যুদ্ধের মজার গল্প
সায়েক আহমদ॥
মাহির প্রশ্ন
মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘২৫শে মার্চ আবার কিসের অনুষ্ঠান?’
আমি বললাম, ‘২৫শে মার্চ কালোরাত্রি, জানো তো?’
‘হ্যাঁ, জানি। কিন্তু এদিন আবার কিসের অনুষ্ঠান হবে?’
‘এদিন স্কুলে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত হবেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলবেন।’
‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প তো আমি পড়েছি। আমাদের বইয়ে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামালের যুদ্ধের কাহিনী আছে।’
‘হ্যাঁ, তা তো আছেই। বীরশ্রেষ্ঠ কয়জন জানো তো?’
‘জানি, ৭ জন।’
‘প্রত্যেক ক্লাসে একজন করে বীরশ্রেষ্ঠের যুদ্ধের কাহিনী আছে।’
‘কিন্তু তারা তো সবাই মারা গেছেন।’
‘হ্যাঁ, বীরশ্রেষ্ঠ ৭ জনই মারা গেছেন।’
‘তাহলে যিনি আসবেন, তিনি বেঁচে গেলেন কীভাবে?’
‘যুদ্ধে তো সকল মুক্তিযোদ্ধা মারা যাননি।’
‘তাহলে তারা কোথায়?’
‘তারা তো আমাদের আশেপাশেই আছেন।’
‘তাহলে আমরা কেন তাদেরকে দেখতে পাচ্ছি না?’
‘এটা আমাদেরই বিরাট ভুল। আমরা তো মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তোমাদের সাথে পরিচয় করিয়েই দেইনি। তাইতো তোমরা মুক্তিযোদ্ধাদের চেন না।’
‘তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে আছে?’
‘হ্যাঁ, তবে এখন আর সবাই বেঁচে নেই।’
‘কেন?’
‘আমরা স্বাধীন হয়েছি প্রায় ৪৮ বছর আগে। যারা এখনও বেঁচে আছেন, তাদের বয়স ৭০ বছরের কম নয়। আমাদের দেশের লোকেরা তো এতদিন বাঁচে না।’
‘তাহলে কতজন মুক্তিযোদ্ধা এখনো বেঁচে আছেন?’
‘তাতো জানি না মা।’
‘যারা বেঁচে আছেন, তারা কেন আমাদের সামনে আসেন না?’
‘আমরা তো কখনো তাদেরকে ডেকে এনে তোমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেইনি। হয়তো তাই।’
‘কেন?’
মাহির এ প্রশ্নে থমকে যেতে হল। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি আমরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এনে নিয়মিত স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারতাম তাহলে খুবই ভাল হত। বিশেষ করে জাতীয় দিবসগুলোতে তো এ ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে।
মাহি আবার বলল, ‘মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছেন। কিন্তু তারাও তো আমাদেরকে এসে দেখে যেতে পারেন।’
আমি বললাম, ‘তাদের হয়তো আসার ইচ্ছে আছে, কিন্তু লজ্জায় আসেন না।’
‘লজ্জায়! কেন?’
‘কারণ, এখন মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বেশি।’
‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আবার কারা?’
‘যারা মুক্তিযুদ্ধ না করেও এখন মুক্তিযোদ্ধা সেজে বসে আছে।’
‘এটা কিভাবে হল?’
‘এটাও আমাদের ব্যর্থতা। আমরাই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছি।’
‘কিন্তু কেন?’
মাহির কথার উত্তর দিতে গিয়ে আবারো আমাকে থমকে যেতে হল।
আমার মেয়ে মাহি। পড়ে ক্লাস থ্রিতে। তার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আমি তাকে পড়াই অদ্ভুতভাবে। কেউ দেখলে ভাববে বাপ-মেয়েতে তুমুল আড্ডা হচ্ছে। তার মা তো প্রায়ই আমার সাথে ঝগড়াঝাটি করেন। পড়ার সময় এত গল্প কিসের!
ছোটবেলা থেকেই তাকে গল্পের ছলে বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, বঙ্গবন্ধুর গল্প ইত্যাদি বলতাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, তার মধ্যে দেশপ্রেম, বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালবাসা, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বসূচক কাহিনী ইত্যাদির প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে তার প্রশ্নবাণে বারবার আটকে যেতে হয়।
আমি অনেক ভেবে উত্তর দিলাম, ‘আমাদের দেশে কিছু খারাপ লোক আছে। এরাই সত্যকে মিথ্যা দিয়ে সাজায়।’
‘তাহলে এদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে না কেন?’
‘এদেরকে চেনা যায় না। এরা সবার সাথে মিশে থাকে। ১৭৫৭ সালে এদেরকে দেখা গিয়েছিল মীর জাফর রূপে। ১৯৭১ সালে এদেরকেই আবার দেখা গেছে রাজাকার হিসেবে। আর স্বাধীন বাংলাদেশে এরা আমাদের আশেপাশেই আছে। তবে তাদেরকে চেনা যায় না। ওরা আমাদের মাঝেই মিশে আছে।’
আমার বক্তব্য শুনে মাহি কি বুঝল জানি না। তবে মাথা নেড়ে বলল, ‘আচ্ছা আব্বু। তোমার কথা তো বুঝলাম। কিন্তু আমাদের স্কুলে যিনি আসবেন তিনি কি সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা?’
‘অবশ্যই। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতিক খেতাব প্রদান করা হয়েছে।’
‘তিনি একজন বীরপ্রতিক?’
‘হ্যাঁ। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ৬৭৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মানসূচক খেতাব প্রদান করেছেন। এর মধ্যে তিনিও একজন।’
‘৬৭৬ জন কি এখনও বেঁচে আছেন?’
‘না। তুমি তো জান ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠই মুক্তিযুদ্ধে প্রচন্ড সাহস ও বীরত্ব দেখিয়েছেন। তবে দেশকে স্বাধীন করার জন্য তারা যুদ্ধের সময়ই প্রাণ হারিয়েছেন। আর বাকীরা বয়সের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন।’
‘এখন কতজন বেঁচে আছেন।’
‘এখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধাই বেঁচে আছেন। খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে সম্ভবত শতাধিক এখনও বেঁচে আছেন। তবে তাদের বেশিরভাগই বয়সের ভারে হাঁটতে চলতে পারেন না। কেউ কেউ বিছানায় পড়ে থাকেন। কেউবা হুইল চেয়ারের সাহায্যে চলাফেরা করেন।’
‘যিনি আমাদের স্কুলে আসবেন তার নাম কি?’
‘তিনি হচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক।’
‘তিনি কি হুইল চেয়ারে আসবেন?’
‘না, তিনি এখনও চলাফেরা করতে পারেন।’
‘তাঁর মত কতজন চলাফেরা করতে পারেন?’
‘খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার মনে হয় ১০/১৫ জনের বেশি হবে না।’
হঠাৎ রান্নাঘর থেকে ভেসে এল মাহির আম্মুর কণ্ঠ, ‘মাহি, এদিকে আসো তো মা।’ মাহির বোধহয় আরো অনেক কিছু জানার বাকী ছিল। আমি সেটা বুঝতে পেরে বললাম, ‘তোমাকে সবকিছু জানাবো মা। এগুলো তো তোমাদেরকে এখনই জানতে হবে। এখন যাও, তোমার আম্মু কি জন্য ডাকছেন, তা দেখে আসো।’
মাহি রান্নাঘরে চলে গেল। আমিও হারিয়ে গেলাম ১৯৭১ সালে। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল ভয়াবহ যুদ্ধের চিত্র। একটি সুশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাণপন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা। মাত্র অল্প কয়েকদিনের যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে এরাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে শক্তিশালী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। যে কৃষক ধান চাষ ছাড়া কিছুই জানত না, আজ তার হাতেই উঠে এসেছে জীর্ণ-মলিন পুরাতন রাইফেল। যে শ্রমিক শ্রমের বিনিময়ে আয় রোজগার করত, সেই কিনা আজ গেরিলা হামলা চালাচ্ছে। যে ছাত্র-যুবক পড়াশোনা-আড্ডায় মেতে থাকত, তারাই আজ বন বাদাড় দাপিয়ে হানাদার বাহিনীর উপর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নিরীহ জনতা আজ জীবনমরণ যুদ্ধে লিপ্ত। সবার কণ্ঠে একই শপথ দেশকে স্বাধীন করতে হবে। হানাদার বাহিনীকে দেশ থেকে তাড়াতে হবে। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতার পাশাপাশি প্রাণপন যুদ্ধ করছে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা। মাত্র নয়মাস ভয়াবহ যুদ্ধ করে, ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে আমাদের দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা সারাবিশ্বে উঁচিয়ে ধরেছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। বিশ্বের মানচিত্রে অঙ্কন করেছে বাংলাদেশের ছবি। সেই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তো আমরা অবমূল্যায়ন করতে পারি না। যারা বেঁচে আছেন, তারাই বা আর কয়দিন বাঁচবেন। তাই তারা বেঁচে থাকতে থাকতেই আমাদের উচিত তাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করা। এ ব্যাপারে আমাদেরকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসার এখনই সময়।
মন্তব্য করুন