কবি নজরুলের মুখে সিলেটি ভাষা
সায়েক আহমদ॥‘খালি খাউকা, খালি খাউকা, আর কত খাইতাম বা, খাইতে খাইতে নু হেষে পেট ফাটি যাইব।’ এ খাস সিলেটি বাক্যটি বেরিয়েছে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মুখ দিয়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। তখন তো আর কবি জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। সবাই তাকে বিদ্রোহী কবি হিসেবেই চিনত। সেটা ১৯২৮ সালের কথা। কবির বয়স তখন মাত্র ২৮ পেরিয়ে ২৯ ছুঁই ছুঁই করছে। টগবগে তরুণ। বিয়েশাদী করেননি। পিছুটান নেই। সেই টগবগে তরুণ নজরুলের মুখেই কি না সিলেটি ভাষা। ঘটনাটা কী? কলকাতার নজরুল সিলেটে এলেনই বা কেন? আর এসে এত নিখুঁতভাবে সিলেটি ভাষা শিখলেন কীভাবে? কবির রসবোধ নিয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই। যেখানেই যেতেন আড্ডায় আড্ডায় মাতিয়ে রাখতেন সবাইকে। এখানেও কবির রসাত্মক কথা বলার ভঙ্গি একটুও পাল্টায়নি। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মেহমানদারির পাল্লায় পড়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সিলেটবাসীদের মেহমানদারির সাথে আরবেরই তুলনা করা চলে। কাজেই বলা যায় কবি দাওয়াত খেতে খেতে অতিষ্ট হয়ে কৌতুক করেই কথাটি বলেছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমবারের জন্য সিলেট সফরে এসেছিলেন ১৯২৫ সাল। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন সেটা ১৯২৬ সাল। তবে কবি একলিমুর রেজা এবং অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের লেখা হতে জানা যায় সেটা ছিল ১৯২৫ সাল। হয়তো সেটা ১৯২৫ সালের শেষভাগও হতে পারে অথবা ১৯২৬ সালের প্রথমভাগও হতে পারে। এটা নিয়ে বিতর্ক না বাড়িয়ে আমরা বরং চলে যাই নজরুলের সেই সিলেট সফরের সময়ে।
প্রথমবার সিলেটের কংগ্রেস দলের সদস্যরা কবি নজরুলকে সিলেটে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সেই সফরে কবি গুটি বসন্তে আক্রান্ত হওয়ায় একমাস সময় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে কাটাতে হয়েছিল। প্রচণ্ড আড্ডাবাজ এবং দিলখোলা তরুণ নজরুলের জন্য সে সময়টা ছিল দুঃসহ। সুস্থ হয়েই তাকে ফিরে যেতে হয়েছিল কলকাতায়। কাজেই কবির প্রথম সিলেট সফরটা তেমন জমজমাট হয়নি।
প্রথমবার কবিকে সিলেটে এনেছিল কংগ্রেস দলের সদস্যরা। এবার সুযোগটা গ্রহণ করল সুরমা ভ্যালি মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন। তারা সেপ্টেম্বর মাসে সিলেটে সম্মেলনের আয়োজন করে। এ সম্মেলনে দাওয়াত দেয়া হয় শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। তারা দাওয়াত গ্রহণ করেন। তিনজনই একসাথে কলকাতা থেকে আসেন সিলেটে। এ উপলক্ষে নেয়া হয়েছিল ব্যাপক প্রস্তুতি।
সম্মেলন শেষে সিলেটে শুরু হলো দাওয়াতের পালা। মেহমানদারীর জন্য উপমহাদেশে সিলেটের প্রচণ্ড সুখ্যাতি আছে। কাজেই নজরুলকেও মেনে নিতে হয়েছিল সেই মিষ্টিমধুর মেহমানদারী অত্যাচার। নজরুলও তো আড্ডাবাজ এবং আমুদে কবি। দাওয়াত খেতে তো তার কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। একে একে দাওয়াত খেতে লাগলেন। মোহাম্মদ বখত মজুমদার, হাওয়া পাড়ার আব্দুল্লাহ উকিল, আমীনুর রশীদ চৌধুরী সহ অনেকের বাসায় দাওয়াত খাওয়া হয়ে গেল।
যেখানেই দাওয়াত, সেখানেই জমজমাট আড্ডা। সে আড্ডায় কবির গাওয়া গান শুনে এবং বিচিত্র বিষয়ে কথা বলার ঢং দেখে মুগ্ধ সিলেটবাসী। কবি যেন সেই হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা। যেখানে যান, জোঁকের মত লেগে থাকে ভক্তবৃন্দ।
দাওয়াত খেতে খেতে এবার এল ইলু মিয়া পাহলেওয়ানের পালা। তিনি আবার দাওয়াতের আয়োজন করেছেন নয়া সড়কের লাল মিয়া ডাক্তার সাহেবের বাড়িতে। সেখানেও অতিথিদের পদচারণায় সরগরম হয়ে গেছে বাসাটি। প্রত্যেক মেহমানকে দেয়া হয়েছিল ঘিয়ে ভাজা দুটো বড় পরোটা আর একটা করে আস্ত মুরগীর মুসল্লাম। কুফতা, কালিয়া সহ আরো অনেক কিছু আইটেম দিয়ে খাবার টেবিল ভর্তি করে ফেলা হয়েছে। বেচারা নজরুল। কতই বা আর খাবেন। খেতে খেতে পেট ভর্তি হয়ে গেছে। আর তো পারা যায় না। বারবার আর না, আর না বলছেন। এগিয়ে এলেন হোস্ট ইলু মিয়া পাহলেওয়ান। কবির জন্য এত কষ্ট করে এত কিছুর আয়োজন করেছেন। সব আইটেম কবিকে না খাওয়াতে পারলে তো তার জনমই বৃথা হয়ে যাবে। নজরুল আর খেতে পারছেন না দেখে ইলু মিয়া হাত জোড় করে কবিকে বললেন ‘কাজী সাব, আরো বেশ করি খাউকা, হক্কলতা নু রইছে।’ ইলু মিয়ার কথা শুনে কাজী নজরুল ইসলাম রসিকতায় মেতে উঠলেন। কথা বলে উঠলেন খাস সিলেটী ভাষায়। তীক্ষè মেধার অধিকারী নজরুল ইতোমধ্যেই সিলেটী ভাষা আয়ত্ত্ব করে ফেলেছিলেন। কারণ প্রথমবার সিলেট সফরের সময় তাকে এক মাসের বেশি সময় সিলেটে থাকতে হয়েছিল। আর এবারের সফরেও প্রায় একমাস হতে চলেছে। কাজেই সিলেটি ভাষায় নিখুঁতভাবে কথা বলাটা তো নজরুলের জন্য কোন ব্যাপারই নয়। সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে ইলু মিয়ার অনুরোধের উত্তরে কবি বলে উঠলেন, ‘খালি খাউকা, খালি খাউকা, আর কত খাইতাম বা, খাইতে খাইতে নু হেষে পেট ফাটি যাইব।’
কবি নজরুলের মুখে খাস সিলেটি ভাষায় কথা শুনে উপস্থিত ভক্তবৃন্দ চমকে উঠল। তারপর কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে সবাই গলা ফাটিয়ে হাসতে থাকলেন। আর এভাবেই সিলেটবাসীর কাছে অমর হয়ে থাকলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন