যুদ্ধের মজার গল্প-১৪

June 21, 2020,

সায়েক আহমদ
যুদ্ধের ভেতরের রোমান্টিক কাহিনী
ধলই বর্ডার আউটপোস্টে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধের সামনে বসে সীমান্ত ফাঁড়ির ইনচার্জসহ আমি ও বীরপ্রতিক ফোরকানউদ্দিন যুদ্ধের স¥ৃতিচারণ করছিলাম। বর্তমানে কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই সীমান্ত ফাঁড়ির কাঁঠালতলার সম্মুখেই নারকেল বীথির ছায়ায় নির্মাণ করা হয়েছে ‘শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান বীরশ্রেষ্ঠ স্মরণী’। সীমান্তের এক নিভৃত অঞ্চলে লোকচক্ষুর আড়লে পড়ে আছে তাঁর স্মৃতিসৌধটি। লাল চৌকা ভিত্তির ওপর একটি সাদা স্তম্ভ আকাশের দিকে উঠে গেছে। তার ডান পাশে সাত বীরশ্রেষ্ঠের প্রতীকে লাল চিহ্ন খচিত সাতটি উজ্জ্বল ফলা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা স্মৃতিসৌধটি সংরক্ষিত ও পরিচ্ছন্ন। সীমান্ত চৌকির বিডিআর জোয়ানরা নিয়মিত স্মৃতিসৌধটি দেখাশোনা করেন। ধলই সীমান্ত চৌকি থেকে নেমে মাত্র ২০০ গজ দূরে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত পিলার। চা পাতার সবুজ বুক চিরে আঁকাবাঁকা টিলার পথ চলে গেছে সীমান্তে। সীমান্ত খুঁটিগুলো পোঁতা আছে ফসলের ক্ষেতে। ক্ষীণ একটি ছড়ার জলরেখা দু’ভাগ করে দিয়েছে দুদেশের জনপদকে।
বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান এর স্মৃতিসৌধ থেকে বিজিবির সীমান্ত ফাঁড়ি ইনচার্জ আমাকে এবং ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিককে নিয়ে গেলেন যে স্থানটিতে হামিদুর রহমান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন সে জায়গাটিতে। জায়গাটি ভারত সীমান্তের কাছাকাছি থাকায় বিজিবির সাদা পতাকার নিশানা দেখিয়ে আমরা নির্ধারিত জায়গাটিতে পৌঁছলাম। একটি ছোট্ট টাওয়ার তৈরি করে জায়গাটিকে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে সামান্য অগ্রসর হলেই ভারতে পৌঁছানো যাবে। সীমানা পিলার একেবারে আমাদের চোখের সামনেই ছিল। আমি স্মৃতি হিসেব পুরো দৃশ্যটা মোবাইলের ক্যামেরার সাহায্যে ভিডিও করে রাখলাম।
বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান এর স্মৃতিসৌধ থেকে আমরা সোজা চলে এলাম শমশেরনগরে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানের বাড়িতে গেলাম। সাজ্জাদুর রহমানের মেয়ে ইসমত আরা মুন্নী স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। সে অবশ্য আমার ছাত্রী। তার ভাই লিটনও আমার ছাত্র। সেও স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারা আমাদেরকে যথেষ্ট সমাদর করে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানের বয়স এখন আশির উপরে। ঝাড়া ছয়ফুট উচ্চতার এ সাহসী মানুষটি এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন। তবে অসুস্থ থাকায় হাঁটতে কষ্ট হয়। প্রচণ্ড গরম ছিল। স্পষ্ট আলোয় ভিডিও করার জন্য আমরা বারান্দায় বসে যুদ্ধের স্মৃতিচারণে মগ্ন হলাম।
ধলই যুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান। তাঁর আত্মত্যাগে মুক্তিবাহিনী তীব্র আক্রমণ চালিয়ে সহজেই পরাস্ত করেছিল পাক বাহিনীকে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান ছিলেন সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধের এফএফ বাহিনীর এরিয়া কমাণ্ডার। তিনি জানালেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই ধলই সীমান্ত ফাঁড়িটির গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি হওয়ায় পাকিস্তানী বাহিনী ফাঁড়িটি তাদের দখলে নিয়ে গিয়েছিল। যোগাযোগের ক্ষেত্রে অঞ্চলটি দুর্গম হলেও মৌলভীবাজার জেলার বিস্তৃত অঞ্চলের প্রবেশের ক্ষেত্রে এ সীমান্ত ফাঁড়িটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্ত রেখার দু’পাশ থেকেই দু’অঞ্চলে সহজেই নজর রাখা যায়। দেশের অভ্যন্তরে সীমান্ত ফাঁড়িটির একদিকে রয়েছে শ্রীমঙ্গল থানার সীমান্ত এলাকা জুড়ে চা বাগান এবং সমতল মিলে সীমান্ত জনপদ।
সামরিক দিক থেকে এই ফাঁড়িটি দখল করা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধলই সীমান্ত অঞ্চলটি ছিল জেড ফোর্সের অধীনে। বারবার মুক্তিযোদ্ধারা চেষ্টা করেও এ সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকতে পারছিলেন না পাকিস্তানী আর্মির তীব্র প্রতিরোধের কারণে। ১২-১৩ দিন ধরেই ধলই সীমান্তে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান বাহিনীর ৩০-এ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছিল। এই ঘাঁটি দখলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানিকে। ২৮ অক্টোবর ভোরে আক্রমণের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়। রাত ১০টায় যাত্রা শুরু হয়। ভোর চারটায় লক্ষ্যস্থলের কাছে পৌঁছে চূড়ান্ত আক্রমণ করার কথা। রাত প্রায় ২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ধলই সীমান্তে ক্যাপ্টেন নূর, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন কাইয়ুম, ক্যাপ্টেন হাকিমের নেতৃত্বে অবস্থান নেন।
গাছপালার জন্য রাতের অন্ধকার এমন জমাট বেঁধে ছিল যে মাত্র কয়েক হাত দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। চরম প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও ‘সি’ কোম্পানির সৈন্যরা দুই প্লাটুন সামনে ও এক প্লাটুন অনুসরণকারী হয়ে অগ্রসর হতে থাকে। অন্ধকার কেটে যাওয়ার পরপরই শুরু হয় শত্রুর গোলাবর্ষণ। সিপাহী হামিদুর রহমান যে প্লাটুনের অধীন ছিলেন তার নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আব্দুল কাইয়ূম। গুলির গতি পরিবর্তনের জন্য অধিনায়ক ক্যাপ্টেন কাইয়ূম গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে শত্রুর ওপর পাল্টা গোলাবর্ষণের জন্য বেতারে যোগাযোগ করেন। গোলাবর্ষণের ফলে ঘাঁটির এক অংশে আগুন ধরে যায় এবং শত্রুর গোলাগুলী বন্ধ হয়ে যায়। ‘সি’ কোম্পানির সৈনিকরা এবার অগ্রসর হতে থাকে। পাক বাহিনী ঘাঁটির চতুর্দিকে মাইন পুঁতে ঘাঁটিটিকে সুরক্ষিত করা রেখেছিল। ফলে ঘাঁটির কাছাকাছি আসতেই মাইন ফিল্ডে বিস্ফোরণের ফলে বেশ কিছু মুক্তিসেনা হতাহত হয়। ওদিকে মাইন বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় শত্রুর অবিরাম গুলীবর্ষণ। আকস্মিক আক্রমণে হতাহতের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে সৈনিকরা ভূমিতে অবস্থান নেয়। আর অধিক অগ্রসর হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এদিকে ঘাঁটির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় শত্রুর এলএমজির অবস্থান ছিল গাছপালার আড়ালে। ফলে গাছপালার কারণে মুক্তিবাহিনী মেশিনগান দিয়ে গুলী করেও কোন ফল পাচ্ছিল না। এলএমজিটা বিধ্বস্ত করতে না পারলে ঘাঁটি দখল করা ছিল অসম্ভব। এই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য এগিয়ে এলেন সিপাহী হামিদুর রহমান।
সাবধানে বুকে হেঁটে মুষলধারে বিক্ষিপ্ত গুলি-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে চললেন তিনি। ক্রলিং করে শত্রুর অগোচরে এগিয়ে গেলেন এলএমজির পোস্টের একদম কাছে। তখনও শত্রুপক্ষ হামিদুর রহমানের অবস্থান টের পায়নি। বুকের নিচে কঠিন মাটি, সামনে পেছনে, ডানে-বাঁয়ে-ওপরে চলছে গুলি। উভয়পক্ষের আগ্নেয়াস্ত্রের মুহুর্মুহু গর্জন শান্ত প্রকৃতিকে করে তুলেছিল বিভীষিকাময়। সবকিছু উপেক্ষা করে, এমনকি নিশ্চিত মৃত্যুকে অবহেলা করে হামিদুর রহমান ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর এলএমজি পোস্টের ওপর। এলএমজি চালনায় নিয়োজিত দুই শত্রু সেনার সঙ্গে শুরু হয় ধস্তাধস্তি। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে তাঁর সমস্ত শরীর ঝাঝরা করে দেয়। তিনিও ক্ষত-বিক্ষত করে দিলেন এলএমজির গুলিবর্ষণকারী পাক সেনাদ্বয়কে। ফলশ্রুতিতে এলএমজির আক্রমণকারীরা বিধ্বস্ত হলো। কিন্তু তিনিও নিথর হলেন। এলএমজি নিষ্ক্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ঘাঁটি দখল হলো, যুদ্ধের গতিও পরিবর্তন হয়ে গেল। বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান নিজের জীবনের বিনিময়ে মুক্তিবাহিনীর জয় নিশ্চিত করলেন।
সেদিন হামিদুরের মৃতদেহটি সহযোদ্ধারা কাঁধে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সীমান্তের ওপারে। প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার অভ্যন্তরভাগে ত্রিপুরা রাজ্যের আমবাসায় তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল। সে যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানও আহত হয়েছিলেন।
ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান জানালেন ২০০৭ সালে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তখন কেউই হামিদুর রহমানকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছিল সে জায়গাটি চিহ্নিত করতে পারছিল না। অবশেষে ঐ যুদ্ধের এফএফ বাহিনীর এরিয়া কমাণ্ডার হিসেবে তাঁকে খুঁজে বের করা হয়েছিল। তিনিই ত্রিপুরা রাজ্যের আমবাসা গ্রামের কোন স্থানটিতে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানকে সমাহিত করা হয়েছিল তা চিহ্নিত করতে অগ্রপথিকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানের সাথে স্মৃতিচারণের এক পর্যায়ে বীরপ্রতিক ফোরকানউদ্দিন যুদ্ধের ভয়াবহতার মাঝেও তাঁর এক রোমান্টিক প্রণয়ের কাহিনী খুলে বললেন। অবশ্য সে প্রণয় পরবর্তীতে পরিণয়ে পরিণত হয়নি। তবে ফোরকানউদ্দিনের রোমান্টিক কাহিনী শুনে সবার মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সে রোমান্টিক কাহিনীটুকু পাঠকদের উদ্দেশ্যে বর্ণনা করা হল।
দিনহাটা থানার সাহেবগঞ্জ হাজী সাহেবের বাড়ির ভিতরেWireless Communication এর জন্য একটা গোপন কক্ষ নেয়া হয়েছিল। ফোরকানউদ্দিন যখন Message in out করেন তখন হাজী সাহেবের বাড়ির স্কুল কলেজের ছাত্রীরা তাঁর রুমে ভীড় জমাত। এদের মধ্যে হাজী সাহেবের মেয়ে লতিফাও ছিল। লতিফার আচরণ দেখে ফোরকানউদ্দিন উপলব্ধি করলেন সে বোধহয় তার প্রতি কিছুটা দুর্বল। এর কিছু প্রমাণও তিনি পেয়েছিলেন। তবে দুর্ভাগ্যবশতঃ সাবসেক্টর কমাণ্ডারের চোখেও সে বিষয়টি ধরা পড়ে গিয়েছিল। এসব দেখে তিনি প্রচন্ড রাগান্বিত হলেন। যুদ্ধের গোপনীয়তা নষ্ট হবে বিধায় ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি ফোরকানউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার রুমে মেয়েরা কেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘স্যার, আমি তাদেরকে এখানে প্রবেশ করতে নিষেধ করি। কিন্তু তারা তো আমার কথা শুনেনা।’ ফোরকানউদ্দিনের উত্তরে সাবসেক্টর কমাণ্ডার একটু বিপাকে পড়ে গেলেন। তবে তিনি ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে ডেকে বললেন, ‘মতিউর, তদন্তপূর্বক এর একটা ব্যবস্থা নাও তো।’
ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান এর কাছেও বিষয়টি ধরা পড়ে গেল। বিষয়টি অস্বস্তিকর মনে হওয়ায় তিনি সহসা এর কোন সুরাহা খুঁজে না পেয়ে ফোরকানউদ্দিনকে সোজা টাপুরহাটে বদলি করে দিলেন।
ফোরকানউদ্দিন চলে গেলেন টাপুরহাটে। কিন্তু মজার কাহিনী তাঁর পিছু ছাড়ল না। হঠাৎ একদিন হাজী সাহেবের মেয়ে লতিফা টাপুরহাটে উপস্থিত। ফোরকানউদ্দিন তো চমকে গেলেন। এখানে এ মেয়েটি এল কিভাবে!
ফোরকানউদ্দিন কিছুটা বিস্মিত হয়ে লতিফাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এখানে এলে কীভাবে?’
ফোরকানউদ্দিনের কথায় লতিফা খিলখিল করে হেসে উঠে উত্তর দিল, ‘তোমাকে তো আমি আগেই একদিন বলেছিলাম যে, আমার বড় বোনের বাড়ি টাপুরহাটে।’
লতিফার কথায় ফোরকানউদ্দিন বোকা বনে গেলেন। বললেন, ‘কই, আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না।’
লতিফা আবারো হেসে ফেলল। বলল, ‘তুমি যদি সবকিছু ভুলে যাও, তাহলে যুদ্ধ করবে কীভাবে?’
ফোরকানউদ্দিন ভয়ে ভয়ে ছিলেন। কখন না আবার লতিফার সাথে তার কথাবার্তা আগের মত সবার চোখে ধরা পড়ে যায়! তাই কথা সংক্ষিপ্ত করার জন্য তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এখানে কেন এসেছো?’
লতিফা উত্তর দিল, ‘কেন? বোনের বাড়িতে বোন কি বেড়াতে যায় না?’
ফোরকানউদ্দিন বুঝতে পারলেন তার দেখা পেয়ে লতিফা মহাখুশী। লতিফার কথায় ফোরকানউদ্দিন কোন উত্তর না দেয়ায় সে বলল, ‘অবশ্য এখানে অর্থাৎ আমার বড় বোনের বাড়িতে আমি আরো কিছুদিন থেকে যাবো।’
ফোরকানউদ্দিন প্রমাদ গুণলেন। তিনি আবারো লতিফার কথার কোন উত্তর দিলেন না। তখন লতিফা তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হল, তুমি কথা বলছো না কেন? নাকি আমি আসায় তুমি খুশি হওনি?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘লতিফা, আমি আর কি বলব? তোমার কারণেই তো আমার এ বদলি। আর সেই তুমিই কি না চলে এসেছো এখানে?’
লতিফা সপ্রতিভভাবে উত্তর দিল, ‘তোমার কারণেই তো আমার বোনের বাড়িতে আসা!’
লতিফার উত্তর শুনে ফোরকানউদ্দিন হতভম্ব হয়ে গেলেন। ভাবলেন এবার যে কি সর্বনাশ ঘটবে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া বোধহয় কেউই বলতে পারবে না।
এদিকে সাবসেক্টর কমাণ্ডার দেখলেন যুদ্ধ ফিল্ডে Wireless  Communication স্থাপন করার জন্য ফোরকানের বিশেষ প্রয়োজন। কারণ ফোরকানউদ্দিন ছাড়া এরকম যোগ্য আর কেউ নেই। তিনি জানতেন না যে, ফোরকানউদ্দিনকে টাপুরহাটে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কাজেই তিনি মতিউর রহমানের উপর রেগে গেছেন। তিনি ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকানকে কেন বদলি করলে?’
মতিউর উত্তর দিলেন, ‘স্যার, আপনিই তো বলেছিলেন ব্যবস্থা নিতে।’
সাবসেক্টর কমাণ্ডার রেগে গিয়ে বললেন, ‘ব্যবস্থা নেওয়ার অর্থ তো বদলি করা নয়।’
ইতোমধ্যে তাদের কথার মাঝে হাজি সাহেব উপস্থিত হয়ে গেলেন। তিনি বিষয়টি বুঝে বললেন, ‘ফোরকান তো টাপুরহাটে আছে।’
সাবসেক্টর কমাণ্ডার তো হাজী সাহেবের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি অবাক হয়ে হাজী সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকান টাপুরহাটে আছে, এ খবর আপনি জানলেন কি করে?’
হাজী সাহেব সরল মানুষ। তিনি সরলভাবেই উত্তর দিলেন, ‘আমার মেয়ে লতিফাও তো ওখানেই আছে। তার সাথে তো ফোরকানের প্রত্যেকদিনই দেখা হয়। আমি লতিফার কাছ থেকেই ফোরকানের খবর পেয়েছি।’
হাজী সাহেবের কথা শুনে সাবসেক্টর কমাণ্ডার এবং ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান দুজনেই হতভম্ব হয়ে গেলেন।
সাবসেক্টর কমাণ্ডার মতিউরকে বলে উঠলেন, ‘মতিউর যাকে দিলে সাজা, সে তো লুটছে মজা!’
ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান বললেন, ‘স্যার, এটা তো অবিশ্বাস্য ঘটনা!’
সাবসেক্টর কমাণ্ডার হাজী সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার মেয়ে টাপুরহাটে গেল কি করে?’
হাজী সাহেব উত্তর দিলেন, ‘ওখানে তো আমার বড় মেয়ের বাড়ি। লতিফা সেখানে বেড়াতে গেছে।’
হাজী সাহেবের কথা শুনে সাবসেক্টর কমাণ্ডারের মুখে আর কোন কথা জোগালো না। কারণ বোন তো বোনের বাড়িতে বেড়াতে যেতেই পারে। কি আর করা! মতিউরকে ডেকে বললেন, ‘মতিউর, এবার তো আমাকেই যেতে হবে ফোরকানকে নিয়ে আসার জন্য। কারণ ফোরকানকে না আনলে আমাদের ঘোরতর বিপদ হতে পারে।’
ওদিকে ফোরকানউদ্দিন ভীষণ মৌজেই আছেন। লতিফা তার মায়াজালে ফোরকানউদ্দিনকে ইতোমধ্যে ঘায়েল করেই ফেলেছে। কাজেই তিনি প্রায় প্রতিদিনই লতিফার সাথে দেখা করার জন্য তার বড়বোনের বাসায় যেতেন। সেদিনও তিনি সকালে চলে গিয়েছিলেন লতিফার বোনের বাড়িতে। ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়’। সাবসেক্টর কমাণ্ডার গাড়ি নিয়ে টাপুরহাটে উপস্থিত। কিন্তু ফোরকান তো নেই কর্মস্থলে! তিনি জানতে পারলেন ফোরকান গেছেন লতিফার বড় বোনের বাড়িতে।
কি আর করা? রেগেমেগে সাবসেক্টর কমাণ্ডার ফোরকানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। একটু পরই ফোরকানউদ্দিন উপস্থিত হলেন। সাবসেক্টর কমাণ্ডারকে দেখে ফোরকানউদ্দিন বাঘ দেখার মতই চমকে গেলেন। ওদিকে তাকে সামনে পেয়ে তেলেবেগুণে জ্বলে উঠলেন সাবসেক্টর কমাণ্ডার। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’
ফোরকানউদ্দিন নীরব। কারণ উত্তর দেয়ার তো কিছু নেই। সাবসেক্টর কমাণ্ডার কড়া নির্দেশ দিলেন, ‘এই মুহূর্তে রেডি হও। গাড়িতে ওঠ।’
ফোরকানউদ্দিনের বিছানাপত্র গাড়িতে উঠানো হলো। ফোরকানউদ্দিন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, আমরা এখন কোথায় যাব?’
সাবসেক্টর কমাণ্ডার বললেন, ‘এক্ষুণি আমরা সাহেবগঞ্জ রওনা হব। তুমি আমার হুকুম ছাড়া কোথাও যাবে না।’
ফোরকানউদ্দিন হতভম্ব হয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন। লতিফার সাথে শেষ দেখা করার সুযোগটাও তার হল না। কাজেই মন খারাপ করে গাড়িতে বসে থাকলেন।
সাবসেক্টর কমাণ্ডার বিষয়টি লক্ষ করে গাড়িতে বসে একটু নরম হলেন। রোমান্টিক কণ্ঠে বললেন, ‘ফোরকান আমরা তো বিয়ে করে ফেলেছি, কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। দেশ যদি স্বাধীন না হয়, তবে তুমি লতিফাকে বিয়ে করে হাজী সাহেবের বাড়িতেই থেকে যেও।’
সাবসেক্টর কমাণ্ডার মজা করার জন্য ইচ্ছে করেই উল্টো অর্থে কথাটা ফোরকানউদ্দিনকে বলেছিলেন। কিন্তু তার কথায় ফোরকানউদ্দিন মহাচিন্তায় পড়ে গেলেন। কি বলছেন তিনি? তাহলে কি বাংলাদেশ স্বাধীন হবে না? মা-বাবা ভাই বোনদের মুখ আর দেখা হবে না!
হঠাৎ হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন ফোরকানউদ্দিন। তার কান্না দেখে সাবসেক্টর কমাণ্ডার স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বোধহয় ভাবলেন এ গাধাটাকে নিয়ে ভালই মুশকিলে পড়া গেছে। তাই ফোরকানউদ্দিনকে খুশি করার জন্য নানা কৌশলে তিনি কথা বলতে লাগলেন।
হাজী সাহেবের বাড়িতে পৌঁছে সাবসেক্টর কমাণ্ডার সবাইকে ডেকে ঘোষণা দিলেন, ‘ফোরকান হাজী পরিবারের একজন সদস্য। এ নিয়ে আর কোন কথা বলার প্রয়োজন নেই।’
এদিকে লতিফা টাপুরহাটে ফোরকানউদ্দিনকে না পেয়ে আবার নিজের বাড়িতে ফিরে এসে বলল, ‘তুমি আমাকে না বলে আসলা কেন?’
ফোরকানউদ্দিন এখন আছেন ফুরফুরে মেজাজে। তাই উত্তরে হেসে হেসে বললেন, ‘আমি কি তোমার অধীনে চাকরি করি যে, তোমাকে বলে আসতে হবে! তবে এই নিয়ে যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছেন তারাই এখন আবার আমাকে বেশি বেশি আনন্দ দিচ্ছেন!’

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com