যুদ্ধের মজার গল্প-১৩
সায়েক আহমদ॥
বিচারের মুখোমুখি বন্দী ফোরকান
ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিকের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের কাহিনী ও রোমাঞ্চকর মজার ঘটনা নিয়ে একটি বই লিখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কথাটি জানাতেই তিনি আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। আমি বললাম, ‘মৌলভীবাজার জেলায় মুক্তিযুদ্ধের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। ২৫ মার্চ গণহত্যার প্রতিবাদে শমশেরনগরে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল। ঐ মিছিলে নির্বিচার গুলি চালিয়ে পাক বাহিনী নিরীহ দুজন প্রতিবাদকারীকে হত্যা করেছিল। এরই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ২৮ মার্চ স্থানীয় মুজাহিদ বাহিনীর ক্যাপ্টেন মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং ইপিআর এর বিদ্রোহী সদস্যরা পাক বাহিনীর উপর হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল। অবশেষে শমশেরনগর চৌমুহনায় পাক ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলের এক প্লাটুন সৈন্যকে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়েছিল। এটা ছিল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাক বাহিনীর উপর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম প্রকাশ্য আক্রমণ। আমি সে ঘটনার কিছু তথ্যপ্রমাণ যোগাড় করেছি।’
ফোরকানউদ্দিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাই নাকি? আমি ভাসা ভাসা কিছু ঘটনা শুনেছি। কিন্তু পরিকল্পিত আক্রমণ করে পাকবাহিনীকে পর্যুদস্ত করার ঘটনা এই প্রথম শুনলাম।’
আমি বললাম, ‘শুধু তাই নয়, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান যে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন, সে যুদ্ধের এরিয়া কমাণ্ডার ছিলেন শমশেরনগরের আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান।’
ফোরকানউদ্দিনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি যেন আবার সেই তারুণ্য ফিরে পেলেন। তাঁর আগ্রহ দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম এক শুক্রবার ‘বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান’ এর স্মৃতিসৌধে চলে যাব। সেখান থেকে শমশেরনগরে বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানকে দেখে আসব।
পরবর্তী শুক্রবার আমার মটর সাইকেলে আমরা দুজন যাত্রা শুরু করলাম। আমি ভাবছিলাম সত্তরোর্ধ ফোরকানউদ্দিন কি ‘জার্নি’ সহ্য করতে পারবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি তরুণ যুবকের মত ছুটে চললেন। বিজিবির লোগো অঙ্কিত নীল রংয়ের একটি টি শার্ট পরে এসেছিলেন। আমি বললাম, ‘আপনাকে দেখে কে বলবে যে, ফোরকানউদ্দিন একজন টগবগে তরুণ নয়?’
শ্রীমঙ্গল টু শমশেরনগর রাস্তা পাকা করার কাজ চলছিল। কাজেই আমরা নূরজাহান বাগানের মধ্য দিয়ে ধলই বাগানের উদ্দেশ্যে ছুটে চললাম। পথে পাত্রখলা চা বাগানের বাজার সংলগ্ন রাস্তায় একটি ছোটখাটো দূর্ঘটনা ঘটে গেল। হঠাৎ কোত্থেকে দৌড়ে এসে মটর সাইকেলের নিচে পড়ে গেল একটি হাড়জিড়জিড়ে কুকুর। ভাগ্য ভাল। মটর সাইকেল চালাচ্ছিলাম ধীরগতিতে। কাজেই আমরা দুজন অক্ষতই থাকলাম। তবে কুকুরটির প্রতি আমাদের প্রচণ্ড দয়া হল। আমি ভেবেছিলাম কুকুরটি হয়ত মরেই গেছে। কিন্তু আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে সেই হাড়জিড়জিড়ে কুকুরটিই দৌড়ে পালিয়ে গেল। কি আর করা! দূর্ঘটনা দূর্ঘটনাই। আমরা তো আর ইচ্ছে করে দূর্ঘটনাটি ঘটাইনি। তারপরও সারাদিনই অভাগা কুকুরটির জন্য মনের মধ্যে দুঃখ বয়েই চলল।
প্রথমে আমরা বিজিবি সীমান্ত ফাঁড়িতে প্রবেশ করলাম। সেখানেই ইনচার্জ ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিকের পরিচয় পেয়ে যথেষ্ট সমাদর করলেন। আমাদেরকে চা-নাস্তা খাইয়ে আপ্যায়ন করলেন। তারপর ইনচার্জসহ আমরা ‘বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান’ এর স্মৃতিসৌধে কিছু ছবি তুললাম। ইনচার্জ ফাঁড়ি থেকে তিনটি চেয়ার আনালেন। সেখানে বসে আমরা যুদ্ধ প্রসঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন হলাম। আমি এই ফাঁকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান’ এর স্মৃতিসৌধের সামনে বীরপ্রতিক ফোরকানউদ্দিনের একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করলাম।
সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ হলে ফোরকানউদ্দিন তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন। তিনি সেখানে আমাদেরকে তার বন্দী হবার একটি ভয়ংকর দুঃখজনক কাহিনী বর্ণনা করলেন। বিনা অপরাধে আবারো বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সে কাহিনীটি সংক্ষেপে তুলে ধরলাম।
ফোরকানউদ্দিনক্বে দেয়া হয়েছে Anty Person/Anty Tank Mine পূতার দায়িত্ব। তিনি দায়িত্ব পালনের জন্য চলে যান ভুরুঙ্গামারী থানার জয়মনিরহাট থেকে সোনার হাট রোডে। তার নিরাপত্তার জন্য একজন হাবিলদার, একজন নায়েক ও নয়জন সিপাহীসহ মোট ১১ জনকে সাথে দেয়া হল।
ফোরকানউদ্দিন শত্রুপক্ষের যানবাহন চলার রাস্তাগুলোতে মাইন পূতার কাজ শুরু করলেন। তখন রাত ১২টা। এমন সময় হঠাৎ করে দূরে গাড়ির আলো দেখা গেল। ফোরকানউদ্দিন নিশ্চিত হলেন এত রাতে পাকবাহিনীর গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ি হতেই পারে না। কাজেই তিনি গাড়িটির আলো দেখেই নিরাপদ দূরত্বে লুকিয়ে পড়লেন। ভাগ্য ভাল, গাড়িটি অন্য রাস্তায় চলে গেল।
গাড়িটি চলে গেলে আবার এসে মাইন পূতার কাজ শুরু করলেন ফোরকানউদ্দিন। একমনে কাজ করে যাচ্ছিলেন। সারারাত অক্লান্তভাবে মাইন পূতার কাজ চলল। যখন সব কাজ শেষ হল, তখন ভোরের আলো ফুটে উঠল। ভাবলেন এখন আর এখানে থাকা মোটেও নিরাপদ নয়। কাজেই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১১ জনকে খোঁজাখুজি করা শুরু করলেন। অবাক কান্ড, কেউ নেই। ভাবলেন, তারা হয়ত ইতোমধ্যে ক্যাম্পে চলে গেছে। ফোরকানউদ্দিন দ্রুত ক্যাম্পে ফিরে এলেন।
ওদিকে ঘটেছে আরেক কান্ড। পাকবাহিনীর গাড়ির আলো দেখে ফোরকানউদ্দিন এর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১১ জন ভীষণ ভয় পেয়ে যান। তারা ফোরকানউদ্দিনকে ফেলেই প্রাণভয়ে পালিয়ে ক্যাম্পে চলে আসেন। কিন্তু ক্যাম্পে ফিরে এসেই বিপদের ভয়াবহতা টের পেলেন। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা বিরাট অপরাধের কাজ। ফোরকানউদ্দিনকে ফেলে পালিয়ে এসে তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মেরেছেন। কাজেই নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য তারা সবাই বসে যুক্তি পরামর্শ করলেন। যুক্তি পরামর্শ শেষে তারা সাবসেক্টর কমাণ্ডারকে এক বাক্যে Report করেন, ‘ফোরকানউদ্দিন মাইনসহ পাক বাহিনীর গাড়িতে করে চলে গেছেন।’
সাব সেক্টর কমাণ্ডার চিন্তাভাবনা করে দেখলেন ফোরকান তো এ ধরনের কাজ করতে পারে না। কিন্তু তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যদের ১১ জনই তো একই কথা বলছে। ১১ জনের কথা মিথ্যা হবে এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য!
সকাল ৭টার দিকে ফোরকানউদ্দিন ক্যাম্পে ফিরে এসেছিলেন। আসার সাথে সাথেই তাকে বন্দী করে সাব সেক্টর কমান্ডারের সামনে হাজির করা হল। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শুরু হল।
সাবসেক্টর কমাণ্ডার ফোরকানউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেনম ‘তুমি এগুলো (Anty Person/Anty Tank Mine) কোথায় রেখেছ, কাকে দিয়েছ?’
ফোরকানউদ্দিন সারারাতের পরিশ্রমে ভীষণ ক্লান্ত। চিন্তাও করেননি ক্যাম্পে এসে এ ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন। কাজেই প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন, ‘স্যার, সারা রাত কাজ করেছি। ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে আছি। এর মধ্যে আমাকে বন্দী করেছেন। শুরু করেছেন এসব জ্বালা! আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না?’
ফোরকানউদ্দিন তখন একমনে আল্লাহকে ডাকা শুরু করেছেন। কারণ তিনি এসেই জেনেছেন তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যদের ১১ জনই রাতে পালিয়ে এসেছে। তারা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ফোরকানের নামে মিথ্যে রিপোর্ট দিয়ে ভাল করে খেয়ে দেয়ে ঘুমাচ্ছে, আর তার কপালে জুটেছে অমানবিক নির্যাতন! তারা হয়তো ভেবেছিল পাক বাহিনীর সৈন্যরা বোধহয় ফোরকানউদ্দিনকে ধরে নিয়ে গেছে। ফোরকানউদ্দিন যে কাজ সেরে নিরাপদে ক্যাম্পে ফিরে আসবেন এটা ছিল কল্পনাতীত। কারণ নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ১১ জনকে ছাড়াই ফোরকানউদ্দিন যে প্রাণ বাজি রেখে সাহসের সাথে মাইনগুলো পুঁতে রাখার কাজ সফলভাবে সমাপ্ত করতে পারবেন, এটা আসলেই ছিল অবিশ্বাস্য ঘটনা।
ফোরকানউদ্দিনের উত্তরে সাব সেক্টর কমাণ্ডার খুশি হলেন না। তিনি বললেন, ‘ফোরকান, সত্যি করে বল মাইনগুলো কোথায় রেখেছো? কার কাছে রেখেছো?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘স্যার, আমি জয়মনিরহাট থেকে ভুরুঙ্গামারী সোনারহাট মোড়ে ম্যাপ অনুযায়ী সবগুলো মাইন পূতেছি।’
সাবসেক্টর কমাণ্ডার গর্জে উঠে বললেন, ‘মিথ্যে কথা!’
আবার শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। শুরু হল নির্যাতন। ফোরকানউদ্দিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তার কান্নায় সাব সেক্টেরের সকল সদস্যরা হাজির হয়ে গেলেন। আসল ঘটনা কেউই বুঝতে না পারায় কেউ কিছু বলতেও সাহস পাচ্ছেন না।
সাবসেক্টর কমাণ্ডার কড়া নির্দেশ দিলেন, ‘যদি ফোরকানউদ্দিন সত্য কথা না বলে, তবে তাকে মাঠে নিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হবে।’ সময় বেঁধে দেয়া হল সকাল ১১টা পর্যন্ত।
আবার শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বললেন, ‘ফোরকান তোমাকে শেষবারের মত আমি জিজ্ঞাসা করছি। সত্যি করে বল, মাইনগুলো পূতেছ না শত্রুপক্ষকে দিয়েছ?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আমি তো সত্য কথাই বলেছি স্যার।’
দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফোরকানউদ্দিনের কথা মোটেও বিশ্বাস করলেন না। তিনি বললেন, ‘তুমি কি জান, সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী তোমাকে গুলি করে হত্যা করা হবে?’
ফোরকানউদ্দিন সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। কাজেই তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ে উত্তর দিলেন, ‘জানি স্যার। তবে এ ধরণের নির্যাতন সহ্য করার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল বলে মনে করি!’
এক পর্যায়ে ফোরকানউদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
ফোরকানউদ্দিনকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করার প্রস্তুতি চলছে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাবসেক্টর কমাণ্ডারকে বললেন, ‘স্যার ফোরকানউদ্দিনের মধ্যে ভয় ভীতি কোনটাই নেই। বিষয়টি বিবেচনা করা যায় কিনা?’
সাবসেক্টর কমাণ্ডার রাগান্বিতভাবে উত্তর দিলেন, ‘কোন বিবেচনা নয়।’
ফোরকানউদ্দিন একমনে আল্লাহকে ডাকছেন, আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন। আল্লাহ সহায়। ১১টা বাজার পনের মিনিট আগে হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। ক্যাম্পের সবাই চমকে উঠলেন। সাথে সাথে মুক্তিবাহিনীর একটি দলকে বিষয়টি দেখার জন্য ভুরুঙ্গামারী পাঠিয়ে দেয়া হল।
ভুরুঙ্গামারী এলাকায় দলটি গিয়ে দেখে পাক পাকবাহিনীর একটি গাড়ি ধ্বংস হয়ে পড়ে আছে। গাড়িটির ভেতরে ও বাইরে পাকবাহিনীর ১০ জন সৈন্য মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সবাই বুঝতে পারল, এটা মাইন বিস্ফোরণেই ঘটেছে। তারা দ্রুত ক্যাম্পে ফিরে এলেন। সাবসেক্টর কমাণ্ডারকে সব জানালেন।
সাবসেক্টর কমাণ্ডার বিষয়টি উপলব্ধি করেই দ্রুত নির্দেশ দিলেন, ‘ফোরকানউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ মওকুফ করা হল। তাকে আর জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন নেই। কারণ সে অবশ্যই সত্য কথাই বলেছে। আমি বুঝতে পেরেছি ফোরকানের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ঐ ১১ জন সদস্যই মিথ্যে কথা বলেছে। এখন ঐ ১১জনকে বন্দী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করো।’ একই সাথে ফোরকানউদ্দিনকে সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন সাবসেক্টর কমাণ্ডার।
পরের দিন গরুর পায়ের চাপায় পড়ে আর একটি মাইনের বিস্ফোরণ ঘটে। পর্যায়ক্রমে কয়েকটি মাইনের বিস্ফোরণ ঘটলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হল। তদন্ত কমিটি সরজমিন গিয়ে দেখল ফোরকানউদ্দিনকে যেভাবে ম্যাপ দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেসমস্ত স্থানেই মাইনগুলোর বিস্ফোরণ ঘটেছে। কাজেই তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিল, ‘ফোরকান সঠিকভাবে, সঠিকস্থানে মাইন পূতেছে।’ তারা রিপোর্টে আরও সুপারিশ করল, ‘ফোরকানউদ্দিনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। এতে সত্য ঘটনা উদঘাটিত হবে।’
দ্রুত তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল। ফোরকানের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ১১ জনকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল মূল ঘটনা। ফোরকানউদ্দিন এর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১১ জনই পাকবাহিনীর গাড়ি দেখে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসেন। তারা ফোরকানউদ্দিনকে না পেয়ে ভেবেছিলেন তিনি বোধহয় পাক বাহিনীর হাতেই বন্দী হয়েছেন। তাদের দায়িত্ব ছিল ফোরকানউদ্দিনকে নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। কিন্তু ভয়ে পালিয়ে আসায় তারা দায়িত্বে বিরাট অবহেলা করেছেন। কাজেই ক্যাম্পে ফিরে চিন্তা করলেন তাদেরকে শাস্তির হাত থেকে কেউই রক্ষা করতে পারবে না। তখন প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সবাই এক বাক্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সাবসেক্টর কমাণ্ডারকে রিপোর্ট করবেন, ‘ফোরকানউদ্দিন পাকবাহিনীর গাড়িতে চলে গেছেন।’ তারা ভেবেছিলেন ফোরকানউদ্দিন আর ফিরে আসবেন না এবং তাদের একই ধরণের জবানবন্দী সাব-সেক্টর কমাণ্ডার সত্য বলে মেনে নেবেন।
সাবসেক্টর কমাণ্ডার ১১ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কঠোর নির্দেশ দিলেন। এবার শুরু হলো তাদের উপর নির্যাতন। জিজ্ঞাসাবাদে ১১জনই তাদের অপকর্মের কথা স্বীকার করলেন। সাবসেক্টর কমাণ্ডার কঠোরভাবে নির্দেশ দিলেন দায়িত্বে অবহেলা এবং একজন নিরাপরাধ মুক্তিযোদ্ধাকে মিথ্যে কথা বলে ফাঁসানোর অভিযোগে এই ১১ জনকেই প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হবে।
ওদিকে ফোরকানউদ্দিন দেখলেন ১১ জনকে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের ভয়াবহ দিকটা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এখন ঐ ১১ জনকে প্রকাশ্য মাঠে নিয়ে আবার জনগণের সামনে মারপিট করা হচ্ছে। কারণ তারা ভয়াবহ অপরাধী। ফোরকানউদ্দিনের ভাগ্য ছিল অত্যন্ত ভাল। তাই তিনি ঘটনাচক্রে বেঁচে গেছেন। এই ১১ জনের ভুলের কারণে তাকে বিনা অপরাধে লাশ হয়ে পড়ে থাকতে হত। তারপরও তাদের মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির কথা শুনে ফোরকানউদ্দিন মর্মাহত হলেন। তিনি সাবসেক্টর কমাণ্ডারকে বললেন, ‘স্যার, এরা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আমরা কেন পাকহানাদার বাহিনীকে অনুসরণ করব?’
ফোরকানউদ্দিনের কথা শুনে সাব-সেক্টর কমাণ্ডার বোকা বনে গেলেন। তিনি ফোরকানউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি বলতে চাইছো?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘স্যার, ওরাও মুক্তিযোদ্ধা। হয়ত জীবনে একটা বিরাট ভুল করে ফেলেছে। এজন্য তাদেরকে যথেষ্ট শাস্তিও দেয়া হয়েছে। এখন যদি তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, তবে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে। পাক বাহিনীও উল্লসিত হবে।’
সাব-সেক্টর কমাণ্ডার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে তুমি কী বলতে চাও?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘স্যার, যা হবার হয়ে গেছে। আমাকে নিয়েই তো ঘটনা। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি তো বেঁচে আছি। তাই তাদেরকে এবারের মত ক্ষমা করে দিন।’
এবারে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা কথা বলার সাহস পেলেন। তারা ফোরকানউদ্দিন এর পক্ষ সমর্থন কথা বললেন। এতে প্রতিবাদ করার শক্তিও বেড়ে গেল। ফলে সাবসেক্টর কমাণ্ডারও একটু দমে গেলেন। তিনি অবাক হয়ে ফোরকানউদ্দিনসহ সবাইকে বললেন, ‘অবাক কাণ্ড! ওরা ১১ জনের কারণে যে প্রাণটা ঝরে যেতো, সেই প্রাণটাই ওদেরকে বাঁচানোর জন্য প্রতিবাদ করছে?’
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন