যুদ্ধের মজার গল্প-৯
সায়েক আহমদ॥
ফোরকান উদ্দিন এর শৈশবের মজার কিছু ঘটনা
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিকের বাসায় গিয়ে তার আম্মা এবং বড়ভাইয়ের সাথে ফোরকান উদ্দিন এর শৈশবের মজার কিছু ঘটনা শুনছিলাম। ফোরকানউদ্দিনের আম্মার বয়স একশত বছরের কম হবে না। কিন্তু এখনো তার স্মরণশক্তি এবং শারীরিক সুস্থতা দেখে অবাক হতে হয়। ফোরকানউদ্দিনের শৈশবের সেইসব ঘটনা আমার কাছে খুবই মজার মনে হল। সেখান থেকে কয়েকটি ঘটনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হল।
চাষী ফোরকান
ফোরকানের নেশা নৌকাদৌড়, গরুদৌড়, মাঠে গরু চড়ানো, কৃষিকাজ করা ইত্যাদি। বাবা-মা ভাবতেন সে বোধহয় লেখাপড়া করবে না। একদিন লাঙ্গল-গরু নিয়ে ফোরকান মাঠে যাচ্ছে। এমন সময় ফোরকানের আব্বার চাচা ডাক্তার তাজুল ইসলাম, যিনি বিদ্যালয়ের সভাপতি তিনি খুব রাগ করে ফোরকানের পিতাকে বললেন, ‘তুমি কেন তাকে হালচাষে পাঠালে?’
ফোরকানের আব্বা লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘চাচাজী, আমরা তো তাকে কাজের কথা বলি না। সে নিজে নিজে চলে যায়। কখন কোথায় ঘুরে বেড়ায়, আমরা বলতেও পারি না।’
ফোরকানের আব্বার কথায় উনার চাচা অর্থাৎ ফোরকানের দাদা প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেন। বললেন, ‘তুমি এক্ষুণি গিয়ে ফোরকানকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দাও।’
এরপর থেকে তাঁর বই-খাতা, কাপড়-চোপড় সবই নিয়ে ফোরকান চলে গেলেন তার দাদার ঘরে। ফোরকানের দাদা-দাদী দুজনেই ফোরকানকে খুবই আদর করতেন।
ভবিষ্যৎবক্তা ফোরকান
একবার গ্রামে নৌকাদৌড় প্রতিযোগিতা হবে। একজন ফোরকানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকান, বলতে পারবে কার নৌকা জিতবে?’
ফোরকান বিজ্ঞের মত উত্তর দিলেন, ‘সুন্দর আলীর নৌকা জিতবে।’
যথাসময়ে নৌকাদৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতার পর সুন্দর আলীর নৌকাই জয়লাভ করল। ফোরকানের ভবিষ্যৎবাণী ফলে যাওয়ায় চারিদিকে দ্রুত তাঁর নাম ছড়িয়ে গেল। এরপর যত প্রতিযোগিতাই হোক সবাই ফোরকানকে জিজ্ঞেস করত, ‘ফোরকান, কার নৌকা জিতবে?’
ভবিষ্যৎবক্তার বিপদ
কাকতালীয়ভাবে ফোরকানের কিছু ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হয়ে যাওয়ায় ফোরকানের বিপদ বেড়ে গেল। কারণ প্রতিযোগিতায় যাদের নৌকা জয়লাভ করে, তারা ফোরকানের খুব নামডাক করে। অন্যদিকে যারা হেরে যায়, তারা নিজেদেরকে অভাগা মনে করে। একবার গ্রামে এ বিষয় নিয়ে খুব ঝগড়াঝাটি হল। তখন মোড়ল টাইপের একজন সবাইকে থামালেন। বললেন, ‘দেখো একটা বাচ্চা ছেলের কথা নিয়ে এসব পাগলামো করা ঠিক হবে না।’ সবাই নিজেদের ভুল বুঝতে পারল। এরপর থেকে সবাই ফোরকানকে খুব আদর করল।
চোর ফোরকান
ফোরকানদের পাশের বাড়ির জাম্বুরা গাছে প্রচুর জাম্বুরা ধরেছে। তিনি ঐ বাড়ির ভাবীকে মজা করে বললেন, ‘ভাবী, আমাকে জাম্বুরা না দিলে, চুরি করে নিয়ে যাব।’
ঘটনাচক্রে ঐ রাত্রেই গাছের সকল জাম্বুরা চুরি হয়ে গেল। ফোরকান হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন!
পাশের বাড়ির ভাবী ফোরকানের আব্বা-আম্মাকে ফোরকানের সাথে গতদিনের কথাবার্তার কাহিনী খুলে বললে ঘটনাটা রাষ্ট্র হয়ে গেল। ফোরকানের পরিবারের সবাই নিশ্চিত হলেন এটা নিঃসন্দেহে ফোরকানেরই কাণ্ড! কাজেই সবাই মিলে ফোরকানকে বেদম মার দেয়া শুরু করলেন। ঘটনা বেগতিক দেখে ফোরকানের চাচা এসে ফোরকানকে এদের হাত থেকে উদ্ধার করলেন। কিন্তু সবাই রেগেমেগে অস্থির। ফোরকানের কারণে আজ পরিবারের মান-সম্মান ধূলোয় মিশে যেতে বসেছে। সবাই ফোরকানকে ধরে আবার শাস্তিপর্ব শুরু করতে চাইছেন। এমন সময় পাশের গ্রাম থেকে ফোরকানের খালাম্মা দৌড়ে এলেন। ঘটনাটা দেখে সবাইকে বললেন, ‘সবাই থামো। ফোরকানকে মারছো কেন?’
ফোরকানের উপর সবাই ভীষণ ক্ষিপ্ত। কেন ক্ষিপ্ত তা ফোরকানের খালাম্মাকে খুলে বলা হল। ফোরকানের খালাম্মা সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকান যে চুরি করেছে, তা কি তোমরা দেখেছো?’
সবাই মাথা নেড়ে জানালো কেউ দেখেনি। তখন ফোরকানের খালাম্মা সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কাউকে না জেনে অপরাধী সাব্যস্ত করা ঠিক নয়। ফোরকান মজা করে বলেছিল যে সে চুরি করবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেই চুরি করেছে। আর তোমাদের তো এটুকু অন্তত বোঝা উচিৎ ছিল যে, দুই বস্তা জাম্বুরা চুরি করে ফোরকান কি করবে?’
ফোরকানের খালাম্মার কথায় সবাই চুপ করে গেলেন। কারণ, তারা শুধু শোনা কথার উপর ভিত্তি করেই ফোরকানকে চোর সাব্যস্ত করে শাস্তি দিচ্ছিলেন।
সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে ফোরকানের খালাম্মা বললেন, ‘আজ সকালে আমাদের গ্রামে দুই বস্তা জাম্বুরাসহ চোর ধরা পড়েছে। চোর স্বীকার করেছে যে সে মোল্লাকান্দি গ্রাম থেকে জাম্বুরাগুলো চুরি করেছে।’
ফোরকানের খালাম্মার কথা শুনে সবাই খুবই লজ্জ্বা পেলেন। গাছের মালিক জাম্বুরা ফেরত পেলেন। নিরাপরাধ ফোরকানও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু যে শাস্তি পেলেন, তা তো আর ফেরৎ দেয়া যাবে না। কাজেই প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘ভুলেও আর কখনো মিথ্যে কথা বলবেন না।’
ফোরকান গেল কই
ফোরকানকে দুই দিন ধরে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আত্মীয়স্বজন সবাই চারদিকে খোঁজাখুজি শুরু করেছেন। ফোরকানের আম্মা তো ফোরকানের আব্বার উপর মহাখাপ্পা হয়ে আছেন। ঘটনাটা হল, ফোরকান ছিলেন পিতৃভক্ত। ঐদিন ফোরকানের আব্বা যাবেন নবীনগর। কিছুতেই ফোরকানকে সাথে নেবেন না। ফোরকানও কম নয়। পিতার পিছু পিছু পুত্র রওনা হলেন। দুই তিন মাইল যাবার পর হঠাৎ ফোরকান তার আব্বাকে হারিয়ে ফেললেন। অপরিচিত জায়গা। নার্ভাস হয়ে ফোরকান হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন। একজন মহিলা তা দেখে জোর করে তাদের বাড়িতে অসহায় ফোরকানকে নিয়ে গেলেন।
ওদিকে ফোরকানের আব্বা নবীনগর থেকে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকান কই?’
ফোরকানের আম্মা তো অবাক! বললেন, ‘ফোরকান না তোমার সাথে গেছে!’
‘আরে বল কি!’ আঁতকে উঠলেন ফোরকানের আব্বা। শুরু হল মা-বাবা ভাইবোনের আহাজারি আর কান্না।
অবশেষে অনেক খোঁজ খবরের মাধ্যমে দুদিন পর ঐ বাড়ি থেকে ফোরকানকে উদ্ধার করা হল।
ফোরকানের বিয়ের আলাপ
ফোরকান স্কুলের পাশের পুকুরে গোছল করতে গেছেন। এমন সময় ফোরকানের সহপাঠি ফরিদা কাছে এসে ফোরকানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকান, তুমি স্কুলে যাও নাই কেন?’ বলতে না বলতেই পা পিছলে ফরিদা পড়ে গেলেন। ফোরকান ফরিদাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ফরিদাকে নিয়েই ফোরকান পুকুরে পড়ে গেলেন।
সাথে সাথে রাষ্ট্র হয়ে গেল, ফোরকান ফরিদাকে ধাক্কা মেরে পুকুরে ফেলে দিয়েছেন। ফরিদার আব্বা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। অন্যদিকে তাদের গ্রামের লোকজনও ছিল ষন্ডা টাইপের, দাঙ্গাবাজ প্রকৃতির। সবাই ফরিদার আব্বাকে ক্ষেপিয়ে তুললেন। সিদ্ধান্ত হল এ অসভ্য বদ ছেলেটার বিচার করতে হবে।
ওদিকে স্কুলের শিক্ষকমন্ডলী এবং ফোরকানের গ্রামের লোকজন আতংকিত হয়ে গেলেন। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, ফোরকানকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। তাতে যদি ফরিদার আব্বা এবং তার গ্রামের লোক সন্তুষ্ট না হয়, তবে গ্রামের শান্তির জন্য ফোরকানকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে।
সাথে সাথে প্রতিবাদ করলেন ফোরকানের চাচা। তিনি ছিলেন খুবই সাহসী এবং ন্যায়পরায়ন ব্যক্তি। বললেন, ‘কেউ যদি অন্যায় করে থাকে, তবে সবাই মিলে শালিশ-বিচার করা যাবে। তবে আমরা কেউই বিশ্বাস করি না যে ফোরকান এমন কাজ করেছে।’
দুইগ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে বিচারপর্ব শুরু হল। ফরিদার আব্বা, ফোরকানের আব্বাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই অসভ্য ছেলেটা কার? আমার মেয়েকে পুকুরে ফেলে দিয়েছে! তোমাদের গ্রামের ছেলেগুলো তো খুব বদ!’
উভয়পক্ষের লোকজনের মধ্যে উত্তেজিত ভাব। মনে হচ্ছে যে কোন মূহুর্তে যুদ্ধ লেগে যাবে। ঠিক সেই মূহুর্তে ফরিদা এসে উপস্থিত। ফরিদা সবার সামনে সত্য কথাটা তুলে ধরলেন। বললেন, ‘ফোরকানের তো কোন দোষ নেই। আমি পা পিছলে পুকুরে পড়ে যাচ্ছিলাম। ঐসময় ফোরকান আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। দুজনেই পুকুরে পড়ে গিয়েছিলাম।’
একমূহুর্তে উত্তেজনা উধাও হয়ে গেল। ফরিদার আব্বা ফোরকানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার আব্বার নাম কি?’
ফোরকানের আব্বা পাশ থেকে বললেন, ‘সে আমার ছেলে।’
সাথে সাথে ফরিদার আব্বা বলে উঠলেন, ‘বল কি? এতক্ষণ বল নাই কেন? আমি যদি জানতাম, তোমার ছেলে, তাহলে তো বিচার নিয়েই আসতাম না।’
সকলের মুখে হাসি-আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। উভয় গ্রামের লোকেরা প্রস্তাব দিল, তাহলে আপনাদের সম্পর্কটা স্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত করেই নেন। অনেকে ফোরকানকে টিপ্পনী কেটে বলল, ‘যাও শ্বশুরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও। শত্রুও তো বন্ধু হতে পারে।’
খেলোয়াড় ফোরকান
ফোরকান ছোটখাটো হলেও খুব ভাল হা-ডু-ডু খেলতে পারতেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মালু মিয়াও একজন ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। একবার স্কুল ভিত্তিক হা-ডু-ডু প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হল। ফোরকানদের দল প্রতিটি খেলাতেই বিপুল বিক্রমে জয়লাভ করে চলছিল। আর ফোরকানদের দলের মূল শক্তি ছিল ছোটখাটো আকৃতির ফোরকান। ক্ষুদে আকৃতির ফোরকানের তো আর তেমন দৈহিক শক্তি ছিল না। তবে তার কৌশলটি ছিল অসাধারণ! ফোরকানের হাডুডু খেলার কৌশলের কারণেই একে একে পরাস্ত হচ্ছিল বিপক্ষ দলের বাঘা বাঘা খেলোযাড়রা। প্রধান শিক্ষক মালু মিয়াও খেলাগুলো দেখছিলেন। তিনি ফোরকানের খেলা দেখে এতই মুগ্ধ হলেন যে, ফোরকানকে বললেন, ‘এমন খেলা আমি আমার জীবনেও দেখি নাই। ফোরকান, তোমাকে কি দিয়ে যে পুরস্কৃত করব, তাই ভেবে পাচ্ছি না!’
নাট্যকার ফোরকান
ফোরকান একটি নাটিকা লিখে বাংলা স্যারের নিকট জমা দিলেন। যথারীতি আবার বকাঝকা জুটল ফোরকানের কপালে। শুধু বকাঝকা দিয়েই থামলেন না স্যার, ফোরকানকে বেত্রাঘাতও করলেন। বললেন, ‘অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে এসে আমার কাছে জমা দিয়েছো ভন্ড কোথাকার!’ তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে এটি ফোরকানই রচনা করেছে। অনেক পরে যখন তিনি বুঝতে পারলেন এগুলো ফোরকানই লিখেছে, তখন তিনি বেশ লজ্জ্বা পেলেন। ফোরকানকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘ফোরকান, আমি আগে বুঝতে পারিনি যে, এগুলো তুমিই লিখেছো। আমারই ভুল। কারণ পাড়া গাঁয়ে বাস করে কেউ যে সাহিত্য রচনা করার প্রতিভা নিয়ে জন্মাতে পারে, এটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমি নিশ্চিত তোমার প্রতিভা তোমাকে সামনে নিয়ে যাবে। অবশ্যই একদিন তুমি এ বিষয়ে সম্মাননা পাবে।’
শিক্ষকের কথা সত্যি হয়ে গেল। পরবর্তীতে ফোরকান মৌলভীবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃক শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মাননা পেলেন। ফোরকানের উপলব্ধি হল, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও গুরুজনদের প্রতি যারা যত বেশি শ্রদ্ধাশীল তারা তত বেশি সম্মানের অধিকারী হয়।
পিতামাতার মনে কষ্ট দেয়ার আক্ষেপ
শেষ বয়সে এসে ফোরকানের মনে প্রচন্ড আক্ষেপ, তিনি পিতা-মাতাকে অনেক দুঃখ-কষ্ট দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা তার মনে পড়ে যায়। ফোরকানের পিতা নরসিংদী যাবেন। ফোরকানও তাঁর স্বভাবগত ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তিনি যথারীতি পিতার পিছু পিছু রওনা হলেন। দুজনেই লঞ্চঘাটে উপস্থিত হলেন। ঘাটে দুটি লঞ্চ দাঁড়িয়েছিল। ফোরকান লক্ষ্য করেননি তাঁর পিতা কোন লঞ্চে উঠেছেন। তিনি দ্বিধা না করে অন্য একটি লঞ্চে উঠে গেলেন। লঞ্চে উঠে তিনি আর তাঁর পিতাকে খুঁজতে শুরু করলেন। যথাসময়ে ফোরকানের লঞ্চটি ছেড়ে দিল। অন্যদিকে ফোরকানের পিতা যে লঞ্চটিতে উঠেছিলেন সে লঞ্চটিও ছেড়ে দিল। ফোরকান লঞ্চের ভেতরে ঘুরে ঘুরে তার পিতাকে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলেন। কিন্তু কোথাও তার পিতাকে আর খুঁজে পেলেন না।
ফোরকানের লঞ্চ ঢাকা এসে পৌঁছালো। অপরিচিত জায়গা। উপায়ান্তর না দেখে স্বভাবগত কারণে ফোরকান হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। লঞ্চের লোকজন বুঝতে পারলেন ফোরকান সলিমগঞ্জ থেকে উঠেছেন। সবাই মিলে শান্তনা দিলেন। কিন্তু ফোরকানের আর কান্নাকাটি বন্ধ হয় না। নাওয়া-খাওয়া নেই, শুধু কান্না আর কান্না।
ওদিকে ফোরকানের আব্বা নরসিংদী থেকে বাড়িতে ফিরলেন। ফোরকানের জন্য ভাল ভাল খাবার কিনে এনেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোরকান কই?’
ফোরকানের আম্মা বললেন, ‘কেন, ফোরকান না তোমার সাথে গেছে!’
ফোরকানের আব্বা এত কষ্ট করে হাট শেষ করে বাড়িতে ফিরেছেন। একথা শুনে তো তিনি সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। আবার বাড়িতে সবাই মিলে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন।
চারিদিকে খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল। কিন্তু ফোরকানকে আর পাওয়া গেল না। আত্মীয়স্বজন সবার বাড়িতে খোঁজ নেয়া হল। কিন্তু ফোরকান তো কোথাও যাননি। তাহলে গেল কোথায়?
ভাগ্য ভাল। ফোরকান যে লঞ্চে উঠেছিলেন সে লঞ্চে কয়েকজন ভাল যাত্রী ছিলেন। তারা সে লঞ্চটি থেকে ফোরকানকে নামিয়ে একটা বাড়িতে সাময়িক থাকার জন্য ব্যবস্থা করে দিলেন। কারণ সেদিন আর সলিমগঞ্জ যাবার জন্য কোন লঞ্চ ছিল না। পরদিন যে লঞ্চটি সলিমগঞ্জ যাবে, সে লঞ্চে ফোরকানকে তুলে দেয়া হল। লঞ্চটি সলিমগঞ্জ এসে পৌঁছলে যাত্রীরা ফোরকানকে নামিয়ে দিলেন। ফোরকান নিরাপদে বাড়িতে ফিরে এলে আবার আনন্দের জোয়ার বইল।
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ফোরকানউদ্দিন বীরপ্রতিকের উপলব্ধি, ‘আমি মা-বাবাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আল্লাহ যেন তাদেরকে বেহেশত নসীব করেন।’
নৌকাডুবি এবং দোষী ফোরকান
ফোরকান তখন ৯ম শ্রেণিতে পড়েন। একটি গ্রামে লজিং থাকেন। সে বাড়ি থেকে নৌকায় স্কুলে যেতে হয়। ঐদিন হঠাৎ দমকা হাওয়া আসায় নৌকাটি ডুবে যায়। নৌকায় ৩ জন ছাত্রী ছিল। তারা ভাল সাঁতার জানত। সাঁতার কেটে তারা তীরে পৌঁছে যায়। ফোরকান পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেব আরেকটি নৌকায় আসছিলেন। ফোরকানের এ অবস্থা দেখতে পেয়ে তিনি তাঁকে নৌকায় তুলে বাঁচালেন।
ওদিকে খবর রটে গেল, ফোরকানের কারণে নৌকাটি ডুবে গিয়েছিল। কাজেই ফোরকানের বিচারপর্ব শুরু হল। ঐ তিনজন ছাত্রীর মধ্যে একজনের নাম ছিল শানু। তার পিতা গ্রামের সম্মানী ব্যক্তি, মাতব্বর। কাজেই তিনি প্রচন্ড ক্ষিপ্ত। গ্রামের সবাই মাতব্বরের পক্ষে। অন্যদিকে ফোরকানের এ গ্রামে আপনজন বলতে কেউ নেই। তাই ফোরকানের পক্ষেও কেউ নাই। কাজেই ফোরকানকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তিপর্ব শুরু করার আলাপ আলোচনা তখন তুঙ্গে উঠল। ঐ সময়ে আকস্মিকভাবে শানু এসে উপস্থিত হল। সে বললো, ‘ফোরকান নির্দোষ। কারণ হঠাৎ দমকা হাওয়ার কারণে নৌকাটি ডুবে গিয়েছিল।’
শানুর কথায় সকল উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে এল। উপস্থিত সবাই প্রচণ্ড লজ্জ্বিত হলেন। মাতব্বর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার আব্বার নাম কি?’
ফোরকান তাঁর আব্বার নাম বলতেই মাতব্বর সাহেব তো অবাক! ‘বল কি! তুমি থোল্লাকান্দি গ্রামের বড় বাড়ির ছাত্তার সাহেবের ছেলে! তুমি এ গ্রামে কেন এসেছো?’
ফোরকান সবকিছু খুলে বললেন। সবাই লজ্জ্বিত হয়ে বিচারপর্ব শেষ করলেন। ফোরকান প্রচন্ড অভিমান করে বললেন, ‘আমি এ গ্রাম ছেড়ে চলে যাবো।’ সাথে সাথে সবাই তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘আমরা তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। এখন দেখছি তুমি আসলেই একটি ভাল ছেলে। তাই তোমাকে আমরা এ গ্রাম ছেড়ে যেতে দেব না।’
গ্রামটি ছিল খুবই ছোট। বর্ষাকালে দ্বীপের মত হয়ে যায় গ্রামটি। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যেতে নৌকা লাগে। কাজেই এ গ্রামের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যানটিই হচ্ছে নৌকা। সবার অনুরোধে ফোরকানকে আবার সে গ্রামেই থাকতে হল। সবাই মিলে ফোরকানকে একটি নৌকাও কিনে দিলেন।
এখন ফোরকানের বিপদ আরো বেড়ে গেল। কারণ তিনি তো নৌকা বাইতে পারেন না। তবে সবাই মিলে এরও একটি সমাধান বের করে দিলেন। ঐ গ্রামের মেয়েরা নৌকা চালাতে জানে। সিদ্ধান্ত হলো, তারাই ফোরকানের নৌকা চালিয়ে স্কুলে যাবে। তারা ফোরকানকেও সাথে করে নিয়ে যাবে।
ফোরকানের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও সবাই মিলে সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করে ফেললেন। তবে ফোরকানের ভাগ্য ভালো, আর কখনো নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেনি।
মুচকি হাসি
ফোরকান তখন ৮ম শ্রেণিতে পড়েন। বাজারে একটি বিচার অনুষ্ঠান চলছে। কয়েক গ্রামের লোক নিয়ে বিচার চলছে। ফোরকান গেছেন বিচার দেখতে।
বিচারপর্ব শেষ হলে মুরব্বীরা রায় দিলেন দোষী ব্যক্তিটি সবার সামনে মাফ চাইবেন। রায় শোনে লোকটি মুচকি হাসি দিল।
বিষয়টি দেখতে পেয়ে হঠাৎ ফোরকান বলে উঠলেন, ‘বিচার হয়নি।’
ফোরকানের কথা শুনে সবাই চটে গেলেন। ঐ বিচারের অনুষ্ঠানে ফোরকানের চাচাও উপস্থিত ছিলেন। তিনিও ফোরকানের এ ধরণের কথায় প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন। তিনি এতই রেগে গিয়েছিলেন যে, বিচারসভা না হলে ফোরকানের এ ধরণের বেয়াদবীর উপযুক্ত শাস্তিই দিয়ে বসতেন।
একজন বিচারক ফোরকানের চাচাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি তার উপর রাগ করছেন কেন?’
ফোরকানের চাচা বললেন, ‘সে আমার ভাতিজা। বেয়াদবী করেছে। তাই তার উপর রাগ করছি।’
বিচারক ফোরকানের চাচাকে বললেন, ‘একটু থামেন। দেখি তাকে আমি জিজ্ঞেস করি।’
এবার বিচারক ফোরকানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা বাবা, বলতো কেন বিচার হয়নি?’
ফোরকান বললেন, ‘মাফ চাওয়া, মানেই তো সাজা। আর সাজা মানে কান্না। যখন আপনি মাফ চাইতে বললেন, তখন সে হাসছে। কাজেই তার ক্ষেত্রে এ সাজাটা হয়নি।’
সব্ইা হেসে উঠলেন। তবে পাশে থাকা দু-তিনজন স্বাক্ষী দিলেন লোকটি রায় শুনে মুচকি হাসি দিয়েছে।
বিচারক তখন আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা বাবা, বলতো, কি হলে তার উপযুক্ত বিচার হবে?’
ফোরকান বলে উঠলেন, ‘সে যার মাথা ফাটিয়েছে, সেই লোকটি এখন তার মাথা ফাটিয়ে দেবে। তাহলেই সে বুঝতে পারবে, মাথা ফাটলে কি ব্যথা হয়!’
ফোরকানের কথা শুনে উপস্থিত সবাই খুব মজা পেয়ে হাততালি দিয়ে উঠলেন। বিচারকরা হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন!
মন্তব্য করুন