যুদ্ধের মজার গল্প-৫
সায়েক আহমদ॥
Wireles station আক্রমণ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিকের মুখ থেকে আমি ও মাহি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা নিয়ে কিছু বিতর্ক ছিল। সেটা নিয়ে আমরা আলাপ করছিলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম আমাদের কথাবার্তায় মাহি প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছে। ফোরকানউদ্দিনও তা লক্ষ করে বললেন, ‘আচ্ছা আমি আবার আমাদের গল্পে ফিরে আসছি। আচ্ছা কোন জায়গায় এসে থেমেছিলাম বলো তো?’
মাহি বলল, ‘ওয়ারলেস স্টেশন স্থাপন করার কথা বলছিলেন।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এবার ওয়ারলেস স্টেশন স্থাপন করার পর আমাদেরকে আক্রমণ করার গল্প বলি?’
মাহি বলল, ‘হ্যাঁ বলেন। কিন্তু কারা আপনাদেরকে আক্রমণ করেছিল?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘সেটাই বলছি। শোন। উলিপুর থানায় নিরাপদ অবস্থানে থেকে সাফল্যের সাথে E.P.R Gi Wireles station গুলোর সাথে আমি যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এমন সময়ে হঠাৎ করে সাবেক পাকিস্তানের স্পীকার আবুল কাশেম সাহেবের ভাই তার দলবল নিয়ে Wireles station আক্রমণ করে বসলেন। আমরা পাক বাহিনীর আক্রমণের ভয় করছিলাম। কিন্তু এরা যে আক্রমণ করে বসবে তা কল্পনাও করিনি। আমি তাৎক্ষণিক আনসার ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের জনগণের সহযোগিতায় তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। সবাই মিলে আবুল কাশেম সাহেবের ভাই এবং তার দলবলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও আক্রমনাত্মক ভাব লক্ষ করেছিলাম। মানুষদের মধ্যে স¦াধীনতা অর্জনের তীব্র আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল। তাই কেউ মৃত্যুর পরোয়া না করে এদের আক্রমণ প্রতিহত করে দিয়েছিল। লোকমুখে জানতে পারি এরা মুসলিম লীগের লোক। কাজেই স্থানীয় মানুষ এদেরকে ভাল করেই চিনত। এ কারণে সবার মধ্যে এক ধরণের উম্মাদনা কাজ করছিল। ভাগ্য ভাল, সম্মিলিত প্রতিরোধে হামলাকারীরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। আমরাও Wireles station টি রক্ষা করতে সমর্থ হই।’
একটু থেমে ফোরকানউদ্দিন আবার বললেন, ‘ও হ্যাঁ, তোমাকে আমি মেসেজের কথা বলেছিলাম। আমাদের ওয়ারলেস স্টেশনে বিভিন্ন ধরণের মেসেজ আদান-প্রদান হত। আমি আগেই বলেছিলাম, প্রয়োজনীয় মেসেজগুলো আমি আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওয়ারলেস স্টেশনগুলোতে পাঠিয়ে দিতাম। সে মেসেজগুলো পড়ে আমাদের কমাণ্ডাররা পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতেন। এরকম একটি মেসেজের উদাহরণ দেই। সে মেসেজটি ছিল,
‘Sheik Mujib and his party Awami League got absolute meajority in the Election 1970. But Pak Govt never wanted to transfared power to the Elected Govt. Sheik Mujib started his non co-operation movement with non violence method. On the 25 the March Pak Army attacked EPR HQ Peelkhana and Rajarbag Police line. All the Bengali Forces stand agains Pak Govt and begain to fight.’এ মেসেজটির বাংলা অর্থ হচ্ছে, ‘শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। কিন্তু পাক সরকার কখনই নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় না। শেখ মুজিব অহিংসা পদ্ধতিতে তার অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ২৫ শে মার্চ পাক সেনাবাহিনী পিলখানা ইপিআর হেড কোয়ার্টার এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে। সমস্ত বাঙালি বাহিনী পাক সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং যুদ্ধ শুরু করে।’
হঠাৎ ফোরকানউদ্দিনের ফোনটি বেজে উঠল। তিনি কলটি রিসিভ করে বললেন, ‘বাসা থেকে আমার গিন্নী ফোন করেছেন। জরুরী প্রয়োজন। এখনি যেতে হবে। আজ তাহলে উঠি?’
মাহি একটু ইতস্তত করছিল। তা দেখে তিনি বললেন, ‘তোমার চিন্তার কিছু নেই। বাকী অংশটুকু তোমাকে আমি অবশ্যই শোনাবো। তোমাকে আমার বাসায় যাবার জন্য দাওয়াত দিলাম। আশা করি তোমার আব্বু তোমাকে নিয়ে আমার ছোট্ট কুড়েঘরে বেড়াতে আসবেন।’
এভাবেই ফোরকানউদ্দিনের সাথে আমার এবং মাহির ঘনিষ্ঠতা হল। তিনি অক্লেশে মাহির প্রশ্নের উত্তর দিতেন। মুক্তিযুদ্ধের গল্প করতেন। আর আমরাও হারিয়ে যেতাম একাত্তরের দিনগুলোতে।
পাকসেনাদের মুখোমুখি
বেশ কয়েকদিন ফোরকানউদ্দিনের সাথে দেখা হয়নি। মাহিও অস্থির হয়ে গেছে বাকী গল্পগুলো শোনার জন্য। আমিও স্কুলের কাজের ঝামেলায় সময় বের করতে পারছিলাম না। অবশেষে এক শুক্রবার সকালে মাহি স্মরণ করিয়ে দিল ফোরকানউদ্দিনের কথা। সেদিন আমিও একটু ঝামেলামুক্ত ছিলাম। কাজেই মটর সাইকেল বের করে মাহিকে নিয়ে সোজা হাজির হলাম ফোরকানউদ্দিনের বাসায়।
বাসার সামনেই ফোরকানউদ্দিনকে পেয়ে গেলাম। খালি গায়ে কোদাল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছেন। সাথে তার ছোট নাতিও আছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ বয়সে আপনি কোদাল হাতে কাজ করছেন?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘কাজ না করলে শরীরটা ঝিমিয়ে পড়ে। শরীরটাকে ফিট রাখতে হলে শারীরিক পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই।’
আমি বললাম, ‘ঠিক বলেছেন। আমরা বোধহয় সকাল সকাল এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম।’
ফোরকানউদ্দিন জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললেন, ‘ছি ছি কী বলছেন? আপনারা আসায় আমি এত খুশি হয়েছি তা বলার মত নয়। আসুন আসুন ভেতরে আসুন।’
ফোরকানউদ্দিন আমাদেরকে নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলেন। ছোট্ট একটি দ্বিতল বাসভবন। ছোট্ট একটি উঠানও আছে। উঠানের একপাশে ছোট্ট একটি পুকুর। সে পুকুরে দ্রুত হাত পা ধৌত করে আমাদেরকে নিয়ে তিনি বাসার ভেতরে দোতালায় উঠলেন। ছোট্ট একটি কক্ষে তিনি থাকেন। সেখানে নিয়ে গেলেন। আমাদেরকে বসালেন।
মাহিকে বললেন, ‘আমি বৃদ্ধ মানুষ। স্মরণশক্তিও আগের মত নেই। কাজেই তুমি আমাকে প্রশ্ন করবে। আমি সেই প্রশ্নের উত্তর দেব।’
মাহি বলল, ‘ঠিক আছে। আচ্ছা, আপনি পাকসেনাদের মেরেছেন, কিন্তু তারা আপনাকে মারতে পারেনি কেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘চাকুরীতে যোগদানের পরপরই আমাদেরকে অনেক প্রশিক্ষণ নিতে হয়। আমরা কীভাবে শত্রুকে মারবো এবং কীভাবে নিজের প্রাণ বাঁচাবো সেই প্রশিক্ষণও আমাদেরকে দেয়া হয়েছে। যারা যতো বেশি প্রশিক্ষিত তারা ততো বেশি মারতেও পারে, বাঁচতেও পারে।
মাহি বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। তবে আপনি যে মরে যাবেন সেই ভয়টা আপনার মধ্যে ছিল না?’
মাহির কথায় ফোরকানউদ্দিন একটু হেসে উত্তর দিলেন, ‘যুদ্ধ একটা খেলার মতো। আমরা যখন ফুটবল খেলি তখন আমাদের গোল দেয়ার নেশাটাই থাকে। হাত-পা ভেঙে যাবে কি না, এটা কখনো মনে আসে না। তাই আমরা যখন যুদ্ধ করছিলাম, তখন শত্রুদেরকে মারব, নাকি নিজে মরব,- এ সমস্ত কথা কোন সময়ই মনে আসেনি।’
মাহি প্রশ্ন করল, ‘আপনি কীভাবে খেতাব পেলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘একটা দেশে যখন যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তখন সেক্টর কিংবা সাব-সেক্টর পর্যায়ে লগ বুক থাকে। Situation report upto 24 hours. অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যা ঘটে তার মধ্যে চোখে পড়ার মতো বিশেষ ঘটনাগুলো লগ বুকে লিখে রাখা হয়। যুদ্ধ শেষ হলে বোর্ড বসিয়ে প্রত্যেকের কর্মকাণ্ডের উপর নম্বর দেওয়া হয়। সেইমতে বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক উপাধি দেওয়া হয়। সেরকম একটি ঘটনায় আমি বীরপ্রতিক উপাধি পেয়েছি। বীরপ্রতিক উপাধি পাওয়ার সেই ঘটনাটিও আমি তোমাকে বলব।’
মাহি বলল, ‘মুক্তিযুদ্ধে আপনার একটি স্মরণীয় ঘটনা বলুন।’
ফোরকানউদ্দিন আবার বলা শুরু করলেন, ‘যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। আমি ভুরুঙ্গামারী থানার জয়মনিরহাটে শত্রুপক্ষের অবস্থান ও সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ শত্রুপক্ষের একটা গাড়ি এসে যায়। আমি পড়লাম মহাবিপদে। কারণ, আমি যদি দৌড় দেই তবে সাথে সাথে তারা গুলি করে দেবে। আর যদি দাঁড়িয়ে থাকি, তবে এসে ধরে ফেলবে এবং জেরা শুরু করবে। কথা বলতে একটু উনিশ-বিশ হলেই গুলি করে দেবে। ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকালাম। হঠাৎ দেখলাম একটা ছাগল মাঠে ঘাস খাচ্ছে। সাথে সাথে আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এসে গেল। আমি উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে ছাগলটাকে তাড়া করলাম। এখন যদি পাকবাহিনী দেখতে পায়, তবে ভাববে গ্রামের লোক ছাগল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যদিও মনে প্রচণ্ড ভয়, কখন না আবার গুলি করে বসে। যাক, ভাগ্যটা ভাল। আমার তাড়া খেয়ে ছাগলটি দৌড়ে নিরাপদ দুরত্বে চলে যায়। আমিও ছাগলটির সাথে সাথে নিরাপদ দুরত্বে এসে যাই। কিন্তু কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত্রি হয়। আমার ভাগ্যেও সেরকম ঘটনা ঘটল। যখন পাক বাহিনীর চোখ এড়িয়ে নিরাপদ দূরত্বে এসে গেছি, এমন সময় রাজাকারের একটা দল আমাকে ধরে ফেলে। আমি তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করি, আমিও বাঙালি আপনারাও বাঙালি। আমার আকুতি মিনতি শুনে রাজাকারদের মধ্যে দুই ভাগ হয়ে যায়। একদল নিশ্চিত হল, আমি মুক্তিযোদ্ধা নই। গাঁয়েরই ছেলে। তাই তারা আমাকে ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছে পোষণ করল। কিন্তু তাদের মধ্যে আরেকদল ক্রেডিট নেয়ার জন্য আমাকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আমাকে নিয়ে তাদের ঝগড়া তখন তুঙ্গে। হঠাৎ একজন মহিলা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ইশারায় আমাকে পালিয়ে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দেন। আমিও কৌশলে পালিয়ে আমার ক্যাম্পে চলে আসি।’
এমন সময় ফোরকানউদ্দিনের স্ত্রী মিসেস সমীরণ বেগম আমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে এলেন। বেশ ছোটখাটো মহিলা। বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। ফোরকানউদ্দিন হেসে হেসে আমাকে বললেন, ‘বুড়ির বয়স কিন্তু ষাটের উপর। যখন বিয়ে করেছিলাম, তখন তিনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন।’
আমি বললাম, ‘তাহলে আপনি বাল্যবিবাহ করেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন হো হো করে হেসে বললেন, ‘আমাদের সময় তো ওসবের বালাই ছিল না। তবে সপ্তম শ্রেণিতে পড়লেও তিনি বয়সের দিক দিয়ে বিয়ের উপযুক্তই ছিলেন। আর আমার বয়সও তখন বাইশ বা তেইশ ছিল।’
মিসেস সমীরণ বেগম ফোরকানউদ্দিনকে হালকা ধমক দিয়ে বললেন, ‘এখন ওসব প্যাঁচাল রাখো তো। আগে মেহমানদেরকে নিয়ে নাস্তা করো। তারপর প্যাক প্যাক করতে থাকো।’
মিসেস সমীরণ বেগমের কথা শুনে আমরা সবাই প্রাণ খুলে হেসে উঠলাম। মাহিও আমাদের সাথে হাসিতে যোগ দিল।
মন্তব্য করুন