যুদ্ধের মজার গল্প-৩
সায়েক আহমদ॥
আমার বাসায় ফোরকানউদ্দিন
২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম। বিকেলে এবং সন্ধ্যার পর স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালায় অংশগ্রহণ করে রাতে বাসায় ফিরলাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিনও সারাদিন ব্যস্ত ছিলেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালায়। রাত্রে হঠাৎ তিনি আমার বাসায় এসে হাজির। মাহি তো ভীষণ অবাক! আমিও অবাক হলাম।
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘গতকাল বাসায় ফিরে আপনার মেয়ে মাহির প্রশ্ন নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেছি। আমার বয়স এখন সত্তুরের উপর চলছে। এতদিন তো কেউ আমাকে এ ধরণের কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেনি। আপনার ছোট্ট মেয়েটির সরল প্রশ্নের উত্তরটি আমি কিভাবে দেবো!’
আমি বললাম, ‘আগে ভেতরে এসে বসুন। তারপর কথা বলি।’
ফোরকানউদ্দিন বাসার ভেতরে প্রবেশ করে বসলেন। বললেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে হতাশায় নিমজ্জিত ছিলাম। গতকাল আপনার স্কুলের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমার মধ্যে আবার আগের মত প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। বিশেষ করে আপনার মেয়ে যখন জিজ্ঞেস করেছে, আমি বেঁচে থাকলাম কীভাবে? আমি চিন্তা করলাম, আসলেই তো! যুদ্ধে তো আমি মারাই যেতে পারতাম।’
আমি বললাম, ‘থাক সেসব কথা। এখন বলুন, গতকালকের অনুষ্ঠানটি কেমন লেগেছে আপনার কাছে?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আপনার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞানপিপাসা দেখে আমি আমার তারুণ্য ফিরে পেয়েছি। আমার কাছে খুবই ভাল লেগেছে যে, বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমি তো ভেবেছিলাম এরা বোধহয় নেশা আরা নেটের জগতে হারিয়ে গেছে।’
আমি বললাম, ‘এখনো হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের অবহেলা আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় বর্তমান প্রজন্ম বাস্তব জগতের বাইরে বিচরণ করছে। এখন আমাদেরকেই আবার তাদেরকে সেই কল্পনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। আগে আমি ভাবতাম হয়ত আর কোন কিছুই করা সম্ভব নয়। কিন্তু গতকাল থেকে আমার মধ্যেই একটি উম্মাদনা জেগে উঠেছে। আমারও মনে হয় আমরা পারব। আমাদের দরকার শুধু দেশপ্রেমিক কিছু লোকের মধ্যে ঐক্য সাধন করা।’
মাহি এতক্ষণ আমাদের কথা শুনছিল আর উসখুশ করছিল। আমি বুঝলাম আমাদের এ খটোমটো কথাবার্তা তার কাছে ভাল লাগছে না। তাই তার বিরক্তিভাব দূর করার জন্য বললাম, ‘মা, তুমি কি কিছু বলবে?’
মাহি বলল, ‘উনি কীভাবে যুদ্ধ করেছেন, তা জানতে চাই।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আমি তো সেসব গল্প তোমাকে জানাবার জন্যই তোমাদের বাসায় এসেছি।’
মাহি আমার পাশেই বসেছিল। সে ফোরকানউদ্দিন এর কথায় খুব খুশি হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বীরপ্রতিক আঙ্কেল। আপনি কেন যুদ্ধে গেলেন?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘তুমি তো আমার মায়ের মত প্রশ্ন করেছো। আমার মাও তোমার মত একদিন বলেছিলেন, দেশে যুদ্ধ লাগবে। তুমি আর চাকুরীতে যেও না।’
মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কী চাকুরী করতেন?’
এবার ফোরকানউদ্দিন মাহিকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘বিজিবির নাম শুনেছো?’
মাহি উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘বিজিবি হচ্ছে বর্ডার গার্ড, বাংলাদেশ। আগে এর নাম ছিল বাংলাদেশ রাইফেলস, মানে বিডিআর। পাকিস্তান আমলে এর নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, মানে ইপিআর। আমি তখন ইপিআরে চাকুরী করতাম।’
‘ইপিআরে?’
‘হ্যাঁ। আমি তখন 10 Wing Rangpur-G E.P.R এর Wireless Operator পদে কর্মরত ছিলাম।’
‘তখন আপনার বয়স কত ছিল?’
‘ঐ সময় আমার বয়স ছিল ২০ বছর।’
‘আপনারা সবাই যুদ্ধে গিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি, তোমাদের যা আছে তা দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে। তখন থেকে আমরা E.P.R এর বাঙালি সদস্যরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি।’
‘আপনি তখন কি করতেন?’
‘ওয়্যারলেসের মাধ্যমে মেসেজ আদানপ্রদানের কাজ করতাম।’
‘সেখান থেকে যুদ্ধে গেলেন কীভাবে?’
‘যুদ্ধে কীভাবে গেলাম? সেটা বলতে তো অনেক সময় লাগবে।’
‘লাগুক। আপনি বলেন।’
‘ঠিক আছে বলছি, শোন।’
ফোরকানউদ্দিন মাহির কথায় তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন।
যুদ্ধে যাবার কাহিনী
‘১৯৭১ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কাজেই আপামর বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলটির নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হবেন। সেটাই নিয়ম। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি তা মেনে নিতে মোটেও রাজী নয়।’
‘কেন?’
‘কারণ তারা বাঙালিদের শোষণ করছিল। এ ব্যাপারটা তুমি তোমার বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইটি পড়লেই বিস্তারিত জানতে পারবে।’
‘আচ্ছা।’
‘এখন শোন আমার যুদ্ধে যাবার কাহিনী। দেশের পরিস্থিতি তখন খুবই খারাপ। আমি এবং আমার বড়ভাই একমাসের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছি।’
‘আপনার বাড়ি কোথায়?’
‘এখন তো আমার বাড়ি শ্রীমঙ্গলে। আমার মূল বাড়ি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার থোল্লাকান্দি গ্রামে।’
‘ছুটিতে কেন গেলেন?’
‘আমাদের চাকুরীতে সব সময় বাড়িতে যাবার সুযোগ নেই। তাই সুযোগ হলেই আমরা বাড়ি যেতাম। তখন তো বয়স অল্প। আব্বা-আম্মা এবং ভাইবোনদেরকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল। তাই বাড়ি গেলাম। ওদিকে দেশজুড়ে থমথমে অবস্থা।’
‘কেন?’
‘কারণ, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে চাইছিল না। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী করতেই হতো। তাই তারা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দুষ্ট বুদ্ধি করছিল।’
‘কি করছিল তারা?’
‘তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রচুর সৈন্য নিয়ে এসেছিল পূর্ব পাকিস্তানে। উদ্দেশ্য ছিল গুলি করে বাঙালিদেরকে দমিয়ে রাখবে। কিন্তু দেশের মানুষ তাদের সে বর্বরোচিত পরিকল্পনার কিছুই বুঝতে পারছিল না। তবে তারা যে একটা কিছু করার ষড়যন্ত্র করছে এটা সাধারণ মানুষ সামান্য হলেও আঁচ করতে পারছিল। তাই দেশের সর্বত্র কানাঘুষা চলছে, “কি হতে যাচ্ছে দেশে?” ওদিকে আমার ছুটি প্রায় শেষ হতে চলেছে। আমি আমার কর্মস্থলে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এটা দেখে আমার মা বললেন, “বাবা, দেশে যুদ্ধ লাগবে। তুমি আর চাকুরীতে যেও না।” আমি মায়ের কথা শুনে থমকে গেলাম।
মাকে বললাম, “মাগো, আমি তো চাকুরী করি। আমাকে তো যেতেই হবে।”
মা বললেন, “বাবা, আমি সেটা জানি। কিন্তু এও জানি এখন দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। মানুষজন বলাবলি করছে, তুমি এবং তোমার বড়ভাই চাকুরীতে গেলে তোমাদেরকেও ওরা মেরে ফেলবে। তাই আমি তো তোমাকে জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না।”
আমি বললাম, “মা, মাগো। মরণ যদি আসে, সে তো তোমার কোলে বসে থাকলেও আসতে পারে। আর এখন চলছে দেশের দুর্দিন। এ অবস্থায় আমরা যদি দেশকে বাঁচাতে না পারি, তবে কারা বাঁচাবে দেশকে? দেশ বাঁচলে তো আমরাও বেঁচে থাকব। দেশের বিপদে কাপুরুষ ছাড়া তো কেউ ঘরে বসে থাকবে না।”
আমার আবেগাপ্লুত কথায় মা আর কথা বাড়ালেন না। আমাদেরকে চোখের জলে বিদায় দিলেন।
মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে কোনক্রমে বেরিয়ে এলাম। যুদ্ধকালীন প্রতিমুহূর্তে আমি আমার মায়ের কথা স্মরণ করেছি এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, ‘হে আল্লাহ, আমার মায়ের মুখ দেখে যেন আমার মৃত্যু হয়।’
মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি তখন যুদ্ধে গেলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘না, তখনও যুদ্ধ শুরু হয়নি। তবে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেই ফেলেছেন, তিনি যদি হুকুম দিতে নাও পারেন, আমরা যেন রুখে দাঁড়াই। যার যা আছে তা নিয়েই যেন আমরা শত্রুর মোকাবেলা করি।’
মাহি বলল, ‘হ্যাঁ, আমি পড়েছি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এটা আমাদের বইয়ে আছে।’
ফোরকানউদ্দিন মাহিকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘এই তো, তুমি ঠিক বলতে পেরেছো।’
‘তারপর কি হল?’
‘হ্যাঁ, বলছি। তুমি তো জানই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে বর্বর পাকিস্তানীরা নিরীহ ও ঘুমন্ত বাঙালিদেরকে হত্যা করার জন্য অস্ত্রসহ বেরিয়ে পড়েছিল। যাকে যেখানে পেয়েছিল, পশুর মত গুলি করে হত্যা করেছিল। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নিরস্ত্র বাঙালি পুলিশদেরকে হত্যা করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলিতে ঢুকে নির্বিচারে ছাত্রদেরকে হত্যা করেছিল। তাদের বর্বর গণহত্যা সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।’
‘বঙ্গবন্ধু তখন কোথায় ছিলেন?’
‘পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়েছিল। তবে বঙ্গবন্ধুও প্রস্তুত ছিলেন। তিনি ইচ্ছে করলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিরীহ, নিরস্ত্র দেশবাসীকে রেখে কিভাবে পালাবেন? তাইতো তিনি গ্রেফতার হবার আগেই স্বাধীনতার ঘোষণা আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন।’
‘আপনি তখন যুদ্ধে গিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ, আমাদের ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর বাঙালি সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী তখন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। আমিও ইপিআরের কমান্ডারের নির্দেশে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম।’
এমন সময় মাহির আম্মু রাতের খাবার নিয়ে হাজির হলেন। আমি তখন তন্ময় হয়ে মাহি ও ফোরকানউদ্দিনের কথাবার্ত শুনছিলাম। আমিও তাদের সাথে হারিয়ে গিয়েছিলাম একাত্তর সালে। মাহির আম্মুর কথায় আমাদের সম্বিত ফিরে এল।
ফোরকানউদ্দিন রাতের খাবার দেখে ভীষণ আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘এখন আমি কিছুই খাব না। আর গতকালই তো আপনার স্কুলে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম।’
মাহির আম্মু বললেন, ‘স্কুল আর বাসার খাবারে অনেক পার্থক্য আছে। গতকাল থেকেই আমার মেয়েটি আপনার কথাই বলছে। ভাগ্য ভালো, আজকে আপনি হঠাৎ চলে এসেছেন।’
আমি বললাম, ‘তুমি উনাকে চিনলে কীভাবে? আমি তো তোমাকে উনার সাথে পরিচয়ই করিয়ে দেইনি।’
মাহির আম্মু বললেন, ‘আমি এতক্ষণ খাবার রেডি করতে করতে রান্নাঘর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনছিলাম। কাজেই উনাকে চিনতে আমার ভুল হবে কীভাবে?’
ফোরকানউদ্দিন আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন, ‘আজ আমার আরেকটি খুশির দিন। আজ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। সারাদিন এতগুলো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আসলাম। কিন্তু কোথাও কোন আন্তরিকতার ছোঁয়া পেলাম না। সবাই যেন দায়সারা গোছের কিছু অনুষ্ঠান করেই খালাস। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘স্বাধীনতা’ এ শব্দ দুটি উপলব্ধি করার ইচ্ছেও অনেকের মাঝে প্রকাশ পায়নি।’
আমি বললাম, ‘এসব চিন্তা করে কোন লাভ নেই। কে কি বলল, কিংবা কি করল সেসব নিয়ে আমাদেরকে আর মাথা না ঘামালেও চলবে। আমরা দেশ ও মাটিকে ভালবেসে যাব। তাহলেই দেশের মানুষের ভালবাসা অর্জন করব।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। আজ থেকে আমিও আমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে ফেললাম। আর আমি নেগেটিভ কোন চিন্তা করব না। আজ আমি অনুভব করলাম দেশ থেকে এখনো মানবতা হারিয়ে যায়নি। আমাদের সামনে আরেকটি যুদ্ধ এগিয়ে আসছে। সেটা হল মানুষের বিবেক জাগ্রত করার যুদ্ধ!’
মন্তব্য করুন