যুদ্ধের মজার গল্প-১১
সায়েক আহমদ॥
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক ঃ জীবন ও সাহিত্য
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিকের সাথে টেলিফোনে আমার কথা হচ্ছিল। এতক্ষণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর সরাসরি সাক্ষাতের ঘটনাটি আমাকে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন।
এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি শুনেছি নাট্যকার হিসেবে আপনি নাকি খুব জনপ্রিয় ছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘ঠিকই শুনেছেন। এক সময় নাট্যকার হিসেবেও আমার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ছিল। ১৯৯৪ সালে আমার রচিত “টুঙ্গীপাড়ার মাজার” নাটকটি শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং মৌলভীবাজার পৌরসভা মাঠে মঞ্চস্থ হয়েছিল। নাটকটি সর্বসাধারণের প্রশংসা অর্জনেও সক্ষম হয়েছিল। অনেকগুলো নাটক ও যাত্রাপালার পাণ্ডুলিপিও আমি তৈরি করেছিলাম।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাই নাকি? কয়েকটির নাম বলুন তো।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘সবগুলোর নাম তো এ মুহূর্তে বলতে পারব না। তবে এগুলোর মধ্যে টুঙ্গীপাড়ার মাজার, বীরের জননী, দুখিনী বাংলা মা, অভিভাদন, ফুটন্ত গোলাপ, মহামানব, মরণের মাঝে, ফিরিয়ে দাও আমার মাণিক, কে দেবে জবাব ও মানুষ নামে জানোয়ার আমার উল্লেখযোগ্য রচনা।’
আমি বললাম, ‘আপনার নাটক ও যাত্রাপালা মঞ্চায়নের ব্যাপারে কে কে সহযোগিতা করেছিলেন এবং মঞ্চায়নের সেই স্মৃতিগুলো একটু উল্লেখ করুন তো।’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘এ প্রসঙ্গে বলতে গেলে সবার আগে বলতে হবে প্রয়াত সমাজকল্যাণ মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসীন আলীর কথা। তিনি তখন মৌলভীবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৯৪ সালে আমার রচিত “টুঙ্গীপাড়ার মাজার” যাত্রাপালাটি শ্রীমঙ্গলের রাধানাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মঞ্চস্থ হয়েছিল। এতে তৎকালীন জাতীয় সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এমপি, শ্রীমঙ্গল বিডিআর (বিজিবি) ব্যাটেলিয়ান কমাণ্ডার মেজর নাসিমসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। বিষয়টি জানতে পেরে সৈয়দ মহসীন আলী “টুঙ্গীপাড়ার মাজার” যাত্রাপালাটি মৌলভীবাজার পৌরসভা মাঠে নিজ উদ্যোগে এবং নিজ অর্থায়নে মঞ্চস্থ করে সাহসী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সৈয়দ মহসীন আলীর সাথে আপনার প্রথম পরিচয় কীভাবে হয়েছিল?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘তখন আমি শ্রীমঙ্গল বাডস রেসিডেন্সিয়েল মডেল হাইস্কুলের শরীরচর্চা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। জাতীয় স্কুল ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জেলা পর্যায়ের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমি বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ঐ প্রতিযোগিতায় আমার তত্ত্বাবধানে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রচুর পুরস্কার অর্জন করেছিল। অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের পুরস্কার গ্রহণের জন্য আমাকে আহ্বান জানানো হয়েছিল। ঐ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সৈয়দ মহসীন আলী উপস্থিত ছিলেন। তখনো তিনি আমাকে চিনতেন না। উপস্থিত সুধীবৃন্দের মধ্যে একজন আমার পরিচয় দিয়ে তাকে যখন জানালেন আমি একজন খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, তখন সৈয়দ মহসীন আলী অকস্মাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘একজন বীরপ্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা কেন দর্শকের আসনে বসে থাকবেন?’
তারপর তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি তো আপনার পরিচয়টুকু আমাকে জানাননি?’
আমি তখন বিনয়ের সাথে বললাম, ‘জনাব, এই পরিচয়টুকুর মূলায়ন তো সকল জায়গায় হয় না। অনেক কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পার্থক্যটুকু হয় বুঝেন না কিংবা মূল্যায়ন করতে রাজী থাকেন না।’
তখন সৈয়দ মহসীন আলী আবেগে আপ্লুত হয়ে মাইক্রোফোনটা নিজ হাতে নিয়ে উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘একজন বীরপ্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা কোন মূল্যায়ন না করে দর্শকের আসনে বসিয়ে অনুষ্ঠান করছি। জাতি হিসেবে আমরা আর কবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মান জানাতে পারব?’ এটুকু বলেই তিনি আবেগে আর কোন কথা বলতে পারলেন না। সবাই অবাক হয়ে দেখলেন এ মহান ব্যক্তিটির দুচোখ পানিতে ভরে গেছে। একটু থেমে তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন। তারপর বললেন, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পুরস্কার নিয়ে অনেক দূর দূরান্তে যেতে হবে। কাজেই আমি আগামী ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিককে প্রধান অতিথি করে অনুষ্ঠান করব, ইনশাল্লাহ!’
আমি মনে মনে ভেবেছিলাম হয়ত তিনি আমাকে সম্মানিত করার জন্য কথাটি ঐ মুহূর্তে বলেছিলেন। কিন্তু ২০ মার্চ মৌলভীবাজার পৌরসভা থেকে একটি চিঠি পেলাম। সেই চিঠিতে আমাকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানসূচি উল্লেখ করা আছে। চিঠিটি পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে আমার দুচোখ বেয়ে পানি চলে এল।
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি ঐ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘জ্বী। আমি ২৬ মার্চ অনুষ্ঠান শুরুর আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। নির্দিষ্ট সময়ে আমাকে প্রধান অতিথির আসনে বসিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হল। ঐ অনুষ্ঠানে তৎকালীন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য জনাব গিয়াসউদ্দিন মহোদয় উপস্থিত হয়ে প্রধান অতিথির আসনে আমাকে দেখে চমকে গেলেন। তিনি সৈয়দ মহসীন আলীকে প্রশ্ন করলেন, ‘মহসীন তুমি কাকে প্রধান অতিথি করেছো?’
সৈয়দ মহসীন আলী সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নীরব থাকলেন। আবারো একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে তিনি এমপি সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন আমি কাকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত করেছি।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এরপর কি কোন বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘অবশ্যই। আমি লক্ষ করেছিলাম উপস্থিত অনেকেই আমাকে প্রধান অতিথির আসনে উপবিষ্ট থাকতে দেখে বিরক্তি বোধ করছিলেন। কারণ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন একমাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসীন আলী ছাড়া আর কেউই উপলব্ধি করার কথা নয়। যখন আমি আমার বক্তব্য শুরু করলাম এবং যুদ্ধের বাস্তব কাহিনী, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ইত্যাদি বলা শুরু করলাম, তখন উপস্থিত সুধীবৃন্দ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। আমি লক্ষ করলাম তারা মনোযোগ সহকারে আমার বক্তব্য শুনছেন। কিন্তু এমপি সাহেব বোধহয় সেটা পছন্দ করছিলেন না। কারণ তিনি আমার বক্তব্যে বারবার বাঁধার সৃষ্টি করছিলেন। এটা দেখে বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসীন আলী আমাকে উদ্দেশ্য করে জোর গলায় বললেন, ‘বীরপ্রতিক ফোরকানউদ্দিন, আপনার বক্তব্য চালিয়ে যান। আমরা আপনার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে চাই।’ সৈয়দ মহসীন আলীর কথা শুনে উপস্থিত সুধীবৃন্দ তীব্র করতালির মাধ্যমে আমাকে বক্তব্য চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। আমি আমার বক্তব্য চালিয়ে যেতে থাকলাম। বক্তব্যের মাঝামাঝি পর্যায়ে হঠাৎ সৈয়দ মহসীন আলী আমার হাত থেকে মাইক্রোফোনটা নিয়ে গেলেন। আমি একটু থমকে গেলাম। ভাবলাম আবার কোন সমস্যার সৃষ্টি হল নাকি? কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি সাথে সাথে ঘোষণা দিলেন, ‘আজান এবং নামাজের জন্য আধা ঘন্টা সাময়িক বিরতির ঘোষণা দিলাম। নামাজ শেষে আমরা আবার প্রধান অতিথির বক্তব্যের বাকী অংশটুকু শুনব।’
বিরতি ঘোষণার সাথে সাথেই হঠাৎ সুধীবৃন্দের একাংশ আমাকে ঘিরে ধরলেন। আমি তো অবাক। অনেকে বললেন, ‘ফোরকান সাহেব, আমাদেরকে কেউ কেউ ভুল বুঝিয়েছিলেন। আমরা ভেবেছি আপনি বোধহয় মহসীন সাহেবের আত্মীয়। কিন্তু আপনার বক্তব্য শুনে এখন আমাদের সব ভুল ভেঙ্গে গেল। আমরা বুঝতে পারলাম মহসীন আলী কখনো লোক চিনতে ভুল করেন না। আমি আরো লক্ষ করলাম এমপি সাহেবেরও ভুলটি ভেঙ্গে গেছে। উনি কিছুটা লজ্জ্বিত হয়েও আমার প্রশংসা করতে ভুল করেননি। এটা অবশ্যই আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবিতা কেমন লিখেছেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘আগেই বলেছি স্কুলজীবন থেকেই আমি কবিতা লিখতাম। শিক্ষকরা বিশ্বাসই করতেন না যে এগুলো আমি লিখেছি। তবে সেজন্য আমি কবিতা লেখা বন্ধ করে দেইনি। স্বাধীনতার পরও আমার কবিতা লেখা অব্যাহত থাকে। যেহেতু আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, স্বাভাবিক কারণেই আমার কবিতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রবন্ধ লিখেছেন?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘লিখেছি, তবে সংখ্যায় অল্প। এগুলো আসলে আমি প্রবন্ধ আকারে প্রস্তুত করিনি। মনের উপলব্ধি থেকেই লিখে গিয়েছিলাম। লেখার পর দেখা গেল এগুলোতে সমসাময়িক অনেক বিষয় ফুটে উঠেছে।’
আমি বললাম, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরপ্রতিক হিসেবে সরকারিভাবে আপনার লেখালেখির কি মূল্যায়ন করা হয়েছে? অর্থাৎ লেখালেখির জন্য সরকারিভাবে কোন স্বীকৃতি পেয়েছেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘অবশ্যই। ১৯৯৬ সালে আমি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নাটক, কবিতা ইত্যাদি রচনাসমূহ জমা দিয়েছিলাম। উক্ত রচনাসমূহ সাদরে গৃহীত হয়েছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশ সরকার আমাকে লেখালেখির কারণে আলাদাভাবে সম্মানীভাতা প্রদান করতে থাকেন। এটা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া এবং বিরাট স্বীকৃতি। প্রথমে মাসিক ৪০০ টাকা হারে সম্মানী প্রদান করা হত। বর্তমানে মাসিক ১২০০ টাকা হারে সম্মানী পেয়ে যাচ্ছি। এ কারণেই আমি আমার লেখাগুলো কোথাও প্রকাশ করার তাগিদ অনুভব করিনি।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কি আপনার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘প্রতি বছরই তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেন। আমরা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাই। একান্তে আমাদের মনের অনুভূতিসমূহ ব্যক্ত করি।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আপনার চিন্তা-ভাবনা ব্যক্ত করার সুযোগ পেয়েছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘জ্বী। ২০১৫ সালের ২১শে নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে আমি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা এবং আমার কর্মপরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করে মৌখিক এবং লিখিত বক্তব্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট সরাসরি উপস্থাপন করেছিলাম।’
আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি আপনার বক্তব্য গ্রহণ করেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘অবশ্যই। ২০১৬ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রেরিত পত্রে জানতে পারি, উল্লেখিত বিষয়াদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনায় অনুমোদিত হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করবে। এ অভূতপূর্ব ঘটনায় আমি নিজেকে চরম সৌভাগ্যবান মনে করি। এতে করে এই বৃদ্ধ বয়সেও আমি তরুণদের মত কর্মস্পৃহা অর্জন করেছি।’
কথা বলার সময় ফোরকানউদ্দিন একটু আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। তাই একটু থেমে তিনি আবারো বলতে থাকলেন, ‘সায়েক সাহেব, আমাদের তরী ঘাটে ভিড়তে আর বেশি সময় বাকী নেই। এখন যে সামান্য সময়টুকু আছে, আমরা বেঁচে থাকতে থাকতে সে উদ্যোগটি আপনারা গ্রহণ করুন। আমি চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে নতুন প্রজন্মকে এখন থেকেই গড়ে তুলতে হবে। তাদেরকে সেই গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো উপলব্ধি করানোর জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে সপ্তাহে একদিন হলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি ক্লাস করানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমি মনে করি। সেই ক্লাসে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের যুদ্ধের স্মৃতি এবং যুদ্ধকালীন সত্য ঘটনাগুলো তুলে ধরবেন। তাঁরা শিক্ষার্থীদেরকে চিনিয়ে দেবেন কারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল, আর কারা রাজাকার ছিল। এতে করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত হবে। নতুন প্রজন্মই গড়ে তুলবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। দেশ হবে দূর্নীতিমুক্ত। গড়ে উঠবে দেশপ্রেমিক প্রজন্ম।’
ফোনে আলাপ করার কয়েকদিন পর এক সুযোগে ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক এর বাসায় গেলাম। তাঁর লেখাসমূহ দেখলাম। হঠাৎ মাথায় এল, বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে তাঁর লেখাসমূহ পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন। এ চিন্তা থেকেই তাঁকে উৎসাহিত করলাম যুদ্ধের স্মৃতিচারণগুলো যখন যা মনে আসে তা একটি ডায়রীতে লিখে রাখার জন্য। দুটি ডায়রীও তাঁকে উপহার দিলাম। তিনিও প্রচন্ড উৎসাহিত হলেন। আমার কথা রাখলেন। যখন যা মনে আসে তাই তিনি সেই ডায়রীগুলোতে লিখে রাখতে শুরু করলেন। আমিও আমার কাজ শুরু করে দিলাম।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিককে সম্মাননা প্রদান করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলার জন্য অনুরোধ করা হয়, তখন শিক্ষার্থীরা খুব আগ্রহ সহকারে তাঁর কথাগুলো শোনে। এরই সূত্র ধরে একদিন বন্ধুবর অধ্যাপক অবিনাশ আচার্যের সাথে পরামর্শ করে ফোরকানউদ্দিনের জীবন ও সাহিত্যের উপর একটি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করলাম। বন্ধুবর কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক অধ্যাপক অবিনাশ আচার্য এতে সার্বিক সহায়তা করলেন। বইটি সম্পাদনার কাজটি আমি নিজেই করলাম। জুন মাসেই ‘বীরপ্রতিক ফোরকানউদ্দিন ঃ জীবন ও সাহিত্য’ নামে একটি অপূর্ব গ্রন্থ প্রকাশ করা সম্ভব হল। বাংলাদেশের পতাকার রঙে রঙিন হল বইটির প্রচ্ছদ। অবিনাশ আচার্য প্রচণ্ড পরিশ্রম করে বইটির মনোমুগ্ধকর প্রচ্ছদটি তৈরি করেছিলেন।
বইটির শুরুতেই আমি ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক ঃ এক নজরে জীবনযুদ্ধের ইতিহাস’ শিরোনামে ১০ পৃষ্টার একটি ভূমিকা লিখে দিয়েছিলাম। এতে ফোরকানউদ্দিনের জন্ম ও শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন ও খেতাবপ্রাপ্তি সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেছিলাম। যে যুদ্ধে ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক খেতাব অর্জন করেছিলেন সে যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনাও লিখে দিয়েছিলাম। ফোরকানউদ্দিনের সাহিত্য রচনার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও তুলে ধরেছিলাম।
বইটিতে ফোরকানউদ্দিনের কিছু কবিতা, প্রবন্ধ, একান্ত চিন্তাভাবনা এবং মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মৃতিচারণমূলক লেখাও প্রকাশিত হয়েছিল। মোট কথা মাত্র তিন ফর্মার এ বইটিতে সংক্ষেপে ফোরকানউদ্দিনের জীবন ও সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা সম্ভব হয়েছিল।
গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন স্কুলের প্রতিষ্ঠানপ্রধানগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলেন। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক কামরুল হাসান, প্রধান শিক্ষক অনুপ দত্ত, প্রধান শিক্ষক খালেদ মো. আব্দুল বাসিতসহ অনেকেই এ ব্যাপারে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলেন। তারা বইগুলো উৎসাহের সাথে গ্রহণ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করলেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও প্রচন্ড আগ্রহ লক্ষ্য করা গেল। মূলতঃ ফোরকানউদ্দিনের যুদ্ধের রোমাঞ্চকর ঘটনাসমূহ, তার জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং তার সাহিত্য রচনা সর্বসাধারণের কাছে উম্মোচন করাই ছিল এ গ্রন্থটি প্রকাশনার মূল উদ্দেশ্য।
মন্তব্য করুন