যুদ্ধের মজার গল্প-৭
সায়েক আহমদ॥ গ্রীষ্মের বন্ধ। জেএসসি পরীক্ষার্থীদের বিশেষ ক্লাস নিচ্ছিলাম। এমন সময় মাহি ফোরকানউদ্দিনকে নিয়ে হাজির হল। তিনি ভেবেছিলেন বন্ধের দিন আমাকে বাসায় পাবেন। কিন্তু বাসায় গিয়ে জানলেন আমি স্কুলে চলে এসেছি। আমার বাসাটি স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতরেই। তাই তিনি মাহির সাথে স্কুলে চলে এসেছেন।
আমি শিক্ষার্থীদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা উনাকে চেনো নাকি?’
সবাই একসাথে বলে উঠল, ‘চিনি স্যার।’
শিক্ষার্থীদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তারা অত্যন্ত খুশি। আমার ক্লাসটিও প্রায় শেষ হয়ে আসছিল। এটাই ছিল আজকের দিনে তাদের শেষ ক্লাস। একটু পরই তাদের ছুটি হয়ে যাবে। তাই আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কি উনার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চাও?’
আমার কথা শুনে সবাই ভীষণ আনন্দিত হয়ে গেল। সবাই গল্প শুনতে চায়।
আমি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘তোমরা তো ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছো যে, তিনি একজন বীরপ্রতিক খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা। আমরা আজ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন কীভাবে বীরপ্রতিক উপাধি পেলেন তা জানার চেষ্টা করি। কি বলো?’
শিক্ষার্থীরা সমস্বরে বলে উঠল, ‘ইয়েস স্যার।’
শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দেখে ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘আমি খুবই খুশি হয়েছি তোমাদেরকে দেখে। তোমরা যে মুক্তিযুদ্ধের গল্প এত আগ্রহ সহকারে শোনতে চাও, এটা আমি আগে কখনো বুঝতে পারিনি। বীরপ্রতিক উপাধি কিন্তু দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশেষ মানদণ্ডের ভিত্তিতে। অনেকগুলো বীরত্বপূর্ণ ঘটনার ভিত্তিতে এবং বিভিন্ন ক্যাটাগরির পয়েন্ট যোগ করে উপাধিগুলো নির্ধারণ করা হয়। তবে আমি মনে করি আমার রায়গঞ্জ দখলের ঘটনা থেকেই বাংলাদেশ সরকার আমাকে বীরপ্রতিক উপাধির জন্য মনোনীত করেছিলেন। রায়গঞ্জ দখলের সেই যুদ্ধটি ছিল আমার জীবনের অন্যতম একটি রোমহর্ষক ঘটনা। অল্পের জন্য সে যুদ্ধে আমি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। তবে আজ কিন্তু আমি একটু অসুস্থ। এত বড় যুদ্ধের ঘটনাটি কি তোমাদের শোনাতে পারব?’
আমি দেখলাম ফোরকানউদ্দিন আজ বেশ অসুস্থ। কথা বলতে উনার বেশ কষ্ট হচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীদেরকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘একটা কাজ করা যেতে পারে। আমি এই ঘটনাটি কয়েকদিন আগে ফোরকানউদ্দিন সাহেবের নিকট থেকে জেনেছি। আজকে উনি অসুস্থ। কাজেই এই ঘটনাটি আমিই তোমাদেরকে শোনাচ্ছি।’
আমার কথা শোনে ফোরকানউদ্দিনও খুশি হলেন, শিক্ষার্থীরাও খুশি হল। আমি ফোরকানউদ্দিনের বীরপ্রতিক উপাধি পাওয়ার অন্যতম সেই যুদ্ধের কাহিনী শিক্ষার্থীদেরকে বলতে শুরু করলাম।’
রায়গঞ্জ দখলের রোমাঞ্চকর কাহিনী
‘১৯৭১ সালের ২০শে নভেম্বর। যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। ফোরকানউদ্দিন রংপুর ৬ নং সেক্টরের সাব সেক্টর সাহেবগঞ্জে অবস্থান করছেন। সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর নওয়াজেশ উদ্দিন। লেফটেন্যান্ট সামাদ সাহেবের নেতৃত্বে ২ কোম্পানি মুক্তিফৌজ নিয়ে ফোরকানউদ্দিনরা পাকবাহিনীর শক্ত ঘাটি রায়গঞ্জ দখল করতে গেলেন। যুদ্ধে যাবার আগে মেজর নওয়াজেশ উদ্দিন ফোরকানউদ্দিনকে নিভৃতে ডেকে বললেন, ‘ফোরকান, তোমায় গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলব।’
ফোরকানউদ্দিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী কথা স্যার?’
মেজর নওয়াজেশ বললেন, ‘লেফটেন্যান্ট সামাদ সাহেবের নেতৃত্বে তোমাদেরকে রায়গঞ্জ দখলের জন্য পাঠাচ্ছি। এবারের যুদ্ধটা কিন্তু একটি ভয়ংকর যুদ্ধ। যে কোন মূল্যে আমাদেরকে রায়গঞ্জ দখল করতেই হবে। ভয়ের কিছু নেই। এবারের যুদ্ধে মিত্রবাহিনী আমাদেরকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করবে।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘যুদ্ধকে কখনো ভয় করি না স্যার।’
মেজর নওয়াজেশ বললেন, ‘সেটা জেনেই তো তোমাকে সেখানে কমাণ্ডার হিসেবে পাঠাচ্ছি।’
ফোরকানউদ্দিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিন্তু আপনিই তো একটু আগে বললেন, আমাদের আজকের কমাণ্ডার লেফটেন্যান্ট সামাদ স্যার।’
মেজর নওয়াজেশ হেসে বললেন, ‘সেটা তো কাগজে কলমে।’
মেজর নওয়াজেশের কথা শুনে ফোরকানউদ্দিন বোকা বনে গেলেন। সেটা বুঝতে পেরে মেজর নওয়াজেশ বললেন, ‘প্রকৃতপক্ষে অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে যুদ্ধের প্রকৃত কমাণ্ডার হিসেবে আমি তোমাকে পাঠাচ্ছি। লেফটেন্যান্ট সামাদ তোমার চেয়ে সিনিয়র হলেও তার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা কম। কাজেই যুদ্ধের মূল দায়িত্ব তোমাকেই পালন করতে হবে। অবশ্য কারো কাছে আমি সেটা প্রকাশ করিনি। শুধুমাত্র তোমাকে বললাম।’
ফোরকানউদ্দিন বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি স্যার। আমার উপর আপনার এত নির্ভরতা আমাকে আরো সাহসী করে তুলেছে। ইনশাল্লাহ, আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করব।’
ফোরকানউদ্দিনরা প্রস্তুত হয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রায়গঞ্জ গিয়ে পাকসেনাদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। তবে অনভিজ্ঞ কমাণ্ডার লেফটেন্যান্ট সামাদ সাহেবের ভুল নির্দেশনায় ফোরকানউদ্দিনসহ একপ্লাটুন মুক্তিফৌজ শত্রুপক্ষের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। যখন সবাই ভুলটি বুঝতে পারলেন, তখন আর করার কিছুই ছিল না। ওদিকে পাকসেনারাও ফোরকানউদ্দিনদের এ দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারা ভাবতেও পারেনি, মুক্তিফৌজরা তাদের এত কাছে এসে পড়বে। তারা মুক্তিফৌজদের উপস্থিতি টের পেয়ে মেশিনগানের সাহায্যে চারদিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। সামান্য ভুলের কারণে আকস্মিক এ আক্রমনে নিমিষের মধ্যেই মুক্তিফৌজের অনেকে আহত এবং নিহত হয়ে গেলেন। ফোরকানউদ্দিন এবং সামাদ সাহেব মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচালেন। কিন্তু তাদের আশেপাশে অনেক আহত মুক্তিযোদ্ধা পানি পানি বলে চিৎকার করছিল। কিছুক্ষণ পর সেই কান্নাও বন্ধ হয়ে গেল। ফোরকানউদ্দিন নিশ্চিত হলেন তারা মারা গেছেন। তিনি মাটিতে শোয়া অবস্থায়ই ওয়্যারলেসের সাহায্যে কন্ট্রোলকে ম্যাসেজ দিলেন, ‘নিহত দশ, গুরুতর আহত প্রায় পনেরো জন।’
শত্রুপক্ষ ফোরকানউদ্দিনের কণ্ঠ শুনে গালিগালাজ করতে থাকে। তারা মুক্তিসেনাদের বিপর্যস্ত অবস্থা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য প্লাটুনসমূহ শক্ত অবস্থান নেয়ায় কাছে আসতে সাহস পাচ্ছিল না। এমন সময় লেফটেন্যান্ট সামাদ সাহেব বললেন, ‘আমার কাছে ওয়্যারলেসের মাইক্রোফোনটা দেন। আমি কথা বলব।’ ওয়ারলেস সেটটি ফোরকানউদ্দিনের পিঠে বাঁধা ছিল। তিনি একটু দ্বিধাগ্রস্থ ভঙ্গিতে সামাদ সাহেবের হাতে মাইক্রোফোনটি দিয়ে দিলেন এবং মাটিতে মাথা লাগিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকলেন। ওদিকে লেফটেন্যান্ট সামাদ সাহেব কথা বলতে গিয়ে মাথাটি সামান্য একটু উঁচু করলেন। ব্যস, সর্বনাশটা ঘটেই গেল। আকস্মিকভাবে শত্রুপক্ষের গুলি এসে তাঁর মাথায় আঘাত করল। তিনি শুধু বললেন, ‘ইস্!’ এরপর আর কোন শব্দ নেই।
ফোরকানউদ্দিন সামাদ সাহেবের গায়ে ঝাঁকি দিয়ে ‘স্যার, স্যার’ বলে ডাকা শুরু করলেন। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ করেই ফোরকানউদ্দিন বুঝতে পারলেন সামাদ সাহেব আর বেঁচে নেই।
ওদিকে পাকবাহিনীর মেশিনগানের গুলি অনবরত ফোরকানউদ্দিনের পিঠের উপর দিয়েই ছুটে চলছে। তিনি সামাদ সাহেব মারা যাবার আগেই একটি কাজ সেরে নিয়েছিলেন। মাটিতে ঝাঁপ দিয়ে যে জায়গায় পড়েছিলেন, সেখানে প্রথমেই হাত দিয়ে এবং পা দিয়ে যতটুকু পারেন মাটি খুঁড়ে আড়ের জায়গাটুকু নিশ্চিত করে নিয়েছিলেন। তিনি তার গাল মাটির সাথে লাগিয়ে কথা বলছিলেন। কারণ মাথা উঁচু করলেই মৃত্যু নিশ্চিত। একটু আগে সামাদ সাহেবও এ সামান্য ভুলটি করে বেঘোরে প্রাণটি হারিয়েছেন। কাজেই ফোরকানউদ্দিন ঐ অবস্থায় থেকেই মৃত সামাদ সাহেবের হাত থেকে সতর্কতার সাথে মাইক্রোফোনটি নিজের কাছে নিয়ে এলেন।
সামাদ সাহেবের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তিনি কন্ট্রোলকে ম্যাসেজ দিলেন, ‘সামাদ সাহেব মারা গেছেন।’ খুব নিচুগলায় কথা বললেও পাকসেনারা ফোরকানউদ্দিনের কণ্ঠ শুনে ফেলল। তারা তখন আবারো গালিগালাজ শুরু করে এবং তাঁকে ধরার জন্য প্রস্তুতি নেয়। তারা বলতে থাকে, ‘শালে মালাওনকা বাচ্চা, আবি তুমকো জিন্দা পাকার লেকে য্যায়গা।’ অর্থাৎ ‘শালা মালাউনের বাচ্চা, তোকে জীবিত ধরে নিয়ে যাব।’
প্রকৃতপক্ষে ফোরকানউদ্দিনের পাশে তখন মুক্তিফৌজের সুস্থ সমর্থ্য কেউ ছিল না। কিন্তু ফোরকানউদ্দিন এতেও মনোবল হারালেন না। তিনি ভাবলেন ভয় পেলেই আর বেঁচে ফিরতে হবে না। মেজর নওয়াজেশের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলেন তা তার মনে পড়ে গেল। ওদিকে পাক সেনারাও বুঝে ফেলেছে ফোরকানউদ্দিন একাই জীবিত আছেন। তখন তারা তাকে ধরে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। ফোরকানউদ্দিনও বিষয়টি অনুভব করতে পারলেন। সাথে সাথে তিনি উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকেন, ‘আলফা কোম্পানি, ব্রেভো কোম্পানি ফায়ার এন্ড এডভান্স!’ পাকসেনারাও ব্যাপারটি বুঝতে না পারায় ফোরকানউদ্দিনের উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগল। শত্রুপক্ষ বিভ্রান্ত হল। তারা মনে করল ফোরকানউদ্দিনের আশেপাশে যে দুই কোম্পানী সৈন্য আছে তারা বোধহয় এক্ষুণি আক্রমণ চালাবে। কাজেই তারা ঝুঁকি নিয়ে ফোরকানউদ্দিনকে ধরার জন্য আর কোন সাহস প্রদর্শন করল না।
ফোরকানউদ্দিন সুযোগটা কাজে লাগালেন। তিনি মাটিতে গাল ঠেকিয়ে মাইক্রোফোনে অনবরত বলতে শুরু করলেন, ‘আলফা কোম্পানি, ব্রেভো কোম্পানি ফায়ার এন্ড এডভান্স!’
শত্রুপক্ষও একটানা কামান দাগছিল। তাদের কামানের গোলা ফোরকানউদ্দিনের পিঠের উপর দিয়ে অনেক পেছনে চলে যাচ্ছিল। ঐ মুহূর্তে কন্ট্রোল থেকে ম্যাসেজ এলো ‘ফোরকান, তুমি পেছনে চলে আস।’ ফোরকানউদ্দিন ভাবলেন, ‘আমার সঙ্গীদেরকে ফেলে আমি পেছনে যাব কেন? যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গিয়ে বাঁচার চেয়ে মরাই শ্রেয়।’
ফোরকানউদ্দিন ফিরছেন না দেখে ক্যাপ্টেন নোওয়াজেশ উদ্দিন তখন মেসেজে বললেন, ‘ফোরকান তোমার অবস্থান ভাল নয়। অন্যদেরকে হারালে যা ক্ষতি হবে, তোমাকে হারালে আমাদের অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে।’ ফোরকানউদ্দিন তখন প্রচন্ড চাপের মধ্যে আছেন। ঐ অবস্থায়ও তিনি মনোবল না হারিয়ে অতি সাহস নিয়ে বললেন, ‘সুনির্দিষ্ট টার্গেটে কামান দাগান।’ ফোরকানউদ্দিনের মেসেজ পেয়েই মিত্রবাহিনীও পাল্টা কামান দাগতে শুরু করলো।
ফোরকানউদ্দিন তখন আরো বিপদে পড়ে গেলেন। কারণ, শত্রুবাহিনীর কামানের গোলা তার পিঠের উপর দিয়ে অনেক দূরে পিছনে চলে যাচ্ছিল। কারণ শত্রুপক্ষ ফোরকানউদ্দিন কোথায় আছেন সে টার্গেটটি নির্ভুলভাবে নিশানা করতে পারেনি। অন্যদিকে মিত্রবাহিনীও কামান দাগছে। মিত্রবাহিনীর কামানের গোলাও তার মাথার উপর দিয়ে শত্রুপক্ষকে আঘাত হানছে। তবে ওয়্যারলেসে ফোরকানউদ্দিনের নির্ভুল নির্দেশনায় মিত্রবাহিনীর গোলার আঘাতে পাকসেনারা অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হল। অবশ্য ফোরকানউদ্দিন তখন দু পক্ষের মাঝখানে থাকায় যে কোন মুহূর্তে মৃত্যুর আশংকা করে নিবিড়মনে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকলেন।
মিত্রবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমনে শত্রুপক্ষ পিছু হটতে থাকল। এতে ফোরকানউদ্দিন মৃত্যুও দোড়গোড়ায় পৌঁছে গেলেন। কারণ আগে শত্রুপক্ষ কাছে থাকায় তাদের কামানের গোলা ফোরকানউদ্দিনের গায়ে না লেগে তার মাথায় উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু শত্রুপক্ষ যতই পিছু হটতে থাকল ততই কামানের গেলা ফোরকানউদ্দিনের আশেপাশে পড়তে থাকল। ধীরে ধীরে কামানের গোলা তার দিকে এগুতে থাকল। শেষটায় একটা গোলা এসে ফোরকানউদ্দিনের পাশেই বিস্ফোরিত হল। প্রচন্ড বিস্ফোরণে নিচ থেকে মাটি উপর দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সেই মাটির নিচে ফোরকানউদ্দিন চাপা পড়ে গেলেন।
এবার ফোরকানউদ্দিন পড়লেন মহাবিপদে। কারণ মাথা উঁচু করলে শত্রুপক্ষের গুলিতে প্রাণ হারাবেন। অন্যদিকে মাটির নিচে থাকলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাবেন। এখানেও তিনি উপস্থিত বুদ্ধি খাটালেন। মাথা ঠান্ডা রেখে অল্প অল্প করে নাকের সামনের মাটিগুলো সরিয়ে শ্বাস ফেলার সুযোগ করে নিলেন।
মু্িক্তবাহিনী-মিত্রবাহিনীর আক্রমণ জোরদার হল। শত্রুবাহিনী পিছু হটতে শুরু করল। অবশেষে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটা দল এসে ফোরকানউদ্দিনকে মাটি চাপা অবস্থা থেকে উদ্ধার করল এবং নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেল। এভাবেই রায়গঞ্জ মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
এখানে ফোরকানউদ্দিনের সাহস, ন্যায়পরায়ণতা, দেশপ্রেম, শারীরিক যোগ্যতা, দক্ষতা এবং উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। আসলে ফোরকানউদ্দিনের কাছে যুদ্ধ একটি মজার খেলা হয়ে গিয়েছিল। War is nothing but a one kind of interesting Play. সত্যিকার অর্থে যুদ্ধ জানলে সেই যুদ্ধটি মজার খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ফোরকানউদ্দিনকে উদ্ধার করে ক্যাম্পে নিয়ে আসা হল। সাব-সেক্টর মেডিকেল অফিসার তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। কারণ এ ধরণের পরিস্থিতি থেকে বেঁচে আসা লোকজন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। মেডিকেল বোর্ড ফোরকানউদ্দিনকে নিয়ে এই ধরণের চিন্তা করছিল। সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী ফোরকানউদ্দিনকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা হলো। কিন্তু ফোরকানউদ্দিন এসব কিছু বুঝতে না পেরে রাগ করে বললেন, ‘স্যার, সারারাত মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে ফিরলাম। কিন্তু এখন দেখছি আপনারা আমাকে মেরে ফেলবেন।’ ফোরকানউদ্দিনের মেডিকেল অফিসার তার কথা শুনে অবাক কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘কী বলছো ফোরকান! আমরা তোমাকে মারবো কেন?’
ফোরকানউদ্দিন কিছুটা অভিমান ভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘এই যে, আমাকে বন্দী করে রেখে আপনারা কত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। এসব আমার মোটেও ভাল লাগছে না।’
ফোরকানউদ্দিনের মেডিকেল অফিসার বললেন, ‘ফোরকান এসব তোমার ভালোর জন্যই করা হচ্ছে।’
কর্তৃপক্ষ নির্দেশ জারি করলেন ২৪ ঘণ্টা ফোরকানের সাথে কেউ কথা বলতে পারবে না। খাওয়া দাওয়া শেষ করে তাকে বিশ্রামে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হল। ফোরকানউদ্দিন আর কী করবেন? তিনিও খাওয়াদাওয়া সেরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন।
ঐদিন বিকালে কমান্ডিং অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকান, তোমার ভালো শার্ট-প্যান্ট আছে?’
ফোরকান কিছু বুঝতে না পেরে রাগ করে বললেন, ‘স্যার এসব কি করছেন। আমি সাহেবগঞ্জ বাজারে যাব। সকলের সাথে দেখা না করলে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ব।’
মেডিকেল অফিসার বললেন, ‘তুমি নতুন জীবন পেয়েছ, আমরা সেই ব্যবস্থা করছি। তোমার দেখা করতে হবে না, তারাই তোমাকে দেখতে আসছে।’
ফোরকানউদ্দিনের পাশে থাকা লেফটেন্যান্ট সামাদ সাহেব মারা গেছেন। ফোরকান যে বেঁচে আছেন এ্ই কথাটা কেউ বিশ্বাস করেনি। সে জন্য উৎসুক জনতা ক্যাম্পের চারদিকে ভীড় জমিয়ে ফোরকানকে দেখার জন্য অনুরোধ করেন।
জনতার অনুরোধে ফোরকানউদ্দিনকে একটা টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে দেয়া হল। ফোরকান দেখলেন সাব-সেক্টরের চারিদিকে হাজার হাজার মানুষ অবস্থান করছে। ফোরকানকে দেখে সবাই হাততালি দিয়ে আনন্দ উল্লাস করতে থাকলেন।
দুদিন পর মিত্রবাহিনীর ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা ক্যাম্পে এলেন। জানা গেল তিনি ফোরকানকে নিয়ে যেতে এসেছেন। কমান্ডিং অফিসার খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারপরও ফোরকানকে নিয়ে যাবার জন্য অনুমতি দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে নিয়ে যান।’
মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা ফোরকানউদ্দিনকে তাদের ইউনিটগুলোতে নিয়ে গেলেন। ফোরকানউদ্দিন বুঝতে পারছেন না কি হচ্ছে। ঐ কর্মকর্তা তখন ইউনিটের সকল সৈন্যদেরকে একত্রিত করলেন। ফোরকানউদ্দিনকে তাদের সামনে উপস্থিত করিয়ে বললেন, ‘দেখো মুক্তিবাহিনীকো এতনা নাটা অপারেটর রায়গঞ্জ দখল কিয়া। তুম লোগকো এয়সা হিম্মত হোনা চাহিয়ে।’ তিনি হিন্দিতে কথা বলছিলেন। এর অর্থ হল, ‘তোমরা দেখো মুক্তিবাহিনীর এত খাটো অপারেটর রায়গঞ্জ দখলে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেন। তোমাদের মধ্যে এমন সাহস থাকা দরকার।’
ফোরকানউদ্দিনকে আবার সাব-সেক্টরে ফিরিয়ে দেয়া হল। আবার মেডিকেল বোর্ডের আক্রমণ। ‘কি কি খেয়েছেন, কোথাও কোনো অসুবিধা আছে কি না।’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য এবার আর ফোরকানউদ্দিনের খারাপ লাগছিল না।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল ফোরকানউদ্দিনের জন্য স্মরণীয় ঘটনা। রায়গঞ্জ দখলের ঘটনা ছাড়াও ফোরকানউদ্দিনের জীবনে আরো অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা আছে। তবে ফোরকানউদ্দিন মনে করেন সম্ভবত রায়গঞ্জ দখলে আনার রণকৌশলের উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করেন।’
মন্তব্য করুন