যুদ্ধের মজার গল্প-১২

June 19, 2020,

সায়েক আহমদ॥
অগ্রিম কথা বলার পরিণতি
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক মহাখুশি। অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর প্রচ্ছদের ‘ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক:  জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কিছু বই নিয়ে এসেছেন। আমি বইগুলো সাদরে গ্রহণ করলাম। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই জেনে ফেলেছিল এ বইটি প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বইটির ব্যাপারে তাদের মধ্যে বেশ আগ্রহও সৃষ্টি হয়েছে।
বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক মো. সাইফুল ইসলাম পড়ার জন্য আগ্রহ সহকারে একটি বই নিয়ে গেলেন। হাবিব বাহার চৌধুরী ফোরকানউদ্দিনের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করলেন। চা পান পর্বের এক ফাঁকে ফোরকানউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যুদ্ধের সময় কি কোন বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘সেরকম অনেকগুলো ঘটনা আছে। একটি ঘটনার কথা বলি।
এক ভদ্রলোক আমার সাবসেক্টর কমাণ্ডারের সাথে কথা বলছেন। আমি তখন পাশের রুমে বসেছিলাম। সেখান থেকে কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। আমি মনোযোগ দিয়ে তাদের কথাবার্তা শুনছিলাম। কথাবার্তা শুনে আমি বুঝতে পারছিলাম সাবসেক্টর কমাণ্ডারের সাথে যে ভদ্রলোক কথা বলছেন, তিনি একটি যুদ্ধক্ষেত্রের ‘গাইড’ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহায়তা করবেন। যে এলাকায় যুদ্ধ সংঘটিত হবে, আগে সে এলাকাটা একটু ‘রেকি’ করে আসতে হয়। স্থানীয় একজন বিশ্বস্ত এবং পরিচিত লোক থাকলে যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে খুব সুবিধা হয়। তবে লোকটি যেভাবে আমার সাব-সেক্টর কমাণ্ডারের সাথে কথাবার্তা বলছে, তাতে আমার মনে কেন জানি একটা সন্দেহ সন্দেহ ভাব জন্ম নিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই আমার এরকম মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয়। অতীতে এসব ঘটনার জন্য আমি অনেকবার বিব্রতকর অবস্থায়ও পড়েছিলাম। আমার একটা দোষ হচ্ছে, মনে সন্দেহজনক কোন কিছু উপলব্ধি হলে, সাথে সাথে আমি তা প্রকাশ করে ফেলি। অনেক সময় দেখা যায় আমি যা সন্দেহ করেছি, তাই সত্য হয়ে গেছে। এজন্য অনেকবার বিনা অপরাধে আমাকে শাস্তির মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। তারপরও আমি মনে কখনো কষ্ট রাখিনি। কারণ, আমি মনে করি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বোধহয় আমাকে এ ধরণের একটি অদ্ভুত ক্ষমতাই দান করেছেন। এজন্য সন্দেহজনক কিছু ঘটার আগেই আমি মনের ভেতর থেকে এক ধরণের সংকেত পেয়ে থাকি। যাক, একটু পরই আমার ডাক পড়ল। কমাণ্ডিং অফিসার আমাকে ডেকে বললেন, ‘ফোরকান, ইনি আমাদের গাইডার।’
আমি বুঝলাম আরেকটি যুদ্ধের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। কাজেই শত্রুপক্ষের অবস্থান এবং সার্বিক পরিস্থিতি বুঝে নিলাম।
সাবসেক্টর কমাণ্ডার বললেন, ÔWireless সেটসহ Communication এর যাবতীয় সরঞ্জামসহ প্রস্তুত থেকো।’
আমি বললাম, ‘ইয়েস স্যার।’ তারপর হঠাৎ সাবসেক্টর কমাণ্ডার এর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলে উঠলাম, ‘স্যার, এই লোকটার কথাবার্তা শুনে তার উপর আমার সন্দেহ হচ্ছে।’
আমার কথা শুনে সাবসেক্টর কমাণ্ডার ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি সব সময় Negative
কথা বল। উনার মত সৎ ভদ্রলোক আর হয়না।’ তারপর আমাকে অভয় দেয়ার জন্য একটু মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, ‘চিন্তা করো না, এই অপারেশনে আমি নিজেও যাব।’
সাবসেক্টর কমাণ্ডার এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনে বের হলেন। ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে তো আমাকে যেতেই হবে। আমি আমার যন্ত্রপাতি সাথে নিয়ে সবার সাথে রওনা হলাম। গাইডার সবাইকে ভুরঙ্গামারী থানার জয়মনিরহাট এলাকায় নিয়ে গেলেন। হঠাৎ কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই শত্রুপক্ষ আমাদের উপর তীব্র গুলিবর্ষণ শুরু করল। আকস্মিক আক্রমণে আমরা সবাই দিশেহারা হয়ে পড়লাম। অনেকে আহত হলেন। অনেকে নিহত হলেন। আহতরা ‘পানি, পানি’ বলে কাতরাচ্ছে। সাবসেক্টর কমাণ্ডার মেজর নওয়াজেশ উদ্দিন আমার পাশেই ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকান, আমাদের গাইডার কই?’
আমি আগেই গাইডারের আচরণে সন্দেহ পোষণ করেছিলাম। আর আকস্মিক এ ধরণের ক্ষয়ক্ষতিতে হতবুদ্ধি হয়ে গেছি। তাই কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে বললাম, ‘স্যার গাইডার পলাতক।’
আমার কথা শুনে সাব-সেক্টর কমাণ্ডার হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। তিনিও বুঝতে পারলেন আসলে গাইডার লোকটি ছিল পাক বাহিনীর একজন স্পাই। সে আমাদেরকে ধ্বংস করার জন্য গাইডার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
পরিস্থিতি উপলব্ধি করে কমান্ডিং অফিসার সবাইকে পালিয়ে আসার নির্দেশ প্রদান করলেন। আমাদের মধ্যে যারা বেঁচেছিলেন তাঁরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে আহতদেরকে উদ্ধার করে দ্রুত পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেন। এ যুদ্ধে আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক।
প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে আসলাম ঠিকই। কিন্তু এদিকে আমার তো অবাক হওয়ার পালা। অফিসের গোপন কক্ষে বিচারসভার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে আমাকে ডাকা হল। কমান্ডিং অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকান তুমি এই লোককে চিনতে নাকি?’
আমি অবাক হয়ে উত্তর দিলাম, ‘না স্যার। আমি এই লোককে চিনিনা।’
কমান্ডিং অফিসার আবারো জিজ্ঞেস করলেন, ‘না চিনলে কি করে বললে, এই লোকের উপর তোমার সন্দেহ হয়?’
শুরু হল কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব। আমি যতই উত্তর দেই, প্রশ্নও তত বাড়তে থাকে। অবশেষে কমান্ডিং অফিসার কঠোরভাবে আমাকে হুমকি দিলেন, ‘ফোরকান, শেষবারের মত জিজ্ঞেস করছি। সত্যি কথা বল। বল, কি করে তুমি বুঝতে পারলে যে এ লোকটি সন্দেহজনক!’
ইতোমধ্যে প্রশ্নবাণে আমি প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে গেছি। তাই রেগেমেগে উত্তর দিলাম, ‘স্যার এসবের আর কোন উত্তর আমি দিতে পারবনা।’
কিন্তু প্রশ্নপর্ব তাতেও শেষ হল না। কমান্ডিং অফিসার আবারো জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকান সত্যি করে বল, এই লোকের সাথে তোমার সম্পর্ক কি? চেনা জানা কি ভাবে হল?’
অবশেষে আর সহ্য করতে না পেরে আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার আপনারা আমাকে নিয়ে কি শুরু করলেন?’
কমান্ডিং অফিসারের মন এতে মোটেও গলল না। হুংকার দিয়ে বললেন, ‘কি শুরু করলাম একটু পরেই টের পাবে!’
এবার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে দায়িত্ব দেয়া হল, আমাকে আরো নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে আসল রহস্য বের করার জন্য।
ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শুরু করলেন। তিনি কোমল গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘ফোরকান, আমার কাছে অন্তত সত্যি কথাটি বল। গাইডারটি যদি তোমার চেনাজানার কেউ না হয়ে থাকে তাহলে কি করে বলছিলে তার উপর তোমার সন্দেহ হয়’?
আমি উত্তর দিলাম, ‘স্যার, তার চেহারা, নাকে-চোখে-মুখে কথা বলার ভাবভঙ্গিমা দেখে আমি বুঝতে পারছিলাম লোকটা ভাল হবেনা।’
ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শুধুমাত্র ভাব-ভঙ্গিমা দেখেই বুঝে ফেললে লোকটি সন্দেহজনক!’
এবার আমি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলাম, ‘স্যার অগ্রিম কথা বলে আমি ছোট বেলাও প্রচুর মারপিট হজম করেছি। যুদ্ধফিল্ডেও কি আমার একই অবস্থা হবে!’
আমি ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে আমার জীবনকাহিনী বিস্তারিত খুলে বললাম। সব কাহিনী শুনে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান হেসে ফেললেন। তিনি আমার জীবন কাহিনী শুনে Reportকরলেন, ‘তাকে এবারের মত ক্ষমা করা যেতে পারে।’
সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে যখন দেখা গেল, আসলেই আমার কোন দোষ নেই তখন আমাকে ক্ষমা করে দেয়া হল। কিন্তু উক্ত ঘটনায় আমি মনে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছি। কাজেই আমি আমার দুর্ভাগ্যের কাহিনী স্মরণ করে নিরবে কাঁদি। সবাই এটা লক্ষ্য করে সাবসেক্টর কমাণ্ডারকে সবকিছু জানালেন। ইতোমধ্যে সাব সেক্টর কমাণ্ডার আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকান, তুমি মন ভার করে বসে থাক কেন?’
আমার মনটা ভীষণ খারাপ। তাই আমি কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকলাম।
আমাকে নিরুত্তর দেখে তিনি আবারো বললেন, ‘যুদ্ধ ফিল্ডে অনেক কিছু হয়ে থাকে। তুমি এসব কথা ভেবে মন খারাপ করে থেকো না।’
এরপর আমার মনটাকে খুশী করার জন্য কৌশলে তিনি অনেক কথাই বললেন। অন্যরাও এসে কমাণ্ডারকে সাপোর্ট করে কথা বলল। তবে সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে যে, এটা আসলে তাদেরই বুঝার ভুল। কারণ, কেউ যে ভবিষ্যদ্বক্তার মত সত্যি কথা অগ্রিম বলতে পারে, এটা ছিল সবার কাছে অবিশ্বাস্য ব্যাপার।’
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com