যুদ্ধের মজার গল্প-২
সায়েক আহমদ॥
মুক্তিযুদ্ধের চিত্র প্রদর্শনী
স্বাধীনতা দিবসে স্কুলে সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সাথে থাকে আকর্ষণীয় ইভেন্ট, ‘যেমন খুশি তেমন সাজো।’ মাহি উৎসাহ নিয়ে সবগুলোতেই অংশগ্রহণ করে থাকে। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় থাকে কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। বইয়ের কবিতা আবৃত্তি করতে সে আগ্রহী নয়। তাকে আবৃত্তির জন্য কবিতা লিখে দিতে হয়।
২০১৯ সালের ২৫শে মার্চ। সরকারের উদ্যোগে এ দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করা হবে। আমি চাইছিলাম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এসে তাঁর বাস্তবজীবনের ঘটনা শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরবেন। হঠাৎ মনে পড়ল বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিকের কথা।
ফোরকানউদ্দিনের সাথে আমার পরিচয় আকস্মিকভাবে। শ্রীমঙ্গলের অতি পরিচিত মুখ সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ছবি ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংগ্রহ করেছেন। তিনি নিজ উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত সামগ্রী প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকেন। ২০১০ সালে আমি বিটিআরআই উচ্চ বিদ্যালয়ে এরকম একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বিকুল চক্রবর্তীকে সহযোগিতা করেছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালেও বিকুল স্থানীয় গ্র্যান্ড সেলিম কনফারেন্স হলে এরকম একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। ঐ প্রদর্শনীতে বিটিআরআই উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দল নিয়ে আমিও অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা প্রদর্শনীটি ঘুরে দেখবে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য থেকে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো উপলব্ধি করবে। তাদের সে উপলব্ধিটুকু রচনাকারে লিখবে। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল বিটিআরআই উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র আহনাফ হাবিব চৌধুরী। সেখানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক। আমিও অতিথি হিসেবে তার পাশেই বসেছিলাম।
২৪ মার্চ সন্ধ্যার পর গেলাম বন্ধু অধ্যাপক অবিনাশ আচার্যের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘মুদ্রনবিদ’ এ। শ্রীমঙ্গলের আরেক জীবন্ত কিংবদন্তী এই অবিনাশদা। আমি তাকে ‘চলন্ত অভিধান’ বলে ডাকি। কারণ শুদ্ধ বাংলা শব্দ এবং বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রণীত সর্বশেষ শুদ্ধ বাংলা বানান রীতি তার মাথায় ডিক্সনারীর মত গেঁথে আছে। যে কোন শব্দ শুদ্ধ নাকি ভুল তা তাৎক্ষণিক বলে দেয়ার জন্য অবিনাশদা ছাড়া অন্য কারো কথা আমার অন্তত জানা নেই। তবে অবিনাশদা অনেকটা আড়ালেই থাকতে পছন্দ করেন। তিনি সার্বক্ষণিক অধ্যাপনা এবং তার মুদ্রণ ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তার সাথে আমার গভীর বন্ধুত্ব।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আগামীকাল অথবা ২৬ মার্চ ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিককে পাওয়া যাবে কি?’
অবিনাশদা বললেন, ‘পেতে পারেন। তবে তার মোবাইল নাম্বারটা আমার কাছে নেই। এক কাজ করুন, আপনি বিকুলকে ফোন দিন।’
আমি বললাম, ‘বিকুলকে ফোন দিয়েছিলাম। তবে তার ফোন বন্ধ। সম্ভবত কোথাও কোন অনুষ্ঠানে আছে।’
অবিনাশদা বললেন, ‘তাহলে আপনি বরং অনুজের সাথে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন।’
আমি বললাম, ‘অনুজের নাম্বারটা তো আমার কাছে নেই।’
অবিনাশদা স্থানীয় সাংবাদিক অনুজ কান্তি দাশ এর মোবাইল নাম্বারটা আমাকে দিলেন। অনুজের কাছ থেকে ফোরকানউদ্দিনের মোবাইল নাম্বার নিয়ে ফোন দিলাম। কোন সাড়া পেলাম না। ভাবলাম তিনি হয়ত কাজে ব্যস্ত আছেন।
পরদিন সকালে ফোরকানউদ্দিনকে আবার ফোন দেবো কি না ভাবছি। ভাবছিলাম এত ভোরে তিনি কি ঘুম থেকে উঠেছেন? কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মোবাইল ফোনটি বেজে উঠল। ফোরকানউদ্দিনই কলব্যাক করেছেন। আমি সংক্ষেপে আমার উদ্দেশ্যের কথা তাকে জানালাম। ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘স্যার, আমি তো ভেবেছিলাম বর্তমান প্রজন্ম বোধহয় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ভুলেই গেছে। আপনার প্রস্তাবে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করছি। আমি অত্যন্ত খুশিমনেই আপনার স্কুলে আসব।’
আমিও আনন্দিত চিত্তে ফোরকানউদ্দিনকে বললাম, ‘আগামীকাল আমার স্কুলের একজন শিক্ষককে পাঠিয়ে দেব আপনাকে নিয়ে আসার জন্য। আশা করি আপনাকে দেখে আমার স্কুলের শিক্ষার্থীরা আনন্দিত হবে।’
কালোরাত্রি
২৫ মার্চ, ১৯৭১। বিশ্বের ইতিহাসে ঘটে গেল অন্যতম বর্বর ঘটনা। ঘুমন্ত, নিরীহ বাঙালিদেরকে হত্যা করা হল নিষ্ঠুরভাবে। ২৬ মার্চ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিলেন। সাথে সাথে দেশকে স্বাধীন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল আপামর দেশবাসী। অবশেষে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেলাম বিশ্বের বুকে নতুন একটি মানচিত্র। নতুন একটি দেশ। বাংলাদেশ। মাত্র ৯ মাসে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে বাঙালিরা ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার সূর্য।
আজ আবার ফিরে এসেছে সেই ভয়ংকর কালোরাত্রি। তবে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। সেই ভয়াল কালোরাত্রিতে কী ঘটেছিল আজ তারা জানবে। অবশ্য তারা তাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে ক্ষুদ্র কলেবরে কালোরাত্রি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেয়েছে। তবে আজ তারা মুক্তিযোদ্ধার চোখে দেখবে সেই কালোরাতে নিরীহ ও ঘুমন্ত বাঙালিদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল?
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ
২৫শে মার্চ, ২০১৯। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক বিটিআরআই উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকমন্ডলী, শিক্ষার্থীবৃন্দ এবং বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও সদস্যবৃন্দের উপস্থিতিতে একাত্তরের দিনগুলির স্মৃতিচারণ করলেন। স্মৃতিচারণ করলেন ভয়াল কালোরাত্রিতে ঢাকাতে কী ঘটেছিল সেই রোমহর্ষক ঘটনার কথা। তাঁর সেই স্মৃতিচারণে উঠে এল বীর বাঙালির বীরত্বগাঁথা। আমি লক্ষ করলাম হলভর্তি শিক্ষার্থীরা মুগ্ধ বিস্ময়ে ফোরকানউদ্দিনের গল্পগুলো শুনছে। প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীরা সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল। অন্য সময় হলে শিক্ষার্থীদের কোলাহল বন্ধ করতে হিমশিম অবস্থা হত শিক্ষকমন্ডলীর। আজ অবশ্য সেসব কিছুই করতে হল না। বুঝলাম মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো বুভুক্ষু শ্রোতাদের মত গিলছে ক্ষুদে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। তাদের তো সেইসব দিনের বীরত্বগাঁথা শোনার যথেষ্ট আগ্রহ আছে। কিন্তু আমরাই তাদেরকে সেসব স্মৃতিচারণ শোনার কোন ব্যবস্থা করে দিচ্ছি না। আমার মেয়ে মাহিও মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা। একটু পরই ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিককে সে একটি প্রশ্ন করেছিল। সেই প্রশ্ন থেকেই আমি উপলব্ধি করেছিলাম পরবর্তী প্রজন্মের শিশুদের চিন্তাচেতনায় কী উদয় হচ্ছে!
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বেলা আড়াইটা বেজে গিয়েছিল। ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিককে আপ্যায়নের ক্ষুদ্র আয়োজন করেছিলাম। তিনি স্বতস্ফূর্তভাবে সে আপ্যায়নে অংশগ্রহণ করলেন। আমার মেয়ে মাহি আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল। আমি তাকে আমার অফিসকক্ষে ডেকে এনে ফোরকানউদ্দিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। পরিচয়পর্ব সমাপ্ত হবার পর সে হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে ফোরকানউদ্দিনকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কিভাবে বেঁচে আসলেন?’
মাহির প্রশ্ন শুনে থমকে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক। সাথে সাথেই মাহির কথার উত্তর তিনি দিলেন না। তার কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বললেন, ‘তুমি তো আমাকে একটি কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসেছো। তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাকে অনেক কথা বলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প তোমাকে জানাতে হবে।’
মাহি হেসে উত্তর দিল, ‘তাহলে তো আরো ভালো হয়। আপনারা কীভাবে যুদ্ধ করেছেন, জানতে খুব ইচ্ছে করে।’
মাহির কথায় ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি সময় নিয়ে তোমার বাসায় আসব। তোমার বাসায় বসে চা খাব, আর গল্প করব।’
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন