রক্তে রাঙ্গা পুজিঁর গোলাপ ও ১৪ ফেব্রুয়ারী
মুনজের আহমদ চৌধুরী॥ শফিক রেহমানের হাত ধরে আমদানি করা হুজুগে আমার আত্বভোলা আমরা আজ মাতোয়ারা। দিবসকে পন্য বানিয়ে বানিজ্য অবশ্য বিশ্বময় বাস্তবতা। পুজিঁর প্রনোদনা এখন ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে গোল্ডফিশ মেমরির জনগণের উদযাপনের দিন হিসেবে অধিষ্টিত করে ফেলেছে। উপলব্ধির কোন ঠাইঁ নেই উপভোগের উদ্যাম আর উদ্ধত বাস্তবতায়।
ইতিহাস ঢেকে দেয়া অপ তৎপরতার ধারায় আমরা আজ ভুলে গেছি,প্রকারান্তরে অস্বীকার করি পুর্বসূরীদের। দুঃশাষন আর অন্যায়ের প্রতিবাদে যারাঁ বুকের রক্তের লিখে গেছেন অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির সপ্নে
বাংলাদেশের নাম;তাদেঁর ভুলে গেছি আমরা।
স্বৈরতান্ত্রিক এরশাদ সরকারের প্রবর্তিত গণবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের প্রতিরোধ আর তাদের অনেকের আত্মদানের ঘটনা, আজ বিস্মৃত অতীত। আমরা ভুলে গেছি ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩। ভুলে গেছি শিশু দীপালি সাহা,বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসা জয়নাল সহ নাম জানা আর না জানা অনেকের বিক্ষত লাশ,আর রক্তাক্ত ইতিহাস।
সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৪ ফেব্রুয়ারী সকাল ১১টার দিকে কলাভবনের সামনে ২০-২৫ হাজার শিক্ষার্থীর সমাবেশ হয়। এরপর ছাত্ররা মিছিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিকে যান। হাইকোর্টের গেটে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন শিক্ষার্থীরা। জয়নাল গুলিবিদ্ধ হন, পরে তাঁকে বেয়েনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে পুলিশ। শিশু একাডেমীতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা শিশু দিপালী সাহা মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলে পুলিশ দীপালির লাশ গুম করে ফেলে। শিশু একাডেমির ভিতরে ছাত্র, শিশু ও অভিভাবকদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন,মেলে শুধু লাশ।সব লাশ গুম করে ফেলে স্বৈরাচারী সরকার। শিক্ষক,ছাত্র কেউ সেদিন উর্দি পরা বাহিনীর নির্যাতন থেকে রক্ষা পাননি। হলে ঢুকে ছাত্রদের উপর চলে নির্যাতন। নিপীড়ন চলে মধুর ক্যান্টিন সহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। রাতে কথিত সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে ছাত্রদের তুলে নিয়ে যায় সেনাবাহিনী।
১৫ই ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ কলেজের মোড়ে গুলি চালিয়ে দুই তরুণকে হত্যা করা হয় সদরঘাটে এক শিশুকে বেয়েনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলা হয়, পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের দুই ছাত্রকে ছাদ থেকে ফেলে মারা হয়।
চট্টগ্রামে নিহত হন মোজাম্মেলসহ আরো কয়েকজন। ঢাকা শহরে সারা রাত কারফিউ আরোপ করা হয়। ২৭ তারিখ পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
অসংখ্য প্রাণের আত্বত্যাগে আন্দোলনটি প্রজন্মের রক্তের দামে সফল হয়। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রদের তিনটি মৌলিক দাবীর সংগ্রামে মজিদ খানের শিক্ষানীতি স্থগিত হয় । ছাত্রবন্দিদের মুক্তি মেলে কারাগার থেকে। ১৭ই ফেব্রুয়ারি ছেড়ে দেওয়া হয় এক হাজার ২১ জনকে। ১৮ই ফেব্রুয়ারি মজিদখান শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এরশাদের সামরিকতন্ত্রের অবসান না হলেও ঘরোয়া রাজনীতির অধিকার দিতে বাধ্য হয় এরশাদ, আন্দোলনের সামনে সামরিক স্বৈরাচার মাথা নত করে।
তারপর থেকেই ১৪ই ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। অন্তত ছাত্রসংগঠনগুলো দিনটি পালন করতো।এত বড় একটা ঘটনা আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানতেই দেওয়া হয়নি। উল্টো ইতিহাসকে মুছে দেয়া আর অস্বীকার করার ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে পন্য বেচার বানিজ্যিকায়নের আরো একটি দিবস। ভালবাসা কেবল কেবল বছরের একটি দিনের। দিপালী,জয়নালের আত্বত্যাগ ভোলা এ কেমন বেহায়া ভালবাসা।
১৪ই ফেব্রুয়ারির দিনে আমাদের গণমাধ্যমগুলো রোমান্টিসিজমের উচ্চতর পাঠ দেয় নতুন প্রজন্মকে। হোটেলগুলো দেয় ফুর্তিময় রাতযাপনের প্যাকেজ।কারন তা পাবলিকে খায়। দায় এড়িয়ে যায় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ,এড়িয়ে যান ৯০ এর ছাত্রআন্দোলনের পথ বেয়ে আজকের বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিজীবিরা।
দিবস কেন্দ্রীক ভালবাসাবাসির বিরোধীতা নয়,কিন্তু রক্তাক্ত আত্বত্যাগের ইতিহাস বিস্মৃতি, এ কেমন প্রেম,ভালবাসা। ইতিহাসকে পরিহাস করার এ দায় আমাদেরই।
এদেশের শ্রেষ্ঠতম অর্জনগুলো গোলাপ ফুল বিনিময়ে আসে নি,আসেনি ভালবাসাবাসির নামে দিবস কেন্দ্রীক ভোগবাদে।
স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য,প্রজন্মের চেতনা বিনির্মানে স্বকীয়তাময় সংস্কৃতি নির্মানের দায় আমাদেরই।
লেখকঃ যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক
মন্তব্য করুন