যুদ্ধের মজার গল্প-৪

June 4, 2020,

সায়েক আহমদ॥
মাহি ও ফোরকানউদ্দিন পড়ন্ত বিকেল। হঠাৎ মাহি চিৎকার করে উঠল, ‘আব্বু বীরপ্রতিক এসেছেন।’ আমি দরজা খুলে দিলাম। হাসিমুখে ফোরকানউদ্দিন বাসায় প্রবেশ করলেন। ড্রয়িংরুমে বসে শুভেচ্ছা বিনিময় হল। ২৬ মার্চ রাতে ফোরকানউদ্দিন আমার বাসায় খাওয়াদাওয়া করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের গল্প করতে করতে আর খেতে খেতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি আমার মটর সাইকেল দিয়ে ফোরকানউদ্দিনকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলাম। সেদিন মাহিকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেছিলেন। রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় বাকীটুকু আর শোনা হয়নি। মাহিও বারবার তাগাদা দিচ্ছিল ফোরকানউদ্দিনের বাসায় তাকে নিয়ে যাবার জন্য। আমারও মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনাগুলো জানার জন্য খুবই ইচ্ছা করছিল।
বেশ কয়েকদিন ধরে ফোরকানউদ্দিনের সাথে আমার দেখা হয়নি। সেদিন রাত্রে তার বাসাটি চিনে এসেছিলাম। ভাবছিলাম একদিন মাহিকে নিয়ে তার বাসায় চলে যাব। কিন্তু বিভিন্ন ঝামেলায় আর যাওয়া হয়নি। আজ হঠাৎ ফোরকানউদ্দিন বাসায় চলে আসায় আমি ও মাহি খুবই খুশি হলাম।ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আপনার মেয়েকে মুক্তিযুদ্ধের গল্পের বাকী অংশটুকু বলা হয়নি। তাই আমি ছটফট করছিলাম আপনার বাসায় আসার জন্য।
আমি বললাম, ‘যখনই ইচ্ছে হবে আপনি চলে আসবেন। আমার মেয়ে তো আপনার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আমিও সেটা বুঝতে পেরেছি। আমার কাছে তো খুবই ভাল লাগছে। বর্তমান প্রজন্ম আবার দেশের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করছে। এর চেয়ে বড় চাওয়া আর কি হতে পারে?’
আমি বললাম, ‘সেটাও তো আমাদেরই ব্যর্থতা। আমরা যদি তাদেরকে এসব ব্যাপারে অনুপ্রাণিত না করি, তাহলে তো তারা ভার্চুয়াল জগতে হারিয়ে যাবে।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। আপনার মত যদি সবাই চিন্তা করত, তাহলে অনেক আগেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা পেয়ে যেতাম।’
হঠাৎ ফোরকানউদ্দিন মাহির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মামনি, তুমি আমাদের কথাবার্তায় বিরক্ত হচ্ছো না তো?’
মাহি বলল, ‘জ্বী না।’
আমি বললাম, ‘তাহলে এক কাজ করুন। আপনি বরং যুদ্ধে যোগদান কীভাবে করলেন সেটার বাকী অংশটুকু বলুন। আমারও শোনার বেশ ইচ্ছে করছে।’
ফোরকানউদ্দিন মাহিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরপরের প্রশ্নটা তুমি করো। তাহলে আমি সেখান থেকেই আমার গল্পের বাকী অংশটুকু বলার চেষ্টা করব। আর একটা কথা মনে রাখবে, যদিও আমি গল্পের মতই ঘটনাগুলো বলছি, এগুলো আসলে গল্প নয়। সত্যিকারের ঘটনা।’
মাহি বলল, ‘আমি জানি তো। সেজন্যই তো আপনাকে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা বলার জন্য অনুরোধ করছি।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘ঠিক আছে। এবার তুমি তোমার প্রশ্নটি করো।’
মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কিভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধে যোগদান করলেন?’
‘গোপন মেসেজ?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘সুন্দর প্রশ্ন করেছো। আমি বাকী ঘটনাগুলো বলছি। আগেই তো বলেছিলাম আমরা অর্থাৎ বাঙালিরা E.P.R এ কর্মরত ছিলাম। তবে আমাদের সাথে অসংখ্য পাকিস্তানী সদস্য এবং কর্মকর্তারা ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকেই পাকিস্তানীরা বাঙালিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু করল। আমরাও সেটা বুঝতে পারছিলাম। বাঙালিরা যাতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মানতে না পারে, সেজন্য তারা সেনাবাহিনী, E.P.R, পুলিশবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীতে যেসব বাঙালি সদস্যরা ছিল তাদেরকে প্রায় গৃহবন্দীর মত অবস্থায় রেখেছিল। বাঙালি সদস্যরা যাতে একসাথে তিনজন একত্রিত হতে না পারে সে ব্যাপারে তারা বিভিন্ন নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল। এছাড়া কড়া নির্দেশ দিয়েছিল সিগন্যাল সেন্টারে কোন বাঙালি সদস্য প্রবেশ করতে পারবে না।’
‘আপনি কি সিগন্যাল সেন্টারে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ, আমার মূল কাজই তো ছিল সিগন্যাল সেন্টারে। আমার বাঙালি অফিসার নওয়াজেশ উদ্দিন অনেকটা গৃহবন্দীর মত অবস্থান করছিলেন। তিনি একজন উর্ধতন অফিসার হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানীরা তার ক্ষমতা বাজেয়াপ্ত করে রেখেছিল। তাই আমাকে আমার বাঙালি অফিসার নওয়াজেশ সাহেব পরামর্শ দিয়েছিলেন, যে কোন ভাবে যেন আমি সিগন্যাল সেন্টার থেকে খবর নিয়ে আসি। কারণ ঐ সময়ই পাকিস্তানীরা বাঙালিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গোপন মেসেজ দিচ্ছিল।’
‘গোপন মেসেজ?’
‘হ্যাঁ।’
‘সেটা আবার কি রকম?’
‘একটা অতি গোপনীয় Signalমেসেজ তোমাকে বলি। তাহলে তুমি বুঝতে পারবে কি ধরণের গোপন মেসেজ আসছিল। আমি আমার বাঙালি অফিসার মেজর নওয়াজেশ উদ্দিন এর পরামর্শক্রমে অতি গোপনে চোরের মত সিগন্যাল সেন্টারে প্রবেশ করে পাকিস্তানী বাহিনীর এরকম একটি গোপন মেসেজ বের করে ফেলি। মেসেজটি ছিল,

‘Dis-arm all Bengali forces, if captain Newazesh avaiable arrest him.’এর মানে হচ্ছে, ‘সকল বাঙালি বাহিনীকে নিরস্ত্র করুন। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশকে পাওয়া গেলে গ্রেফতার করুন।’
মেসেজটি পড়ে আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশসহ আমরা বাঙালি অফিসার ও সৈনিকেরা আগেই ধারণা করছিলাম এরকম কিছু একটা হতে পারে। মেসেজটি পেয়ে এবার নিশ্চিত হলাম। প্রচণ্ড আতংকিতও হলাম। বুঝলাম আমাদের বাঙালি কর্মকর্তা এবং সৈনিকেরা কেউই আর তাদের হাত থেকে রেহাই পাবে না। আমাদেরকে নিরস্ত্র করতে চাচ্ছে। এর মানে হচ্ছে হয় আমাদেরকে মেরে ফেলবে অথবা বন্দী করে ফেলবে। যা কিছু করার এখন খুব দ্রুত করতে হবে। হাতে এক মুহূর্তও সময় নেই। তাই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আমি মেসেজটি পড়ে দ্রুত সিগন্যাল সেন্টার থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, আমি বের হওয়ার সময় একজন অবাঙ্গালী কর্মকর্তা আমাকে দেখে ফেলে।
সে আমাকে উর্দু ভাষায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে কেন এসেছ?”
আমি সাথে সাথে বুদ্ধি করে উত্তর দিলাম, “আমি পরিচ্ছন্নতাকর্মী।”
আমার উত্তর শুনে সে বলল, “ঠিক হায়, তোম এদারছে হঠ যাও।”
ভাগ্য ভাল। সে আমাকে সুইপার ভেবে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তাই এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেলাম। কোনক্রমে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর প্রাণ নিয়ে পালিয়ে সরাসরি চলে আসি আমার বাঙালি অফিসারের কাছে।’
ফোরকানউদ্দিন একটু থামলেন। এমন সময় মাহির আম্মু চা-নাস্তা নিয়ে হাজির হলেন। গল্প শোনায় ব্যাঘাত ঘটায় মাহি খুবই বিরক্ত হল।
আমি বললাম, ‘মামনি, আমরা চা-নাস্তা করে ফেলি। তারপর নাহয় আবার বাকীটুকু শুনব।’
মাহি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
চা-নাস্তা পর্ব শেষ হওয়ার পর মাহি আবার বলল, ‘বীরপ্রতিক আঙ্কেল, এরপর কী হল বলেন?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘কতটুকু পর্যন্ত বলছিলাম মা?’
মাহি বলল, ‘আপনি পালিয়ে বাঙালি অফিসারের নিকট চলে এলেন।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে।’ এই বলে তিনি আবার শুরু করলেন।
ক্যাম্প থেকে পলায়ন
‘আমি নওয়াজেশ উদ্দিন সাহেবকে Messageএর কথা বলি। মেসেজের তাৎপর্য বুঝতে পেরে তিনি বললেন, ‘ফোরকান এই মুহূর্তেই আমাদেরকে পালিয়ে যেতে হবে। একটু দেরী হলেই আর প্রাণে বাঁচতে দেবে না।’
তাৎক্ষনিকভাবে তিনি E.P.R এর বাঙ্গালী ড্রাইভার আবুল হোসেনকে নিয়ে আসতে বললেন। আমি আবুল হোসেনকে কৌশলে নিয়ে আসি। তারপর নওয়াজেশ উদ্দিন সাহেবের পরামর্শমত প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়েই আমাদের Wireless Communication এর যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসি। আমি তাঁর পরামর্শ মতো জীবন বাজি রেখে কাজটি করতে সক্ষম হই। কারণ অবাঙালি অফিসাররা চিন্তাও করতে পারেনি আমরা এমন ভয়ংকর কাজ করতে পারব। তখন রংপুরের সংগ্রাম কমিটিও আমাদেরকে সাহায্য করেছিল।’
মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি ওয়ারলেস এর জিনিসপত্র চুরি করেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ।’
মাহি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘ওগুলো কেন চুরি করেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘যুদ্ধের সময় ওগুলোই তো ছিল আমাদের প্রধান সম্বল।’
মাহি প্রশ্ন করল, ‘ওগুলো কি জন্য এনেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘যুদ্ধের সময় Wireless Communication এর যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে আসা আর পুরো ক্যাম্প নিয়ে আসা একই কথা। ওগুলোর সাহায্যে আমরা সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে সক্ষম হই।’
মাহি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘ওগুলো এনে তাহলে কী করলেন?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘হ্যাঁ, বলছি সে ঘটনা। শোন।’Wireless Station স্থাপন
‘আমি বাঙ্গালী কর্মকর্তা মেজর নওয়াজেশ উদ্দিনের পরামর্শে, কুড়িগ্রামের এসডিও হালিম সাহেবের সহযোগিতায় উলিপুর থানায় অস্থায়ী Wireless Station স্থাপন করি। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করি। তখন Signalmanনুরুজ্জামানের মাধ্যমে একটি গধংংধমব পাই। মেসেজটি ছিল Heavy fire going on Dinajpur Sector in between Bengali forces and non Bengali forces. অর্থাৎ ‘দিনাজপুর সেক্টরে বাঙালি বাহিনী এবং অবাঙালি বাহিনীর মধ্যে ভারী ভারী যুদ্ধ চলছে।’
ওদিকে নায়েক NK Signal আমিরুজ্জামানের মাধ্যমে আরেকটি Massage পাই ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম চিটাগাং হালিশহনে E.P.R এর বাঙ্গালী সদস্যদের নিয়ে বিদ্রোহ করেছেন। মেসেজটি জানার সাথে সাথেই আমি E.P.R এর সেক্টর/উইং দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, রাজশাহী, চিটাগাং, কুমিল্লা ও সিলেটের সাথে যোগাযোগ করে বিদ্রোহের কথা জানিয়ে দেই।’
স্বাধীনতার ঘোষণা
ফোরকানউদ্দিন এ পর্যন্ত বলার পর হঠাৎ আমি বলে উঠলাম, ‘পত্র-পত্রিকা থেকে আমরা জেনেছি স্বল্পকালের জন্য চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র যখন বিদ্রোহীদের দখলে আসে, তখন ২৬শে মার্চ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান এবং ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া তাঁর প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে ঘোষণা করলেও, পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শক্রমে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘এসব নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবে আমি মনে করি জাতির সামনে সঠিক সত্যটি উদঘাটন হওয়া দরকার। তখন চট্টগ্রাম সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দরা কালুরঘাটস্থ নিরাপদ স্থানে ট্রান্সমিটার স্থাপন করে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করার জন্য একজন সেনা অফিসারকে খুঁজছিলেন। কারণ তারা ভাবছিলেন, যুদ্ধের সময় একজন সামরিক অফিসারের ঘোষণা জনগণকে আশ্বস্ত করবে। জনগন কিছুটা সাহস পাবে। তারা নিশ্চিত হবে যে, সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার এবং সৈনিকরা দেশের পক্ষেই লড়াই করছেন।’
আমি বললাম, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, এসব নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র-তৃতীয় খণ্ড’ গ্রন্থটির প্রথম পৃষ্টায় আছে, ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর, অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথমার্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সংক্ষিপ্ত ঘোষণা চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সে ঘোষণাটি ছিল, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি যে, যে যেখানে আছো, যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার! আপনি তো একেবারে সঠিক তথ্যটি তুলে ধরেছেন। আজ বুঝলাম আপনি মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছেন।’
আমি বললাম, ‘শুধু আমি নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকেরই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানা উচিত বলে আমি মনে করি।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আপনার কথা শুনে প্রচণ্ড শান্তি পেলাম। মনে হচ্ছে আমার মনে জমে থাকা সকল হতাশা থেকে আজ আমি মুক্ত হয়ে গেলাম।’
আমি বললাম, ‘বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ ঘাঁটাঘাটি আমি আরো জেনেছি, বঙ্গবন্ধুর পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণা পাওয়ার পর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতারা, এমনকি স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাধারণ জনগণ তা হাতে লিখে, সাইক্লোস্টাইল করে, মাইকিং করে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। ২৬ মার্চ সকালে আওয়ামী লীগ ও চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা আখতারুজ্জামান বাবুর বাসভবন ‘জুপিটার হাউস’-এ এক বৈঠকে মিলিত হন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেন। সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরীসহ চট্টগ্রামের এমএনএ এবং এমপিএদের মধ্যে যাঁরা চট্টগ্রাম শহরে আছেন, তাঁরা একত্রে বেতারকেন্দ্রে যাবেন এবং জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে প্রচার করবেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে জহুর আহমদ চৌধুরী বেতারকেন্দ্রে যেতে পারেননি। তবে তিনি একজন সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক স্বাধীনতার বেতার ঘোষণা প্রচারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
অতঃপর নেতারা প্রথমে ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তিনি রণাঙ্গন ছেড়ে শহরতলিতে অবস্থিত বেতারকেন্দ্রে যেতে রাজি হননি। এরপর নেতারা মেজর জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পুনঃপ্রচার করেন। ২৭ মার্চ সকালে সংগঠকদের মধ্যে বেলাল মোহাম্মদ তাঁর বন্ধু মাহমুদ হোসেন, কাজী হাবিব উদ্দীন, এয়ার মাহমুদ, ফারুক চৌধুরী, ওসমান গণিকে নিয়ে বেতারের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বোয়ালখালীর ফুলতলীতে অবস্থানরত মেজর জিয়ার কাছে যান। মেজর জিয়া বেতারের নিরাপত্তার জন্য একটি সেনাদল পাঠান। বিকেল পাঁচটার মধ্যে সেনারা বেতারকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে এলাকাটির নিরাপত্তা জোরদার করেন। সন্ধ্যার মধ্যে মেজর জিয়া বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে বেতারকেন্দ্রে উপস্থিত হন। এরপর মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর প্রথম ঘোষণাটি দেন। ২৮ মার্চ মেজর জিয়া নিজেকে ‘অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান’ দাবি করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর দ্বিতীয় ঘোষণাটি দেন। এরপর ঐ দিনই মেজর জিয়া তার তৃতীয় ঘোষণায় নিজেকে ÔProvisional head of the Swadhin Bangla Liberation GovernmentÕ বলে ঘোষণা করলে রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সচেতন মহলে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সবাই ভাবলেন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে সেনা-অভ্যুত্থান হিসেবে প্রচার করার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। এ জন্য তাঁরা দ্রুত এটার সংশোধনী প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের একসময়কার শিল্পমন্ত্রী ও বিশিষ্ট শিল্পপতি এ কে খান এবং চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতারা, বিশেষ করে জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, মীর্জা মনসুর, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, এম এ হান্নান প্রমুখ যৌথভাবে একটি ঘোষণা তৈরি করেন। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও মীর্জা মনসুর ২৯ মার্চ রাতে এ ঘোষণাটি নিয়ে মেজর জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। ৩০ মার্চ প্রভাতি অধিবেশনে মেজর জিয়া ২৮ মার্চের ঘোষণা সংশোধন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সরকার গঠন এবং তাঁর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।’
ফোরকানউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি তো দেখছি সবই স্টাডি করে ফেলেছেন। ঠিকই বলেছেন। মেজর জিয়ার ঐ ঘোষণাটিই সর্বত্র ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। ঘোষণাটি ছিল,

ÔOn behalf of our great national leader, the supreme commander of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman do hereby proclaim the independence of Bangladesh. It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the solo leader of the elected representatives of 75 million people of Bangladesh. I therefore appeal on behalf of our great leader Sheikh Mujibur Rahman to the government of all the democratic countries of the world specially the big world part and neighboring countries to take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan. The legally elected representatives of the majority of the people as repressionist. It is cruel joke and contradiction in terms which should be fool none. The guiding principle of a new step will be first neutrality, second peace and third friendship to all and anomity to none. May Allah help us. Joy Bangla.’

“প্রধান বিচারপতির আরোগ্য কামনা”
বিশিষ্ট আইনজীবী, ঢাকা মেট্রোপলিটান আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এড. আবেদ রাজা প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন। তিনি বলেন, সুপ্রীম কোর্টের পক্ষ থেকে তাঁর সিএমএইচএ ভর্তির কথা বলায় দেশবাসী আশ্বস্ত হয়েছে। সময় সময় তাঁর শারীরিক অবস্থা দেশবাসীকে জানানোর জন্য সুপ্রীম কোর্টে রেজিষ্টারের প্রতি তিনি আহবান জানান।
সংবাদ প্রেরক,
মোঃ হাসান
ব্যক্তিগত সহকারী
মোবাঃ ০১৭৯৯৭৭৩৩৫৭

 

 

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com