যুদ্ধের মজার গল্প-১৫
সায়েক আহমদ॥
ফোরকান উদ্দিন এর জীবনে কাকতালীয় কিছু ঘটনা
বীরপ্রতিক ফোরকানউদ্দিন আমার মেয়ে মাহির কথায় তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিয়েছিলেন। যুদ্ধের অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনী আমরা তার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম। সবগুলো সত্য ঘটনা। কখনো আমরা ফোরকানউদ্দিনের বাসায় গিয়ে গল্পগুলো শুনেছি। কখনো তিনি আমাদের বাসায় এসেছেন। কখনো আমার স্কুলে এসেছেন। ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিককে নিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান এর স্মৃতিসৌধে গিয়েছি। সেখানেও তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন। শমশেরনগরে বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানের বাড়িতে গিয়েছি। সেখানেও তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন। ফোরকানউদ্দিনের বাসায় গিয়ে তাঁর শতবর্ষী মা এবং বড়ভাইয়ের কাছ থেকে তাঁর ছোটবেলার কথা জানতে পেরেছি। এবার তাঁর জীবনের কাকতালীয় কয়েকটি ঘটনা পাঠকদের জন্য তুলে ধরলাম।
লঞ্চডুবি ও ফোরকানের কান্ড
ফোরকান এবং তাঁর বড়ভাই পিলখানা থেকে দুই দিনের ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন। যাবার দিন বিকাল ৪টায় লঞ্চ ঘাটে ভিড়ল। দুইভাই লঞ্চে উঠলেন। হঠাৎ ফোরকানের মনটা কেমন করে উঠল। তিনি বড় ভাইকে বললেন, ‘এ লঞ্চে যাব না।’ একথা বলে তিনি লঞ্চ থেকে নেমে যেতে চাইলেন। ফোরকানের বড় ভাই রেগে গেলেন। তিনি তাকে লঞ্চ থেকে নামতে দেবেন না। দুই ভাই এ নিয়ে প্রচন্ড ঝগড়াঝাটি শুরু করলেন। তাদের ঝগড়া দেখে মানুষজন হাসতে লাগল। অবশেষে বড়ভাই পরাজিত হলেন। দুজনেই লঞ্চ থেকে নেমে গেলেন।
দুভাই লঞ্চ ঘাটে বসে রইলেন। বড়ভাইয়ের মনটা খারাপ। কারণ এ লঞ্চে যেতে পারলে আগেভাগে পৌঁছানো যেত। তিনি অবশ্য তার ছোটভাই ফোরকানের কিছু কিছু পাগলামির সাথে পরিচিত। তাই আর বেশি রাগারাগি করতে যাননি। বাধ্য হয়ে পরবর্তী লঞ্চের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে বিকাল ৫টায় পরবর্তী লঞ্চ এলে সেই লঞ্চে দুইভাই উঠে পড়লেন। দুইভাই নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা পরেই নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছে গেলেন।
ঘটনাচক্রে বিকাল ৪টায় যে লঞ্চটি ছেড়েছিল, সে লঞ্চটি মেঘনা পাড়ি দেয়ার সময় প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। ফোরকানের আব্বা-আম্মা আত্মীয়স্বজন সবাই জানতেন ফোরকানরা ৪টার লঞ্চে চলে গেছেন। তখন চিঠি ছাড়া অন্য কোন যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না। কাজেই সবাই ধরে নিলেন ফোরকানরা দুইভাই-ই লঞ্চডুবিতে মারা গেছেন। সবাই মেঘনাপাড়ে ছুটলেন লাশের সন্ধানে।
অনেক খোঁজাখুজির পর লাশ পাওয়া গেল না। কিন্তু ফোরকানের আম্মার মন তো আর মানে না। তিনি জোর করেই ফোরকানের আব্বাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন। লঞ্চডুবির দুইদিন পর ফোরকানের আব্বা পিলখানা গেইটে হাজির। খবর পেয়ে দুইভাই তাদের আব্বার সাথে দেখা করার জন্য ছুটে এলেন। দুজনের মনেই শঙ্কা বাড়িতে কেউ মারা গেল নাকি! কারণ দুদিন আগেই তো তারা বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন। এখন কেন জরুরীভিত্তিতে তিনি ঢাকা আসবেন। দুইভাইকে দেখতে পেয়েই তাদের আব্বা কান্নাকাটি শুরু করলেন। দুইভাই অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলেন, তাদের আম্মার কিছু হয়ে যায়নি তো!
অনেকক্ষণ পর শান্ত হয়ে তাদের আব্বা প্রকৃত ঘটনা খুলে কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, ‘আমি এক্ষুণি বাড়ি যাব। নইলে তোমার মা কাঁদতে কাঁদতেই মারা যাবেন।’ ফোরকানের বড়ভাই ঘটনা শুনে থ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। একটু ধাতস্থ হতেই ফোরকানকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি জানতে এমন ঘটনা ঘটবে!’
ফোরকান উত্তর দিলেন, ‘আমি জানতাম না। তবে লঞ্চে উঠতেই আমার মনটা বারবার নেমে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল!’
বাস দুর্ঘটনা ও ফোরকানের অস্বাভাবিক আচরণ
দেশ স্বাধীন হবার পর ফোরকান শ্রীমঙ্গলে বদলী হয়ে আসেন। একদিন ঢাকা যাওয়ার জন্য তিনি শ্রীমঙ্গল থেকে বাসে উঠলেন। শ্রীমঙ্গলের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল গণিও ঐ বাসে উঠেছেন। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, ফোরকান বাস থেকে নেমে যেতে চাইলেন।
গণি সাহেব ভাবলেন বোধহয় ভাল আসন না পাওয়ায় ফোরকান নেমে যাচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘বিডিআর সাহেব, নামার দরকার নাই। আমার সিটটায় আপনি বসে যান। আমি অন্য সিটে চলে যাব।’
বাসের হেলপারও এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনি এই সিটে বসে যান। আমি উনাকে অন্য সিট দিচ্ছি।’
ফোরকান বললেন, ‘না ভাই, আমি আজ ঢাকা যাব না।’ এ কথা বলে তিনি জোড় করেই বাস থেকে নেমে গেলেন। সবাই ফোরকানউদ্দিনের এ আচরণ দেখে অবাক হয়ে গেলেন।
বাসায় ফিরে এলে ফোরকানউদ্দিনের স্ত্রীও অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার, তুমি ঢাকা যাওনি কেন?’
ফোরকান উত্তর দিলেন, ‘হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল, তাই আজকে আর ঢাকা যাব না।’ ফোরকানউদ্দিনের স্ত্রীও আর কোন কথা বাড়ালেন না। কারণ তিনি তার স্বামীর অদ্ভুত কিছু আচরণের সাথে পরিচিত। এর আগেও তিনি মাঝে মাঝে এরকম কাণ্ড ঘটিয়েছেন।
বাসায় ফেরার ১ ঘন্টার মধ্যে খবর এল, শায়েস্তাগঞ্জ রেল ক্রসিংয়ে ঐ বাসটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছে। ট্রেনের সাথে বাসটির মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫ জন ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। ব্যবসায়ী গণি সাহেবের একটি হাত কাটা পড়েছে। গুরুতর আহতাবস্থায় অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ঘটনা জেনে বাসার সবাই ফোরকানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন।
ব্যবসায়ী গণি সাহেব এখন হাতকাটা গণি নামে পরিচিত। আসতে যেতে ফোরকানের সাথে দেখা হয়। হাতকাটা গণি বলেন, ‘ফোরকান তুমি ভাগ্যবান। সেদিন কেন তুমি বাস থেকে নেমে গিয়েছিলে? তুমি কি আগেই জানতে যে দুর্ঘটনাটি ঘটবে!’
ফোরকানের মুখে কোন উত্তর থাকে না। কারণ তিনি নিজেই জানেন না সেদিন কেন নেমে গিয়েছিলেন।
ফোরকানের বাসায় ডাকাতি
ফোরকান শ্রীমঙ্গল থেকে বাড়িতে গেছেন। সাথে নিয়ে গেছেন নগদ ৬০ হাজার টাকা। বাড়িতে গেলে সবসময় তিনি বাড়ির সিন্দুকেই টাকা রাখেন। ঐদিনও সিন্দুকেই টাকাগুলো রেখেছিলেন। বিকেলে শশুরবাড়িতে যাবেন। কি মনে করে টাকাগুলো সাথে নিয়ে গেলেন। যাবার সময় বাড়িতে বলে গেলেন, ‘সবাই সাবধান থেকো। বাড়িতে ডাকাত আসতে পারে।’
ফোরকানউদ্দিনের বাড়ি এবং তার শশুরবাড়ি কাছাকাছি। রাত্রে ফোরকানের শশুর বললেন, ‘ফোরকান, তোমাদের বাড়িতে বোধহয় ডাকাত ঢুকেছে। হল্লা চিৎকার শোনা যাচ্ছে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর এল গ্রামবাসী ডাকাতি হচ্ছে টের পেয়ে ডাকাতদেরকে ধাওয়া করেছিল। কিন্তু ডাকাতরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
ফোরকান ছুটে গেলেন তাঁর বাড়িতে। ফোরকানের আব্বা ফোরকানকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ডাকাতরা সিন্দুক ভেঙে স্বর্ণ এবং টাকা পয়সা সব লুট করে নিয়ে গেছে। তোমার টাকাও সব নিয়ে গেছে।’
ফোরকান বললেন, ‘আব্বা, আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমার টাকা-পয়সা নিতে পারেনি। আমি টাকাগুলো আমার সাথেই নিয়ে গিয়েছিলাম।’
ফোরকানের কথা শুনে তাঁর আব্বা কিছুটা শান্তনা পেলেন। সকালে ধানক্ষেতে ডাকাতি হওয়া স্বর্ণও পাওয়া গেল। ডাকাতরা পালিয়ে যাবার সময় সোনার অলংকারের পোটলাটা ধানক্ষেতে ফেলে গিয়েছিল। ডাকাতির অন্য মালামালও একটু দূরেই পাওয়া গিয়েছিল। এক কথায় ফোরকানদের তেমন কোন ক্ষতিই হয়নি।
ডাকাতির পর ফোরকান পড়লেন পুলিশের জেরায়। তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার যে কথাগুলো জানতে চাইলেন, সেগুলো হল-
‘আপনি জানলেন কি করে ডাকাতি হতে পারে?’
‘আপনি কেন সিন্দুক থেকে আপনার টাকাগুলো সাথে নিয়ে গেলেন?’
‘আপনি কি ডাকাতদের চেনেন?’
ফোরকান প্রতিটি কথারই সঠিক উত্তর দিচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর কোন কথাই পুলিশ অফিসার বিশ্বাস করছেন না। অবশেষে যখন জানলেন ফোরকান একজন খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা, তখন তিনি ক্ষান্ত হলেন!
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন