যাপিত সময় এবং বর্তে থাকার পথ
সরওয়ার আহমদ॥ জীবন গতিশীল বলেই এখানে উৎকর্ষতার ছাপ বিদ্যমান। তার বিপরীতে এখানে প্রতিবন্ধকতা বা বিপর্যয়ও আছে। এই দ্বিমুখী প্রভাবকে ইন্দ্রীয়গ্রায্য করেই জীবনের ভেলা তরঙ্গসঙ্কুল জলাশয়ে ভাসমান। জীবনের মতো সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করাটাই যৌক্তিক। আদি প্রস্তর যুগ থেকে হাল আমলের বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতার যুগ পর্যন্ত বৈশ্বিক সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা গতিশীলতার ছোঁয়ায় যেমনি বিকশিত হয়েছে তেমনি প্রতিকূলতার অক্টোপাশে অঢ়লায়তনে ঘুরপাক ও খেয়েছে। এই অচলায়তনের বন্দীদশা থেকে উত্তরণের কৌশল নির্ণয় পূর্বক সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে চলার পথ হারায়নি বলেই আদি এবং আধুনিক যুগের মধ্যে এন্তার তফাৎ সূচিত হয়েছে।
সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার দ্বান্দিক অবস্থানকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সহজিয়া ঢং-এ বামপন্থীর রাজনীতিক প্রয়াত অধ্যাপক মোজ্জাফফর আহমদ বলেছিলেন- বিশ্বব্যবস্থাটা আলী এবং কালীর যুদ্ধের সমতুল্য। দুই মেরুর দুই লড়াকু মল্লযুদ্ধে লিপ্ত। এই যুদ্ধে একবার আলী তলে, আরেকবার কালী তলে। এই আলী কালীর যুদ্ধ অনন্ত কাল থেকে চলছে। ধরনী যতদিন টিকে আছে ততদিনই এ যুদ্ধ চলবে। মোদ্দা কথায়, প্রগতির পেছনে দুর্গতিও সক্রিয়। প্রগতির অগ্রযাত্রাকে দুর্গতি তার স্বভাব সুলভ হেঁচকাটানে ধরাশায়ী করতে উদ্যত। এ আলোকে পৃথিবীর হাজার হাজার বছরের ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে টেনে আনার পরিসর এখানে সীমিত এবং সে অভিজ্ঞানও লেখকের নেই। তাই হাজার বছরের উত্থান পতনের চিত্রাঙ্কণ অসম্ভব। তবে আট দশক আগের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালীন পেক্ষাপট এখনো অম্লান রয়েছে। বিশ্ববাসীকে এখনো সেই যুদ্ধের খেসারত বহন করতে হচ্ছে। এই উপমহাদেশে ৪৬/৪৭ সনের দেশভাগ জনিত সামাজিক বিভীশিখার খেসারতে কোটি কোটি মানুষ বিপন্ন ও ভিটেমাটি হারানোর দুর্বহ বেদনা উপমহাদেশের স্থানে স্থানে এখনও গুমরে মরছে। এই দুর্গতির রেশ নিঃশেষ হবার আগেই বাংলাদেশের মানচিত্রে নারকীয় এবং রক্তাক্ত তা-ব হচ্ছে দুর্গতির অন্যতম ছোঁবল। নব্বইয়ের দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্য ব্যাপী শুরু হওয়া দুর্গতির বলিরেখা কতদূর প্রসারিত হবে কে জানে? তবে বিশ্বব্যাপী দুর্গতির দুরন্ত দূত হচ্ছে কভিড নামীয় মুদ্রাতিক্ষুদ্র এক রোগজীবানু। এই পারমানবিক যুগে সকল আবিষ্কারকে নস্যিগণ্য করে ক্ষুদ্র এই রোগ জীবানু তার শক্তি মত্তা প্রদর্শনে কুন্ঠিত হয়নি। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবকে হারমানিয়ে কভিড প্রভাব গোটা বিশ্বকে শুধু তটস্থ করেনি, অচলায়তনেও নিক্ষেপ করেছে। যার ফসল হচ্ছে বৈশ্বিক মন্দা। এই বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে রুশ ইউক্রেনের যুদ্ধংদেহী দামামা যেনো আগুনে ঘৃতাহুতির সমতুল্য। বিশ্বনামক গ্লোবাল ভিলেজের পারস্পরিক নির্ভর শীলতাকে এই যুদ্ধ শুধু বিপন্নই করেনি, যুদ্ধজনিত কারণে পরাশক্তি সমূহের বাণিজ্যিক এবং আর্থিক অবরোধের প্রতিক্রিয়াতে উন্নায়শীল রাষ্ট্রগুলোর বারোটা বাজতে বোধ হয় দেরি নেই। দুর্গতির পরিবর্তে মহাদুর্গতির হাতছানি প্রসারিত হচ্ছে বিশ্ব চরাচরে। বিশ্ব ব্যাপী জ্বালানী সহ পণ্য সরবরাহের ঘাটতিকে উপলক্ষ্য হিসেবে খাড়া করে বাণিজ্যিক লুটেরা মহল জীবন যাত্রাকে ইতিমধ্যে ব্যাহত করে ফেলেছে। মুনাফার হস্ত প্রসারিত করে তারা জানান দিতে চাচ্ছে- রাজার হস্ত করে সমস্থ কাঙ্গালের ধন চুরি। তাই বিশ্বের উন্নয়ন শীল (পরনির্ভর) রাষ্ট্র সমূহের জীবন যাত্রায় শুধু ঝাকুনিই আসেনি ত্রাহি ত্রাহি অবস্থারও সূচনা হয়েছে। এই বিশ্ব বাস্তবতার বাহিরে নয় বাংলাদেশ ও। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব এখানেও হাতছানি দিচ্ছে তার স্বভাব সুলভ নিয়মে।
ক্রাইমিসের অভিধানিক অর্থ যাইহোক না কেনো মোদ্দা কথায় তার স্বরূপ হচ্ছে লুটেরাপণা। মানুষের দুই হাত থাকলেও দুর্মুখেরা বলেন হাত আছে আরেকটি এবং সেটি হচ্ছে অজুহাত। এই অজুহাত দ্বারা ভোক্তার পকেটের অর্থ কেড়ে নেয়াই হচ্ছে এতদ্দেশীয় ব্যবসায়ী মহলের মূল চরিত্র। বৈশ্বিক মন্দার অজুহাত তুলে মুনাফাকে মনোপলি করার লক্ষ্যে দেশীয় বাজারে দফায় দফায় পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে গ্রাহকের পকেট খালি করার মচ্ছব দূশ্যমান হয়ে উঠেছে। বাজারে গেলে তার নমুনা টের পাওয়া যায়। মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নি¤œবিত্ত ও স্বল্প বিত্তের ভোক্তামহলের কদম যেনো চলতে চায়না। পকেটের টাকা এবং পণ্যমূল্যের বাস্তবতার হিসাব মিলিয়ে ৭০% ভোক্তার মাথায় গোল চক্কর খেলা করে। বাজারে অঢেল পণ্য আছে কিন্তু গ্রাহকের পকেটে সে অনুপাতে টাকা কই? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা অনেকে। কিন্তু উত্তর এসে যায় বোধিজ্ঞান থেকে। ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করে গ্র্রাহক চাহিদা অনুপাতে যতটুকু পণ্যক্রয়ের প্রয়োজন রয়েছে তার অর্ধেক ক্রয় করছে। কেউ কিনছে একতৃতীয়াংশ। অর্থাৎ গ্রাহক ক্রমশ নিজ সামর্থ বিবেচনায় সাশ্রয়ী পথে অগ্রসর হচ্ছে। এ আলোকে মনে হয় সরকারি তরফে সাশ্রয়ী হবার আহবানটি সময়োচিত। আক্রার বাজারে বিকল্প পথের সন্ধানও শুরু হয়ে গেছে। গুড়ো দুধের মূল্য নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় অধিকাংশ মানুষ এখন লিকার চা পানে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। সোয়াবিনের মূল্য মাত্রা অতিক্রম করায় প্রামীণ গৃহিনীরা তেলছাড়া রান্নার ট্রায়ালে যাচ্ছে। পেয়াজের মূল্যে ভানুমতি খেল ধরায় কোন কোন এলাকার রাঁধুনীরা পেয়াজের স্থলে পেঁ পেঁ পিষে তরকারির ঘনত্ব নিশ্চিত করতো। বাজারে রুই মাছের কেজি ৩শ টাকা হওয়াতে নি¤œ বিত্তের ভোক্তারা ১৫০ টাকা কেজি মূল্যের তেলাপিয়াকেই মোক্ষ মনে করছে। হোটেলে এক প্লেট আখনিপোলাওয়ের মূল্য ১৫০ টাকা হওয়াতে সাধারণ ভোক্তা ফুটপাতের ৬০টাকা প্লেটের আখনির দিকেই ধাবিত হচ্ছে। এভাবে উদাহরণ টানলে আরো টানা যাবে। এ প্রক্রিয়াটা হচ্ছে ভোক্তা মহলের সাশ্রয়ী কৌশল এবং কোন ক্রমে বর্তে থাকার বিকল্প পথ। এই ধারাটা যদি বেগবান হয়, তাহলে মুনাফালোভীদের লাভের পাল্লাও ক্রমশ হালকা হয়ে উঠবে। কারণ বিক্রয় যোগ্য পণ্য যদি অশানুরূপ ভাবে বিক্রি না হয় তাহলে লাভের পরিবর্তে গচ্চাটাই মূখ্য হয়ে উঠার কথা।
সময়টা অতিক্রান্ত হচ্ছে বৈশ্বিক মন্দা এবং অস্থিতিশীলতার ঘেরাটোপে বন্দী অবস্থায়। গাঙ্গেঁয় এ বদ্বীপে ঘেরাটোপের উপস্থিতি নতুন নয়। মন্বন্তর, মঙ্গা, মহামারি, জলোচ্ছাস এবং দখলদারিত্বের বেষ্টনী অতিক্রম করে এতদ্দেশীয় পূর্ব সুরীরা স্বীয় অবস্থান ধরে রাখার নিরন্তর প্রয়াসে লিপ্ত হয়ে বিজয় ভেরি উড্ডিন করেছেন সংকল্পে অটল থেকে। উত্তরসুরী দেরকেও সে পথ অবলম্বন করতে হবে দুর্বার ইচ্ছা শক্তি নিয়ে। এ জন্য যথাযথ কৌশল অবলম্বন, নেতৃত্ব এবং জাতীয় ঐক্যের কোন বিকল্প নেই।
লেখক : সরওয়ার আহমদ, সিনিয়র সাংবাদিক, মৌলভীবাজার, মোবাইল : ০১৭১২০২৯২৩৬
মন্তব্য করুন