যুদ্ধের মজার গল্প-৮
সায়েক আহমদ॥ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিকের সাথে আমার এবং মাহির বেশ ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। ক্লাস থ্রিতে পড়লেও মাহির অদম্য কৌতুহল আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে অনুপ্রাণিত করেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিক এর বয়স এখন ৭০ এর উপরে। আমার উৎসাহে এবং মাহির আগ্রহে তিনি হয়ে উঠেছেন টগবগে যুবক। আমিও তাঁর কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ। ভাবলাম দেশ স্বাধীন করায় যেভাবে তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন, এখনও দেশের জন্য তাঁর ভালবাসা এতটুকু কমে যায়নি। তার বাসা থেকে আমার স্কুল কোয়ার্টারের দূরত্ব তিন কিলোমিটার এর কম নয়। মাঝে মাঝে তিনি হাঁটতে হাঁটতেই চলে আসেন আমার বাসায়। এই বয়সেও যে তিনি প্রায় স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করছেন তা দেখে আমিও অবাক হয়ে যাই। অথচ তার সাথের বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই চলে গেছেন চিরবিদায়ের দেশে। তাঁকে দেখে আমি নিজেই প্রচন্ড অনুপ্রাণিত হচ্ছিলাম।
একদিন ফোরকানউদ্দিনের বাসায় গিয়ে দেখলাম তার আম্মা এসেছেন। আমি তো অবাক। কারণ ফোরকানউদ্দিনের আম্মার বয়স একশত বছরের কম হবে না। বাসায় ফোরকানউদ্দিনের বড় ভাইয়ের সাথেও পরিচয় হল। উনার বয়সও আশির কম হবে না। আমি যেন দীর্ঘায়ু এক পরিবারে চলে এসেছি। ফোরকানউদ্দিনের আম্মা তার সাথে এমনভাবে কথা বলছেন যেন এখনও তিনি একটি শিশু। যুদ্ধ প্রসঙ্গে আলাপ করতে করতে একসময় আমরা চলে গেলাম ফোরকানউদ্দিনের শৈশবে। ফোরকানউদ্দিনের আম্মার নাম হাজেরা খাতুন মুক্তামা। একসময় তিনি ছিলেন একজন সুগৃহিণী। তিনি জানালেন ১৯৫১ সালের ১৪ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার থোল্লাকান্দি গ্রামের বড়বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তার প্রিয় ছেলে ফোরকান উদ্দিন। পিতা আব্দুস ছাত্তার মিয়া ছিলেন সলিমগঞ্জ বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তাঁত কারখানার জন্য তিনি নবীনগর থানায় অত্যন্ত সম্মানিত একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। হাজেরা খাতুন তাঁর রান্না এমন এক শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি সবাই তাঁর হাতের রান্না খাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। ফোরকানরা ছিলেন ৮ ভাই ৩ বোন।
ফোরকান উদ্দিন এর শৈশবের মজার কিছু ঘটনা
ফোরকানউদ্দিনের মা হাজেরা খাতুন মুক্তামা এবং তার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে জানা গেল ফোরকান উদ্দিন এর শৈশবের মজার কিছু ঘটনা। ফোরকানউদ্দিনের শৈশবের সেইসব ঘটনা আমার কাছে খুবই মজার মনে হল। সেখান থেকে কয়েকটি ঘটনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হল।
ফোরকান মরে নাই
দেশে তখন কলেরা-বসন্তের মহামারী দেখা দিয়েছে। ফোরকানউদ্দিন ও তাঁর বড় ভাই কলেরায় আক্রান্ত হয়েছেন। অবস্থা খুবই খারাপ। এক সময় ফোরকানউদ্দিনের নড়াচড়াও বন্ধ হয়ে গেল। বাবা-মা ধরেই নিলেন ফোরকানউদ্দিন মারা গেছেন। কাজেই তাঁকে একপাশে রেখে তাঁর বড়ভাইকে ঔষধপথ্য দিচ্ছেন। হঠাৎ তার মা দেখলেন ফোরকান যেন একটু নড়ে উঠল। সাথে সাথে তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘আমার ফোরকান মরে নাই!’
সবাই এবার ফোরকানের দিকে তাকালেন। আশ্চর্য, সে তো আসলেই জীবিত রয়েছে। আবার সবাই ফোরকানকে নিয়ে মেতে ওঠলেন। তাকে কমলার রস, পানি ইত্যাদি খাওয়াতে থাকলেন। ভাগ্য সহায়। রাখে আল্লাহ, মারে কে? এবারের মত প্রাণ ফিরে পেলেন ফোরকান উদ্দিন। খুশির আতিশয্যে মা-বাবার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি নেমে এল।
সাপের ছোবলে ফোরকান
আবারো মৃত্যুর মুখোমুখি ফোরকান। এবার ছোবল মেরেছে বিষাক্ত সাপ। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের আহাজারিতে ভরে উঠল আকাশ-বাতাস। টানা দুইদিন চলল চিকিৎসা। কিন্তু ফোরকানউদ্দিনের জ্ঞান আর ফিরে আসে না। সবার সন্দেহ ফোরকান বোধহয় এবার মারাই গেছে। অবশেষে অনেক সাধ্য-সাধনার পর জ্ঞান ফিরল ফোরকানের। চোখ মেলে তাকালেন তিনি। দেখলেন শত শত উৎসুক লোক বাড়িতে ভীড় জমিয়েছে। সবাই উদগ্রীব হয়ে তাঁকে দেখছে। ফোরকানউদ্দিন তো অবাক! জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত লোক এখানে কেন?’
ফোরকানউদ্দিনের প্রশ্ন শুনে উৎসুক জনতা খুশির চোটে হো হো করে হেসে উঠলেন।
ফোরকানের উপস্থিত বুদ্ধি
ফোরকান তখন ৫ম শ্রেণির ছাত্র। ফোরকানউদ্দিনের শিক্ষক তাঁকে একটি ধাঁধাঁ জিজ্ঞেস করলেন। ধাঁধাঁটি হল, ‘একজন লোক হেঁটে যাচ্ছে। পেছন থেকে কেউ তাঁকে বাবা-বাবা বলে ডাকছে। কিন্তু সে তার ছেলে নয়। সে তাহলে কে?’ ফোরকান সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘ছেলে যখন নয়, তাহলে সে অবশ্যই তার মেয়ে।’
শিক্ষক অত্যন্ত খুশি হয়ে ফোরকানের মাকে বললেন, ‘তোমার ছেলে খুব বুদ্ধিমান হবে। যে প্রশ্নের উত্তর অনেক বড় বড় মানুষও সহজে দিতে পারেনি, ফোরকান মুহূর্তের মধ্যেই সে প্রশ্নের উত্তরটি দিয়ে দিয়েছে।’ ছেলের প্রশংসা শুনে আনন্দে ফোরকানউদ্দিনের মায়ের চোখ ভিজে গেল।
ফোরকানের ভবিষ্যৎ আছে
মৌখিক পরীক্ষায় ফোরকান পেয়েছে ৫০ এর মধ্যে ৪৮। কিন্তু ফরিদা নামে একটি মেয়ে পেয়েছে ৫০। সবাই ক্ষেপে আগুন। সবার একই কথা, ‘ফোরকানকে কেন ৪৮ দেয়া হল? সে তো ফরিদার চেয়ে অনেক ভাল।’ ফরিদার আব্বা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন সমাজপতি। তার প্রতি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একটা দুর্বলতা থাকতেই পারে। কাজেই ফরিদাকে ৫০ নম্বর দেয়ায় কারো কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ফোরকানকে ৫০ নম্বর না দেয়ায় সবাই তীব্র আপত্তি জানাচ্ছেন। উপায়ান্তর না দেখে প্রধান শিক্ষক সবাইকে থামিয়ে বললেন, ‘ফোরকানের ৫০ এ ৫০ পাওয়ার যোগ্যতা অবশ্যই আছে। এটা আমরা সবাই জানি। তবে সে তো ছেলে। সামনে তার ভবিষ্যৎ আছে। আমরা ইচ্ছে করেই তাকে ২ নম্বর কম দিয়েছি। এতে করে সে আরো বেশি বেশি পড়াশোনা করে আরো ভালো ফলাফল অর্জন করবে।’
কুসংস্কারের কবলে ফোরকান
ফোরকান দেখতে ছোটখাটো। তুলতুলে। ফোরকানের আম্মাকে ধমকে উঠে তাঁর দাদী বলে উঠলেন, ‘মুক্তামা, তুই তোর ছেলেকে মেরে ফেলতে চাইছিস নাকি? দুবার তো মৃত্যুর মুখ থেকে সে ফিরে এসেছে। এবার তার দিকে একটু নজর যে। নাহলে মানুষ তাঁকে নজর দিয়ে দেবে।’ ফোরকানের মা তখন স্কুলে যাবার সময় ফোরকানের মুখে সামান্য কালি লাগিয়ে দিলেন। এসব কুসংস্কার প্রথা তখন বেশ চালু ছিল।
সার্কাসে পাঠিয়ে দিন
ফোরকান সার্কাস দেখতে পছন্দ করতেন। সার্কাস দেখে দেখে অনেক খেলা তখন শিখে ফেলেছেন। সারাক্ষণ লোকজনকে সার্কাসের খেলা দেখিয়ে ফোরকানের দিন কাটছিল। ফোরকানের আম্মা এতে খুব বিরক্ত হলেন। ওদিকে লোকজন তখন ফোরকানের আম্মাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, ‘আপনার ছেলে তো সার্কাসের ভাল ভাল খেলা দেখাতে পারে। এক কাজ করুন না। ফোরকানকে সার্কাসে পাঠিয়ে দিন। এতে সে বেশ নাম করতে পারবে।’ লোকজনের এ ধরণের পরামর্শ শুনে ফোরকানের আম্মা ক্ষেপে গেলেন। ফোরকান বাসায় ফিরলে ঐদিনই তার আম্মা ফোরকানের পিঠে সার্কাসের খেলা দেখিয়ে দিলেন। আর ফোরকানও সার্কাসে যোগ দেয়ার স্বপ্ন ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।
গীতিকারের মার খাওয়া
ফোরকানদের স্কুলটা প্রত্যন্ত গ্রামে। কিন্তু তারপরও স্কুলে প্রতি বৃহস্পতিবার বিভিন্ন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। ততদিনে ফোরকানের মধ্যে একটি প্রতিভা দেখা দিয়েছে। তিনি বানিয়ে বানিয়ে গান এবং কবিতা লেখা শিখে ফেলেছেন। একদিন আগ্রহের আতিশয্যে ফোরকান একটি সারিগান এবং একটি কবিতা লিখে বাংলা শিক্ষকের নিকট জমা দিলেন। বাংলা শিক্ষক এসব পড়ে তো রেগে আগুন। কারণ তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না যে এগুলো ফোরকান লিখেছেন। ফোরকানের বয়সী কেউ যে সারিগান কিংবা কবিতা লিখতে পারে এটা ছিল তার কল্পনারও বাইরে। কাজেই তিনি ভাবলেন ছেলেটি এত অল্প বয়সে নকল করা শিখে ফেলেছে। আবার মিথ্যে কথাও বলছে। তাই ফোরকানকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য তিনি ভাল করে উত্তম-মধ্যম লাগিয়ে দিলেন। ফোরকান তো হতবাক। গান-কবিতা লিখে কোথায় প্রশংসা পাবেন, তা নয়, উল্টো কিনা কপালে জুটল বিনা কারণে শাস্তি!
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন