মৌসুমী ব্যবসায়ী শীত এলেই নানা হাঁক ডাকে কদর বাড়ে ওদের
ইমাদ উদ দীন॥ ওরা শীত মৌসুমের ছোট পুঁজির ব্যবসায়ী। তাই মৌসুম এলেই শোনা যায় ওদের হাঁক ডাক। শীত এলেই ওরা বেরিয়ে পড়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে। ঘুরে গ্রাম থেকে গ্রামে। আর শহরের অলি গলিতে। পেট বাচাঁতে শেকড়ের সংস্কৃতি আকড়ে ধরে। প্রতি বছরই শীত মৌসুম এলে ওরা পৌঁছায় ব্যবসায়িক এলাকার গন্তব্যে। আর সেখানেই ওই বছরের জন্য অস্থায়ী বসত গড়ে যাত্রা শুরু করে ব্যবসার। কারণ ছোট পুঁজির বিনিয়োগে লাভ হয় ভালো। এমন স্বপ্ন প্রত্যাশায় তাদের ছুটে চলা। এটিই তাদের নেশা আর একমাত্র রেওয়াজী পেশা। এবছরও তাদের এমন বয়ে চলারীতির ব্যত্যয় ঘটেনি। গেল ক’য়দিন থেকে দেখা মিলছে ওদের। কানে আসছে তাদের চির চেনা হাঁক ডাক। মাথায় কিংবা কাধে বোজা নিয়ে নানা জাতের প্রয়োজনী সামগ্রী কিনার আওয়াজ দিচ্ছেন তারা। এমন আওয়াজে বেশ সাড়া দিচ্ছেন ক্রেতারাও। গেল প্রায় দু’সপ্তাহ থেকে এখন চোখে পড়ছে বেশি লেপ তোষক কারিগরদের। কাঁধে বোজা ও হাতিয়ার নিয়ে যথারীতি ঠান্ডার সকালে ওদের হাঁক ডাক আর আবেদন নিবেদন রাজাই তোষক বানানোর। তাদের এমন হাঁক ডাক আর তাগিদে গ্রামের গৃহীনি হিসাব কষেন আজই রাজাই তোষক বানানোর প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা। মৌলভীবাজার শহরের র্গীজাপাড়া, সৈয়ারপুর, লেকভিউ রোড ও সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ও চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের দু’টি গ্রামে দেখা মেলে এমন ৩-৪ জনের ক’টি দলের। তাদের একটির দলনেতা রাজশাহীর কবির আলী (৩০) ঠগবগে এ যুবকের সাথে আলাপে জানা হল এ শিল্পের সাথে তাদের সম্পৃক্ত হওয়ার আদ্যোপান্ত। অপেক্ষাকৃত কম বয়সি এ ৪ তরুণ তাদের অভ্যস্ত চির চেনা সেই গ্রামীণ রেওয়াজে বড় আওয়াজে এক সাথে হাঁক ডাক দিয়েই জানান-দিচ্ছেন শীত এসেছে আমরাও এসেছি। শীতের ধকল থেকে বাঁচতে উম আর উষ্ণতায় সকল উপকরণ নিয়ে। আর তারা নিবেদন করছেন প্রয়োজনীয় শীত নিবারনের ব্যাবহার্য কৃত্রিম উষ্ণতার উৎস তৈরীর। রাজাই তোষক জাযিম আর কতকি শিমুল কিংবা কার্পাস তুলা দিয়ে বানানো নানা ধরনের গরমের উৎস। ওরা জানালো মৌসুমী এ ব্যবসা তাদের পেশা। এটা ছাড়া অন্য কাজ তাদের জানা নেই। তাই এ ২-৩ মাসের আয় দিয়েই চলতে হয় সারা বছর। তাদের কাছে পুঁজি না থাকায় তারা শহরে বা স্থানীয় হাট বাজারে এ ব্যবসা খুলতে পারেন না। দোকান হলে সারা বছর কমবেশী বিক্রি হয় তাতে সংসার চালানো যেত। কিন্তু কম পুঁজি থাকায় তারা শীত মৌসুমে গ্রামে গ্রামে বেরিয়ে পড়েন। তারা জানালেন দেশের মধ্যে সিলেট অঞ্চলে এ ব্যবসা ভালো হওয়ায় তারা প্রতি বছরই এখানে ছুটে আসেন। তাদের এই হাঁক-ডাক শীত মৌসুমে গ্রাম বাংলার চির চেনা শেকড়ের সংস্কৃতি। গ্রামের লোকজন জানালেন, শীত এলেই এরকম গোয়াল ওয়ালা(গরুর হাতুড়ে ইউনানী ডাক্তার) ঘি চমচম ও হজমী ওয়ালা। শাড়ি কাপড় ওয়ালা,বাসন ও খেলানা ওয়ালা, মুড়ি ও লাড্ডু ওয়ালা, খেজুর ও আখের রস ওয়ালা, হাওয়ার মিঠাইওয়ালা, রাজাই ওয়ালা, বেদে পল্লীর লোকজনের সাপ খোঁজা ও বাঁতের বিষ ব্যাথার ঝাঁড় ফুঁক দেওয়া ও সোনা খোঁজ করে দেওয়ার লোকদের সরগরম হাক ডাকে শীতে আসে উষ্ণতা। এমন ফেরীওলা ব্যবসায়ীদের দলে পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি রয়েছেন নারীরাও। ওদের নানা ঢংয়ের নানা স্বরের নানা প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য সেই পুরাতন নিয়মে হাঁক ডাক বেশ ভালই লাগে। ওই দিনই দেখা মেলে বেদে পল্লীর সামীর নামের এক কিশোরের সাথে। তার অস্থায়ী নিবাস মৌলভীবাজার শহরের সৈয়ারপুরের নদীর পাড় এলাকায়। সে ও হাঁক ডাক দিচ্ছিল নিজস্ব ভঙ্গিমায়। তার ছোট কন্ঠে বড় আওয়াজ,আপনার সোনা রূপার নেক্লেস্ দুল, নোলক পানিত পড়লে থোকাই দিলাই। কিন্তু এমন আওয়াজ সারা গ্রামে বার বার দিলেও তাতে মেলেনী সাড়া এমনটি জানালো সে। কথা হল তার সাথে। তার পেশা ও জীবন জীবিকার নানা দিক নিয়ে। জানতে চাইলাম এখন তো আর কেউ পুকুরে সোনা পরে গোসলে যায়না এমনকি এরকম বিত্তবানরাও এখন নিজ বসত ঘরের বার্থরুমে গোসল সারেন। তাই পুকুরেত এখন আর আগের মত সচরাচর এমন অঘটন বা দূর্ঘটনা ঘটেনা। তাই এ পেশা ছেড়ে অন্য কিছু করা যায় কি না। সে আমার সব কথার সাথে একমত হয়ে বলল ভাই দশ গ্রাম ঘুরেও একজন ভুক্তভোগী পাইনা কিন্তু তার পরও বাপ দাদাদের সেই চিরচেনা শেকড়ের সংস্কৃতি ছাড়ি কিভাবে? তাই পেট বাঁচাতে এখন এ পেশার সাথে নানা জাতের মালা, তাবিজ, কবজ, জড়ি, তাগা, কড়া এগুলো বিক্রি করে কোন রকম ঠিকে আছি। কিশোর হলেও তার শেকড়ের সংস্কৃতির প্রতি অগাধ টান আর বিশ্বাস এমনটি অবাক করল উপস্থিত অন্যদেরকেও।
মন্তব্য করুন