যে শোক যাবেনা ভূলা চলে গেলেন ইয়াহিয়া মোজাহিদ

January 14, 2017,

নিলুপ ইসলাম নিলু॥ মাতার কাপন বি,এন,এস চক্ষু হাসপাতালের সাধারণ সম্পাদক আমার ভাতিজা এডভোকেট ইয়াহিয়া মোজাহিদ ছিলেন একজন ক্ষনজন্মা পুরুষ। দীর্ঘদিন তিনি এই হাসপাতালের অবৈতনিক সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই চক্ষু হাসপাতালের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন। আমি প্রায় সময়ই তার সাথে যোগাযোগ রাখতাম। সপ্তাহে দুইদিন ডায়গণসিস করানো হত, কিন্তু অফিসে আসলে তাকে খুবই প্রানবন্ত লাগতো মনে হতো তার কোন রোগ নেই। স্টাফ সহ চিকিৎসক সকলের সাথে হাসিখুশি আলাপে সময় কাটাতেন। আত্বীয়-স্বজন পরিচিতদের ভিড় প্রায়ই লেগে থাকতো। কাউকে চিকিৎসার ব্যাপারে নিরাশ করতেন না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে অনেক রোগীকে পাঠিয়েছি যাদের অবস্থা ভাল ছিলো না। নিজেও অনেক কে নিয়ে এসে অপারেশন করিয়েছি। যা লিখে বুঝাতে পারবো না। আমার একজন ভাগিজার বউ যার এমন অবস্থা ছিলো, সে যে নবীগঞ্জ থেকে মৌলভীবাজার যাওয়া আসার ভাড়া পর্যন্ত ছিলো না। এই অবস্থায় অন্য জনের কাছ থেকে সাহায্য চেয়ে আমি মাতারকাপন নিয়ে এসেছিলাম। খুব সম্ভব আমার ভূলের জন্য অপারেশনের তারিখটা মনে ছিলো না। যার জন্য আর ২ সপ্তাহ তারিখ পিছিয়ে গেল। এরপর ঐ মহিলার চোখ পরীক্ষা নিরিক্ষা করার পর দেখা গেল কি একটা কারণে বাম চোখে মেজর অপারেশন লাগবে। যার ব্যয় হবে ২০/২৫ হাজার টাকা । টাকার ব্যাপারে কি করা চিন্তায় পড়ে গেলাম। ইয়াহিয়া মোজাহিদ আমাকে বললেন চাচী চিন্তা করিওনা । সব ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি। কোন টাকা লাগবেনা, তুমি চিন্তা করিওনা । সাথে সাথে রোগীকে ভর্তি করলাম। ডাক্তাররা বলেছিলো পরের দিন অপারেশন করবে, তাদের অপারেশন থিয়েটারের বেসিন না কি ঠিক ছিলো না কিন্তু ইয়াহিয়া মোজাহিদ বললেন, আমার চাচী খুবই ব্যস্থ মানুষ তিনি কয়দিন আসবেন ? আপনার অপারেশন করতেই হবে। । আমি গর্বিত সেই নারী, যে আমার জন্য ঐদিন আরও ১০ জন রোগীর চক্ষু অপারেশন হলো। কি বলবো আজ। দুচোখে জল টপ টপ করে ঝরছে। ইয়াহিয়া মোজাহিদের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর সাথে সাথে আমি মৌলভী বাজার চলে আসি। আমার সাথে তার অজস্র স্মৃতি জড়িত, যা আমাকে সব সময় কষ্ট দিবে। অন্য একদিন আমার ছেলের বউ কে নিয়ে এসেছিলাম চোখ দেখাতে । মধ্যহৃ সময় এই ভেবে অফিসে প্রায় ৩০/৪০ জন লোকের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। আমি খাব না বলেছিলাম, আমাকে বললেন চাচী এই হাসপাতাল শুধু আমার নয় তোমারও, কাজেই ছোট ভাইর বউকে না খাইয়ে নিলে আমি নিজে ছোট হয়ে যাব। এক সময় নিশিকান্ত নামের একটি গায়ক ছেলেকে আনলেন, নিশিকান্ত নাকি চোখে দেখতো না। এই হাসপাতালে তাকে রেখে তাকে বিনা টাকায় চোখের অপারেশন করালেন ঐ ছেলেচির দৃষ্টি শক্তি ফিরে পায়। মাঝে মাঝে চক্ষু হাসপাতালে এসে হাতে ঢোল বাজিয়ে গান করে। নিশিকান্ত ইয়াহিয়া মোজাহিদ কে বাবা বলে ডাকতো। সে গণ জাগরণ মঞ্চে গান গেয়ে মানুষকে অনুপ্রানিত করেছে। ইয়াহিয়া মোজাহিদ একদিন বললেন, আমার চাচীকে নিয়ে একটি গান গাও । সাথে সাথে আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার নামে একটি গান রচনা করে উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। ইয়াহিয় মোজাহিদ আমার হাতে ২০০ শত টাকা লুকিয়ে দিয়ে বললেন নিশিকান্ত কে পুরস্কার হিসেবে আমার পক্ষ থেকে তাকে দিয়ে দাও, এই স্মৃতি আমি কখনও ভুলে যাব না। ইয়াহিয়া মোজাহিদ মৌলভীবাজার পৌরসভার তিন বারের কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। লায়ন্স ক্লাব, রোটারী ক্লাব সহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মে জড়িত ছিলেন। গ্রামের বাড়ী নবীগঞ্জের দীঘলবাকে । জগন্নাথপুর, সিলেট, বালাগঞ্জ ওসমানীনগর, নবীগঞ্জ যেখানেই চক্ষু ক্যাম্পইন হতো সব জায়গাতেই আমাকে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রন জানাতেন। বিভিন্ন চ্যানেলে বিশেষ করে ইউরোপের চ্যানেল গুলিতে বেশ কয়েকটি আমি তার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আমি মাতার কাপন আসলেই খুশিতে আত্বহারা হয়ে যেতেন। চাচী কি খাবেন, কি করতে পারি ? ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ সবই স্মৃতি হয়ে গেল। আজ থেকে মনে হলো মাতার কাপন বি এন, এস চক্ষু হাসপাতালের দরজা আমার জন্য বন্দ হয়ে গেল। আমার আপন বলতে কিছুই রইলো না। সব মৃত্যু সহ্য করা যায় না। আমি কেমন করে এই শোক সহ্য করবো জানিনা । সব কিছু আপন গতিতে চলবে দিন যাবে রাত আসবে প্রকৃতির নিয়মে সব চলবে । কিন্তু যে চলে যায় সে আর আসবে না। তার শুণ্যস্থান আর পূরণ হবে না। ইয়াহিয়া মোজাহিদ মৌলভীবাজার থাকলেও গ্রামের যে কোন জন আসলে প্রথমেই গ্রামের সকলের খোঁজ খবর নিতেন। যে আসবে তাকে যথা সম্ভব আদর যতœ করবেন।
বছর ৯ই জানুয়ারী দীঘলবাক উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭০ বছর ফুর্তি উপলক্ষে এসেছিলেন। দীঘলবাক উচ্চ বিদ্যালয়ের গেইট থেকে নিয়ে আমি মঞ্চে উটাই, এই অনুষ্টানে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন। আমার সাথে তার শেষ দেখা হয়েছিল গত বৎসর আগষ্ট অথবা সেপ্টেম্বর মাসে। দীঘলবাক গিয়েছিলেন এজনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে । গাড়ী থেকে ফোন দিলেন, চাচী আমি এসেছি। আমার স্কুল থেকে ৮/১০ গজ দুরে গাড়ী দেখে তাকে আমি হাত ধরে আমার স্কুলে নিয়ে আসি। বেশ কিছু সময় আলাপ করি। স্কুলের খোঁজ খবর নিলেন। এই ছিলো তার সাথে আমার শেষ দেখা। পরে ফোনে অবশ্য প্রায়ই যোগাযোগ রাখতাম। আজ আমি কি বলবো ? অজস্র স্মৃতি আমার রয়েছে। আমাকে বলেছিলেন চাচী ১ সপ্তাহ প্রায় ১ লাখ টাকা আমার ডায়গণসিস করতে ব্যয় হয়। আর কি পরিমান যে আমার কষ্ট হয় তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এ বেঁচে থাকা আমার জন্য বড় কষ্ট হয় চাচী । আমি শান্তনা দিয়ে বললাম তোমার মত মানুষের ১দিন বেঁচে থাকা ও বাবা বিশাল পাওয়া । চলে গেলেন ইয়াহিয়া মোজাহিদ আমি তার স্মৃতি কখনও ভুলতে পারবো না।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com