যুদ্ধের মজার গল্প-৬
সায়েক আহমদ॥
রাজাকার কারা?
যুদ্ধের কাহিনীটি খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিল মাহি। হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘রাজাকার কারা?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আপামর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধকে সাপোর্ট করছিল। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে একটাই আকাঙ্খা ছিল, দেশকে হানাদারমুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর পাকিস্তানীরা তাদের গণহত্যা সফল করার জন্য কৌশল অবলম্বন করেছিল। তারা তো এ দেশের পথঘাট ভালো করে চেনে না। কাজেই তারা চাইছিল এ দেশের মানুষের মধ্যে কিছু দালাল তৈরি করতে যারা তাদেরকে সহায়তা করবে। তাদের বুদ্ধিটা কাজেও লেগেছিল। এদেশে কিছু দুষ্ট লোক ছিল, যারা দেশকে ভালবাসত না। এরা পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করত। পাকিস্তানীরা তাদের নাম দিয়েছিল রাজাকার। এরাই বর্বর পাকবাহিনীকে সহায়তা করছিল।’
মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘কিভাবে সহায়তা করছিল?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘এরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পাক বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দিচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বাবা-মা, ভাই-বোনদেরকে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিচ্ছিল। এদেরই সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনী লক্ষ লক্ষ বাঙালিদেরকে হত্যা করেছিল। নাহলে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হত না। কাজেই এরা ছিল পাক হানাদার বাহিনীর চেয়েও ভয়ংকর।’
ফোরকানউদ্দিন আবেগে অনেক কথা বলে ফেলেছেন। মাহিও কিছুটা বুঝতে পারছিল। তার প্রশ্ন করার ধরণ থেকে আমিও বুঝতে পারছিলাম। মাহি এবার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি রাজাকারদেরকে মেরেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’
মাহি বলল, ‘তাহলে সেই ঘটনাটা বলুন।’
আমজাদ মাষ্টার হত্যার লোমহর্ষক কাহিনী
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘কতই বা বলব! বলার কি আর শেষ আছে। ঠিক আছে, তাহলে আমজাদ মাষ্টারের ঘটনাটাই বলি।
মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘আমজাদ মাষ্টার? সে আবার কে?’
‘সে ছিল স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান।’
‘শান্তি কমিটি! সেটা আবার কি?’
‘পাক হানাদার বাহিনী তাদের সহায়তার জন্য শুধু রাজাকার বাহিনীই গঠন করেনি, আরোও অনেক বাহিনী গঠন করেছিল। এদের মধ্যে আল শামস এবং আলবদর বাহিনী অন্যতম। এরপরও গ্রামের সাধারণ মানুষদেরকে দলে টানার জন্য গ্রামে গ্রামে গঠন করেছিল শান্তি কমিটি। গ্রামের কিছু দুষ্ট লোক এ কমিটিগুলোতে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রামে গ্রামে আক্রমন করার জন্য পাক হানাদার বাহিনীকে খবর দিয়ে নিয়ে আসত। এদের সহায়তায় পাক বাহিনী গ্রামে গঞ্জে সাধারণ মানুষের উপর প্রচন্ড অত্যাচার করত। বাসা-বাড়িতে আগুণ লাগিয়ে দিত। গ্রামের যুবক ছেলেদেরকে গুলি করে হত্যা করত। মা-বোনদেরকে ধরে নিয়ে যেত। তাদের উপর অত্যাচার করত। তাদেরকেও মেরে ফেলত। নয়ত এমন অত্যাচার করত, যাতে তাদের বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে যেত।’
‘বুঝলাম। কিন্তু আমজাদ মাষ্টার কি করেছিল?’
‘আমজাদ মাষ্টারও ছিল এদের মত একজন জঘন্য রাজাকার। আমরা খবর পেলাম যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের মা-বাবাকে ধরে নিয়ে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিচ্ছে আমজাদ মাষ্টার এবং তার রাজাকার বাহিনীর লোকজন। শুধু তাই নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের বাবা-মা, ভাই-বোনদের উপর প্রচন্ড অত্যাচার করছিল। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ফিরিয়ে এনে পাক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার জন্য তাদের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করছিল।
আমার সাব-সেক্টর কমান্ডার নওয়াজেশ উদ্দিন আমজাদ মাষ্টারের এহেন জঘন্য কার্যকলাপে খুব ক্ষেপে গেলেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন আমজাদ মাষ্টার এবং তার রাজাকার বাহিনীকে শায়েস্তা করার জন্য। আমিও সাথে সাথে প্রস্তুত। এক প্লাটুন মুক্তিফৌজ নিয়ে আমি আমজাদ মাষ্টারের বাড়ি আক্রমনের জন্য রওনা হলাম। সেখানে পৌঁছে আমরা সতর্ক হয়ে অগ্রসর হলাম। একজন ওয়াচম্যান পাঠালাম তার বাড়িতে কে কে আছে এবং কি হচ্ছে তা জানার জন্য। ওয়াচম্যান এসে জানাল আমজাদ মাষ্টারের বাড়ির প্রমোদকক্ষে পাক সেনারা নাচ-গান করে মদ পান করছে। কথাটি শুনে আমিও খুব খুশি হয়ে গেলাম। ভাবলাম এটাতো আমাদের জন্য বিরাট সুযোগ। সাথে সাথে আমি পরিকল্পনা ঠিক করে ফেললাম।’
মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘কি পরিকল্পনা করলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘আমি আমার দলকে ৫ ভাগে ভাগ করে আমজাদ মাষ্টারের বাড়ি ঘেরাও করে অবস্থান নিলাম। এমনভাবে অবস্থান নিলাম যাতে একজন শত্রুও পালিয়ে যেতে না পারে। যখন দেখলাম শত্রুপক্ষ নাচ-গান এবং মদপানে পুরোপুরি মাতাল অবস্থায় আছে, ঠিক সে সময়ই আমি আমার বাহিনীকে আক্রমনের নির্দেশ প্রদান করলাম। আমার নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা সর্বশক্তিতে আক্রমন চালালো। এদিকে শত্রুপক্ষ আমাদের আক্রমনে দিশাহারা হয়ে এলোপাতারি মেশিনগানের গুলি ছোঁড়া শুরু করল। আমি আমার বাহিনীকে কৌশলে শত্রুপক্ষের সাথে মিশে যাবার বুদ্ধি দিয়েছিলাম। কারণ পাক হানাদার বাহিনী এতে করে বিভ্রান্ত হবে। কারা মুক্তিযোদ্ধা এবং কারা রাজাকার রাতের বেলা তারা চিনতে পারবে না। আমার বুদ্ধিটা কাজে লাগল। দেখা গেলে মুক্তিযোদ্ধারা আমজাদ মাষ্টারের ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেও সাথে সাথে পাক বাহিনী তাদেরকে চিনতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা অক্ষরে অক্ষরে আমার নির্দেশ পালন করল। তারা শত্রুপক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে হাতবোমা নিক্ষেপ করা শুরু করল। শুরু হল ভয়াবহ যুদ্ধ। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে শত্রুপক্ষকে খতম করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সবার ভেতর একটাই জেদ কাজ করছিল, আজ যেভাবেই হোক আমাদেরকে জয়লাভ করতেই হবে।
ভেতর বাহির থেকে জোরালো আক্রমনে শত্রুপক্ষ পর্যুদস্ত হয়ে গেল। আমরাও শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করে সদম্ভে আমজাদ মাষ্টারের বাড়িতে প্রবেশ করলাম।’
মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘আমজাদ মাষ্টার তখন কোথায় ছিল?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘তাতো আমরা জানতাম না। আমরা বাড়িতে প্রবেশ করে আমজাদ মাষ্টারকে খুঁজতে থাকলাম। একটা কক্ষে ঢুকে আমরা আমজাদ মাষ্টারের স্ত্রীকে পেয়ে গেলাম।
আমজাদ মাষ্টারের স্ত্রীকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমজাদ মাষ্টার কোথায়?”
আমজাদ মাষ্টারের স্ত্রী কোন কথা না বলে কেঁদে উঠলেন। তিনি হাত ইশারায় আমজাদ মাষ্টারের অবস্থান দেখিয়ে দিলেন।’
মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘আমজাদ মাষ্টার কোথায় অবস্থান করছিল?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘সে আমাদের ভয়ে তার পালংকের নিচে লুকিয়ে পড়েছিল।’
মাহি হি হি করে হেসে উঠে বলল, ‘পালংকের নিচে?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘হ্যাঁ।’
মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি তখন কি করেছিলেন?’
ফোরকানউদ্দিন উত্তর দিলেন, ‘আমি আমজাদ মাষ্টারকে পালংকের নিচ থেকে বের করার জন্য আমার বাহিনীকে নির্দেশ দিলাম। মুক্তিযোদ্ধারা আমার আদেশে আমজাদ মাষ্টারকে পালংকের নিচ থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনল। আমজাদ মাষ্টার আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকল। প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগল। তার উপর আমার প্রচন্ড ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ এই লোকটির কারণে অনেক মুক্তিযোদ্ধা পাক হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে মারাত্মক নির্যাতনের স্বীকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। অনেক মা-বোন তাদের মান সম্মান, ইজ্জত হারিয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউবা ঘৃণা ও লজ্জ্বায় আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হয়েছিল। আমি তার দিক থেকে ঘৃণাভরে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
আমজাদ মাষ্টারের স্ত্রীও প্রচন্ড কান্নাকাটি করছিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি স্ত্রী হয়ে আপনার স্বামীকে কি কারণে ধরিয়ে দিলেন?”
আমজাদ মাষ্টারের স্ত্রী কান্না বন্ধ করে কঠোর দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই লোকটাকে আমি প্রচন্ড ঘৃণা করি।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কারণটা কী?”
আমজাদ মাষ্টারের স্ত্রী উত্তর দিলেন, “যে স্বামী ব্যক্তিস্বার্থে অন্ধ হয়ে নিজের স্ত্রীকে ভোগ করার জন্য পাক সেনাদের হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করে না, তাকে তো আপনাদের হাতে তুলে দেয়া আমার জন্য ফরজ কাজ।”
আমি আরো অবাক হয়ে বললাম, “কী বলছেন!”
আমজাদ মাষ্টারের স্ত্রী বললেন, “আমি সত্যি কথাই বলছি। আর এখন আমি মরতেও ভয় পাব না। কারণ, এখন মরলে শান্তিতেই মরতে পারব। আমার কোন আফসোস থাকবে না। তবে আপনাদের নিকট আমার আকুল আবেদন, এ পশুটাকে আপনারা যেন উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করেন।”
আমজাদ মাষ্টারের স্ত্রীর কথায় আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেলাম। তারপর ঘোর কাটিয়ে তাকে শান্তনা দিয়ে বললাম, “আপনি ধৈর্য্যধারণ করুন। আপনার মত লক্ষ লক্ষ মা-বোন এই মীরজাফরদের কারণে ইজ্জত-সম্মান হারিয়েছে। আমরা অবশ্যই তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেব। ইনশাল্লাহ, আমরা দেশকে মুক্ত করেই ছাড়ব।”
আমজাদ মাষ্টারের স্ত্রী দুহাত তোলে আমাদের জন্য প্রাণভরে দোয়া করলেন। আমরা আমজাদ মাষ্টারকে বেঁধে নিয়ে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।’
এতক্ষণ দুহাত গালে রেখে আমজাদ মাষ্টারের কাহিনী মনোযোগ দিয়ে শুনছিল মাহি। এবার সে জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর কি হল?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আমরা আমজাদ মাষ্টারের বাড়িতে যখন আক্রমণ করেছিলাম তখন সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল। গোলাগুলির শব্দে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য ক্যাম্প থেকে পাক বাহিনীর আরেকটি গ্রুপ আমজাদ মাষ্টারের বাড়িতে আসছিল। আমজাদ মাষ্টারকে নিয়ে আমরা চলে আসার সময় পথিমধ্যে তারা আমাদেরকে আক্রমন করে বসলো। আমরাও তাদেরকে পাল্টা জবাব দিতে থাকলাম। আবার শুরু হল প্রচন্ড যুদ্ধ। এই সুযোগটা নিল আমজাদ মাষ্টার। হঠাৎ সে হাত বাঁধা অবস্থায় লাফ দিয়ে রাস্তার পাশে খালে পড়ে যায়। আমরা যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় তাকে আর আটকাতে সক্ষম হইনি। পাকসেনারা আমাদের কাছ থেকে তীব্র প্রতিরোধ আশা করেনি। আমাদের পাল্টা আক্রমনে তারা ভয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেল। আমরা যখন নিশ্চিত হলাম তারা পালিয়ে গেছে, তখন আমজাদ মাষ্টারকে খোঁজা শুরু করলাম। সে কি পাকসেনাদের সাথে পালিয়ে গেল? কিন্তু হাতবাঁধা অবস্থায় তার পক্ষে তো পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমি মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দিয়ে বললাম, “আমি নিশ্চিত, আমজাদ মাষ্টার পালিয়ে যেতে পারেনি। সে অবশ্যই আশেপাশে আছে। তোমরা জোর তল্লাশী চালাও। যেমন করে হোক তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।”
আবার সবাই তড়িঘড়ি করে তল্লাশী চালানো শুরু করল। হঠাৎ একজন মুক্তিযোদ্ধা চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, “স্যার, এদিকে আসেন।” আমরা যেদিক থেকে চিৎকারের শব্দ শোনা গিয়েছিল, সেদিকে দ্রুত অগ্রসর হলাম। দেখলাম খালের মধ্যে আমজাদ মাষ্টারের লাশ পড়ে আছে। সে উভয় পক্ষের গোলাগুলির মাঝখানে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। আমজাদ মাষ্টারের লাশটি পেয়ে আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। দ্রুত খাল হতে তার লাশটি উদ্ধার করে ক্যাম্পের দিকে ছুট লাগালাম। কারণ, যে কোন সময় পাক সেনাদের বড় কোন দল আমাদেরকে আবার আক্রমণ করে বসতে পারে।’
ফোরকানউদ্দিন একসাথে অনেক কথা বলে একটু থামলেন। তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি যেন হারিয়ে গেছেন একাত্তরেই। তার চোখ-মুখের চাহনি, কথা বলার ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। মাহি গোগ্রাসে গিলছিল সেইসব গৌরবোজ্জ্বল ঘটনার কথা। আমার মনে হচ্ছিল, এসব ঘটনা যেন আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। মাহি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর কী হল?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আমজাদ মাষ্টারের লাশটি নিয়ে আমরা নিরাপদে ক্যাম্পে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলাম। অবশ্য ততদিনে আমাদের ক্যাম্পটি মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। এর প্রমাণ পেলাম পরদিন সকালেই। আমজাদ মাষ্টারের লাশ দেখার জন্য শত শত মানুষ ভীড় জমিয়েছিল। যে কোন সময় পাক বাহিনী যে আমাদের ক্যাম্পটি আক্রমণ করে বসতে পারে, সে ভয়ও তাদের মধ্যে ছিল না। তাদের ভাব দেখে বুঝা যাচ্ছিল, পাক বাহিনী আক্রমণ করলে তারাও আমাদেরকে যুদ্ধে সরাসরি সাহায্য করবে। আমজাদ মাষ্টারের লাশটি দেখে তারা মৃত্যুর চিন্তাও ভুলে গিয়েছিল। কারণ তারা চিন্তাও করতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধারা দুর্ধর্ষ রাজাকার আমজাদ মাষ্টারকে মেরে ফেলেতে পারবে। আমজাদ মাষ্টারের লাশ দেখার পর সবাই বিশ্বাস করল যে আসলেই সে মারা গেছে। তারা আল্লাহর দরবারে দুহাত তোলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দোয়া করছিল। ততদিনে তাদের মধ্যে এ বিশ্বাস জন্মে গেছে যে মুক্তিযোদ্ধারা অচিরেই দেশকে স্বাধীন করে ফেলতে সক্ষম হবে।’
এতক্ষণ আমি এবং মাহি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম ফোরকানউদ্দিনের রোমাঞ্চকর যুদ্ধের কাহিনী। আমরা পুরো ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘এই যে আপনি যুদ্ধ করতে গেলেন, যুদ্ধ করলেন। যুদ্ধ করতে আপনার ভয় করেনি?’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘সেই সময় তো আমার কাছে যুদ্ধ একটি মজার খেলা হয়ে গিয়েছিল। ডধৎ রং হড়ঃযরহম নঁঃ ধ ড়হব শরহফ ড়ভ রহঃবৎবংঃরহম চষধু. যুদ্ধ জানলে সেই যুদ্ধটি মজার খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।
যুদ্ধের নয় মাস আমাদের কোনদিকে চলে গেল, আমরা নিজেরাই বলতে পারি না। হঠাৎ এল ডিসেম্বর মাস। আমরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলাম, স্বাধীন বাংলাদেশ। আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি। এই দেশ আমাদের। এই হাট-ঘাট-মাঠ আমাদের। এই গ্রাম-গঞ্জ-শহর আমাদের। এই ভাষা আমাদের। আমরা স্বাধীন জাতি। আমরা বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি। আমরা বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নিয়েছি। আমরা মুক্ত করতে পেরেছি আমাদের বাংলা মাকে। এখন আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। আমরা বর্বর পাক-সেনাদেরকে বিদায় করতে পেরেছি। আমরা তাদেরকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করতে পেরেছি।’
মন্তব্য করুন