিটাই, মুড়ি-মুড়কি,খৈই গাড়ি বোজাই করে দেওয়া হয় নতুন বিবাহিত মেয়ের শ্বশুরালয়ে। নুতুন বিবাহিত মেয়ের জামাইর বাড়িতে বেশি পাঠালেও বাদ পড়েনা অন্য মেয়েদের জামাইর বাড়িতে এসকল মওসুমী ফল পাঠানোর। মেয়েদের শ্বশুরালয়ে তাদের বাবার বাড়ি থেকে আসা মধু মাসের উপহার ফল আর মুড়ি মুড়কি মন্ডা মিঠাই তারা একা খাননা। বিতরন করা হয় মেয়ের জামাইর বাড়ির পুরো গ্রামে। তখন ওই গ্রাম জুড়ে চলে খৈই কাঠালি উৎসব। জেলার স্থানীয় হাট-বাজার গুলোতে এখন জমজমাট মওসুমী ফসলের শেষ পর্যায়ের বেচাকেনা। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হৈ হুল্লুড়ে সরগরম এসকল ফলের হাট।স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন এখন প্রতিদিনই এসকল বাজারে বসছে অস্থায়ী মওসুমী ফসলের হাঁট। সকাল হতেই চাষীরা নিজ বাগান থেকে পাকা ও আধ পাকা নানা জাতের ফল সংগ্রহ করে সাইকেল ,রিকশা, ঠেলা গাড়ি , পিকআপ ও ট্রাক দিয়ে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন স্থানীয় বাজার গুলোতে। স্থানীয় বাসিন্দা সহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে ওখানে ক্রেতারা আসেন কম দামে রাসায়নিক দ্রব্যাদি মিশ্রন ছাড়াই সু-স্বাদু এসকল মওসুমী ফল কিনতে।এ জেলার ছোট বড় সব হাট-বাজার গুলোতে কমবেশী মওসুমী ফল উঠলেও সবচেয়ী বেশী মওসুমী ফল বিক্রি হয় জেলার কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজারে। সপ্তাহে দু’দিন সোম ও বৃহ:স্পতিবার স্থানীয় হাট বারে। সপ্তাহে দু’দিন ওই বাজারের পূর্বপাশে কুলাউড়া-মৌলভীবাজার সড়কের প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রাস্তার দু’ পাশেই জমে উঠে মওসুমী ফলের হাঠ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ দুই দিন ক্রেতা বিক্রেতা আর মওসুমী নানা জাতের ফল ছোট-বড় গাড়ি বোজাই হওয়ার দৃশ্য যে কাউরই নজর কাড়ে। বাজার জুড়ে পসরা সাজানো থাকে আম, কাঠাল, আনারস, লিচু, কালো জাম, গোলাপ জাম, জামরুল, লটকন, কলা, নারিকেল, কাচাঁ তাল ,আখ, বেল, লেবু, আমড়া,জাম্বুরা,লুকলুকি, তাল, চৈইলতা, জলপাই , কামরাঙ্গা, বেলেম্বুসহ কতকি মওসুমী ফল। ব্রাহ্মণবাজার ছাড়াও জেলার শ্রীমঙ্গলে প্রতিদিনই সকালে হাটঁ বসে আনারস , কাঠাল ও লেবুর। আনারস ও লেবুর চাষের জন্য জেলার মধ্যে এ উপজেলা অন্যতম। হাটঁ বসে বড়লেখার শাহবাজপুর বাজার, বড়লেখা সদর , জুড়ি কামিনিগঞ্জ বাজার, কুলাউড়ার রবিরবাজার, বরমচাল ও ভাটেরা বাজার, কমলগঞ্জের মুন্সিবাজার,কমলগঞ্জ সদর, রাজনগরের টেংরা বাজার ও মুন্সিবাজার। এছাড়া এ জেলার প্রতিটি ছোট-বড় বাজারে কম বেশি মওসুমী ফল বিক্রি হয়। চাষীরা জানান এবছর শীলা বৃষ্টির কারনে মওসুমী ফলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তুলানামূলক অন্যবছরের চাইতে ভালো ফলন না হওয়ায় এবছর ফলের দাম অন্য বছরের চাইতে একটু বেশী। তবে মওসুমের শুরুতে তারা দাম বেশী পেলেও এখন সে দাম পাচ্ছেন না। তারা জানালেন দাম যাই হউক তা ক্রেতাদের সাধ্যের মধ্যেই আছে। তাদের বিক্রিও ভালো হচ্ছে। স্থানীয় বাগান থেকে সরাসরি কৃষকের হাত হয়ে গাছ পাকা ফল গুলো বাজারে আসায় এসকল ফলে ফরমালিনের ভয় না থাকায় এ ফল কিনতে ক্রেতাদের আগ্রহ থাকে বেশী। তাই দাম বেশী হলেও ক্রেতারা এরকম ফল কিনতে স্বাচন্দ্য বোধ করেন। একারনে ক্রেতা বিক্রেতা উভয়েরই পোষিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ী টিলার এ মওসুমী ফল গুলো সুস্বাদু , রসালো ও আকারে বড় হয় বলে এখানকার ফলের চাহিদাও বেশী। ব্রাহ্মণ বাজারের স্থানীয় মওসুমী ফল বিক্রেতারা জানালেন এবছর আকার ভেদে কাচাঁ কাঠাল প্রতিপিছ ৩০ থেকে ৯০ টাকা। আনারস প্রতি হালি আকার ভেদে ৮০ থেকে ১২০ টাকা। লিচু আটি ১৩০ থেকে ১৮০ টাকা । জাম প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা। কলা প্রতিছড়া মাঝারী ২শত থেকে ২৫০ টাকা। নারিকেল জোড়া ৫০ থেকে ৮০ টাকা। লটকন প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৭০ টাকা। প্রতি কেজি খৈ ৫০ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবছর এ মওসুমে এ অঞ্চলের ভাড়ায় চলা ট্রাক, মিনি ট্রাক, পিকআপ , টেম্পু ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা গাড়ির ভালো আয় রোজগার হয়। সংশ্লিষ্টরা জানালেন খৈই কাঠালি ( জ্যৈষ্ঠ হাঁড়ি জন্য) দেওয়ার জন্য তারা বছরের অন্য সময়ের চাইতে এ মাসে ও রমজান মাসে (ইফতারীর জন্য) রির্জাভ মিলে বেশী তাই এ সময়টাতে তাদের আয় রোজগারও ভালো হয়।এছাড়া এ ফলের মাসকে ঘীরে স্থানীয় বাজার গুলোতে একশ্রেণীর বেকার মানুষের কর্মসংস্থান হয়।গাড়িতে মাল উঠানো নামানো ছাড়াও তারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা পাইকারদের মাল কিনতে সহায়তা করে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হন। তাদের পাশা পাশি খৈই ও মুড়ির দোকান ও মিষ্টির দোকানে ক্রেতাদের ভীড় লক্ষ্যকরা যায়।এসব দোকান গুলোতে বছরের অন্য যে কোন সময়ের চাইতে এমাসে ও রমজান মাসে (ইফতারীর জন্য) বিক্রি ভালো হয় বলে জানালেন তারা ।
মন্তব্য করুন