যুদ্ধের মজার গল্প-১০
সায়েক আহমদ॥
বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি
এপ্রিল মাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক প্রচণ্ড খুশি হয়ে আমাকে ফোন করে বললেন, ‘সায়েক সাহেব, একটা খুশির সংবাদ আছে।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শুনে খুশি হলাম। এবার খুশির সংবাদটা কী তা বলেন।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘মৌলভীবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমি লেখালেখি ও সামগ্রিক কর্মকান্ডের জন্য গত ৬.৪.১৯ইং তারিখে আমাকে গুণীজন হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেছেন।’
আমি বললাম, ‘অবশ্যই এটি একটি আনন্দের সংবাদ। এ ধরণের একটি উদ্যোগ গ্রহণের জন্য মৌলভীবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমিকে ধন্যবাদ জানাই।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আমি বেশ কিছু যাত্রা এবং নাটক রচনা করেছিলাম। যাত্রাশিল্পে অবদান রাখার জন্য তারা আমাকে মূল্যায়ন করেছেন।’
আমি বললাম, ‘আপনার এ প্রতিভার কথা আপনি তো আগে কখনো বলেননি।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক বললেন, ‘আসলে মুক্তিযুদ্ধের গল্প করতে করতে এসব কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।’
আমি বললাম, ‘আপনার আম্মা এবং বড়ভাইয়ের কাছ থেকে জেনেছিলাম আপনি ছোটবেলায় বেশ কিছু কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখেছেন।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। আমি ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম এবং লিখতাম। নাটক, কবিতা, গল্প, জারিগান, সারিগানসহ অনেক কিছুই রচনা করেছি আমি। আমার লেখা মূলত আদর্শভিত্তিক, দেশাত্ববোধক, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এবং ভক্তিমূলক। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা কর্তৃক আমার রচিত ও নির্দেশিত যাত্রাপালা ‘বীরের জননী’ ঢাকা শিল্পকলা একাডেমী যাত্রামঞ্চেও মঞ্চায়ন হয়েছিল। তারাও নাট্যকার হিসেবে আমার যথেষ্ট প্রশংসা করেছিলেন।’
আমি বললাম, ‘একজন বীরপ্রতিক হিসেবে আপনার এসব গুণাবলী তো বেশি বেশি করে প্রকাশ করতে হবে। আপনার লেখালেখি প্রসঙ্গে কিছু স্মৃতিচারণ করুন তো।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘কী আর বলব। বয়স হয়ে গেছে। সব সময় সব কিছু মনেও থাকে না। আপনি যখন জানতে চাইছেন তখন একটু বলি। আমি মূলত বড় হয়েছি গ্রামীণ পরিবেশে । ষাটের দশকের শুরুতে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কেউই সাহিত্য রচনার কথা কল্পনাও করতে পারত না। মূলতঃ গ্রামাঞ্চলে তখনও পুঁথি সাহিত্যের ধারা বিদ্যমান ছিল। ঐ পরিবেশেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত আমাদের স্কুলে প্রতি বৃহস্পতিবার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। একদিন আমি উৎসাহবশত সারিগান কিংবা কবিতা লিখে বাংলা শিক্ষকের নিকট জমা দিয়েছিলাম। তিনি তো এসব দেখে রেগে অগ্নিশর্মা। কারণ তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেননি যে এগুলো আমিই লিখেছি। ভেবেছিলেন আমি বোধহয় কোন বইটই থেকে নকল করে এসব লিখেছি। কাজেই এত অল্প বয়সে নকলবাজ হিসেবে আমি বিনা অপরাধেই শিক্ষকের নিকট মহাঅপরাধী বনে গেলাম। ফলশ্রতিতে আমার ভাগ্যে শাস্তিই জুটল।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘পরবর্তীতে কি আপনি আপনার লেখালেখি চালিয়ে গেছেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে আমি স্বতঃস্ফুর্তভাবে লিখতে থাকি। কখনও কবিতা, কখনও নাটক, কখনও প্রবন্ধ, অর্থাৎ যখন যা ইচ্ছে হয় তাই লিখতে থাকি।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন পত্র-পত্রিকায় কি লেখাগুলো প্রকাশ করেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘এগুলো তো আমি লিখেছি আবেগতাড়িত হয়ে, মনের খুশিতে। তাইতো কখনও এগুলো প্রকাশ করার চিন্তা মাথায় আসেনি।’
আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার লেখালেখির বিষয়বস্তু কী ছিল?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে আমার লেখালেখির মূল বিষয়বস্তু ছিল মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও দেশাত্ববোধক ভাবনাসমূহ। কাজেই আমার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক রচনাসমূহে বেশিরভাগই আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি এবং সমসাময়িক বাস্তব দৃশ্যসমূহ ফুটে উঠেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা এবং ভালবাসাও প্রকাশ পেয়েছে। আমার রচনায় এমন কিছু বিষয় প্রকাশ পেয়েছে, যা ছিল কঠোর গোপনীয়। বিশেষ করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত, তখন অতি বিপ্লবী, লোভী এবং বেশি বেশি প্রমোশনের জন্য ব্যস্ত মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপপ্রচার শুরু করেছিলেন। এসব চিত্র খুব কমই প্রচারমাধ্যমে স্থান পেয়েছে। আমার লেখায় সেসব সিক্রেট তথ্যও উঠে এসেছে। আমার এসব লেখা নিয়ে একবার আমি সরাসরি বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎও করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধ নামে দুটি পাণ্ডুলিপিও আমি তৈরি করেছি।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনি সরাসরি দেখা করেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘হ্যাঁ।’
আমি বললাম, ‘তাহলে ঘটনাটি বলুন তো।’
ফোরকানউদ্দিন বলতে শুরু করলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে সরাসরি দেখা করার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। দেশ স¦াধীন হওয়ার পর আমি আমার ভাবনাগুলো লিখতে থাকি। হঠাৎ আমার লেখাগুলো তৎকালীন সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর নওয়াজেশ উদ্দিনের নজরে পড়ে। আমি লিখেছিলাম দেশ আজ তিন দলে বিভক্ত। ক দলে আছে লোভী মুক্তিযোদ্ধা ও লোভী আওয়ামী লীগ নেতা/কর্মী। খ দলে আছে পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তা/কর্মচারী ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এবং গ দলে আছে দেশপ্রেমিক সৎ মুক্তিযোদ্ধা ও সৎ আওয়ামী লীগ নেতা/কর্মী। ক ও খ দলের স্বার্থান্বেষীরা একজোট হয়ে গ দলকে চরম আঘাত করছে। নওয়াজেশ উদ্দিন সাহেব আমাকে উৎসাহিত করেন লেখালেখির জন্য। তাঁরই উৎসাহে আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে সরাসরি দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করি। তিনি আমাকে ও সুবেদার মাজহারুল হককে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।’
আমি বিস্ময় গোপন না রেখেই বললাম, ‘এটা তো একটা বিরাট ঘটনা। বঙ্গবন্ধু কি আপনাদের সাথে দেখা করেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধু আমাদের সাথে দেখা করেছিলেন।’
আমি বললাম, ‘তাহলে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার পর তাঁর সাথে কী কী কথাবার্তা হয়েছিল, তা একটু বলুন তো।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আমাদেরকে দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোরা রংপুর থেকে এসেছিস? নওয়াজেশ আসেনি কেন?’
বঙ্গবন্ধুর সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের বুকটা ধড়াশ ধড়াশ করে কাঁপছিল। আমিও প্রচণ্ড নার্ভাস ছিলাম। সে অবস্থায়ও আমি সাহস করে আমার লিখিত ফাইলটি বঙ্গবন্ধুর হাতে দিয়ে বললাম, ‘উনি আমাদেরকে আপনার সাথে দেখা করার জন্য পাঠিয়েছেন।’
বঙ্গবন্ধু আমাকে শিশু ফোরকান মনে করলেন। আমি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা একথা তিনি মোটেই মনে আনেননি। আমার লেখা পড়ে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা তুই লিখেছিস?’
কাঁপতে কাঁপতে আমার মুখ দিয়ে শুধু একটি শব্দ বের হল, ‘জ্বী!’
বঙ্গবন্ধু আমার লেখাটি পড়ে ভরাট এবং গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তুই ছেলে মানুষ। এত সব ভাবনা কিসের? বাঙ্গালী বাঙ্গালীর শত্রু হতে পারে না।’
বঙ্গবন্ধুর কথার উত্তরে আমার মুখ দিয়ে আর কোন কথাই বের হল না। তবে বঙ্গবন্ধু আমাকে যেভাবে আদর-স্নেহ করেছেন, যেভাবে কথা বলেছেন, আমার কাছে মনে হয়েছে যেন তিনি একটি শিশুর সাথেই আদর করে কথা বলছেন। আসলে আমার বয়স ছিল তখন মাত্র ২২। আমার গঠন ছিল সদ্য-তরুণ একজন কিশোরের মত। আমার অনুভূতি ছিল, আমি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ত উনি তা মনেই করছেন না। আমার মনে হয়েছে আমি যেন আমার বাড়িতেই আছি। বঙ্গবন্ধু যেন আমার একজন পরম শ্রদ্ধেয় অভিভাবক। যতক্ষণ ছিলাম আদর আপ্যায়নে মনে হয়েছিল আমি বঙ্গবন্ধুর পরিবারেরই একজন সদস্য।
বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য আমরা সর্বমোট পাঁচজন গিয়েছিলাম। আসার সময় তিনি আমার হাতে সবার জন্য ৫০০ টাকা দিয়ে বললেন, ‘তোর সাব-সেক্টর কমান্ডারকে বলিস আমার সাথে সে যেন দেখা করে।’
এতটুকু কথা বলে ফোরকানউদ্দিন একটু থামলেন। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘এরপর কি আর বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনার দেখা হয়েছিল?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তরে বললেন, ‘না। তবে বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছানোর জন্য আমার লেখা ১৪টি পয়েন্ট নিয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক চিত্তরঞ্জন দত্ত বীর উত্তম।’
আমি বললাম, ‘সে ঘটনাটা একটু বলুন তো।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘বিডিআরের নিয়মিত দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন তৎকালীন মহাপরিচালক। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে লিখা আমার ১৪টি পয়েন্ট তুলে ধরেছিলাম। মহাপরিচালক মহোদয় আমার দেয়া ১৪টি পয়েন্ট ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করেন এবং প্রেসিডেন্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে দেখা হলে এ বিষয়ে কথা বলবেন বলে আমাকে জানিয়েছিলেন।’
মন্তব্য করুন