রণসঙ্গীত :কবি নজরুল ও জেনারেল ওসমানী
সায়েক আহমদ॥ আমরা জানি বাংলাদেশের রণসঙ্গীত রচনা করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থের ‘নতুনের গান’ কবিতার প্রথম দুই স্তবকই হচ্ছে বাংলাদেশের রণসঙ্গীত। বাংলাদেশের যে কোনো সামরিক অনুষ্ঠানে কিংবা জাতীয় পর্যায়ের কোন উৎসব বা অনুষ্ঠানে এই কবিতার প্রথম ২১ লাইন যন্ত্রসঙ্গীতে বাজানো হয়। বাজানো হয় রণসঙ্গীত হিসেবে। কিন্তু এই কবিতার দুটি স্তবক কীভাবে রণসঙ্গীত হিসেবে চূড়ান্ত হল ? কেই বা এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন? কত সালে? বাংলাদেশের জন্মের আগে নাকি পরে?
উইকিপিডিয়া হতে জানা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত এবং সুরারোপিত সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থের ‘নতুনের গান’ কবিতা হতে চয়নকৃত অংশের একটি গান। দাদরা তালের এই সঙ্গীতটি ১৯৭২ সালের ১৩ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের তৎকালীন মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশের রণ-সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচন করা হয়। এই গানটি ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার করা জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিশটি বাংলা গানের মধ্যে ১৮তম স্থান অধিকার করে।
কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। তৎকালীন সময়ে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবেই উল্লেখ করা হত। জেনারেল এমএজি ওসমানীই পাকিস্তান আমলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মার্চ সঙ্গীত হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় ‘নতুনের গান’ কবিতার প্রথম দুই স্তবককে অনুমোদন করিয়েছিলেন।
আরেকটি সূত্র হতে জানা যায়, ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়রি মাসের প্রথম সপ্তাহে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমাজের ২য় বার্ষিক সম্মেলনের উদ্দেশ্যে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় সৈয়দ আবুল হোসেনের বাসভবনে অবস্থানকালে তিনি এই গানটি রচনা করেন। গানটি “নতুনের গান” শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয় শিখা পত্রিকায়। পরে এটি সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী এবং অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের স্মৃতিচারণ হতে জানা যায়, ১৯২৮ সালে নজরুল দ্বিতীয়বার সিলেট সফরে আসার পথে কবিতাটি রচনা করেছিলেন। এবার আমরা সেই ‘নতুনের গান’ কবিতাটি পাঠ করি।
নতুনের গান
চল চল চল!
ঊর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণি তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল
চল চল চল।
ঊষার দুয়ারে হানি’ আঘাত
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,
আমরা টুটাব তিমির রাত,
বাধার বিন্ধ্যাচল।
নব নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব মহাশ্মশান,
আমরা দানিব নতুন প্রাণ
বাহুতে নবীন বল!
চল রে নও-জোয়ান,
শোন রে পাতিয়া কান
মৃত্যু-তোরণ-দুয়ারে দুয়ারে
জীবনের আহবান।
ভাঙ রে ভাঙ আগল,
চল রে চল রে চল
চল চল চল।।
কোরাসঃ
ঊর্ধ্ব আদেশ হানিছে বাজ,
শহীদী-ঈদের সেনারা সাজ,
দিকে দিকে চলে কুচ-কাওয়াজ
খোল রে নিদ-মহল!
কবে সে খেয়ালী বাদশাহী,
সেই সে অতীতে আজো চাহি’
যাস মুসাফির গান গাহি’
ফেলিস অশ্রুজল।
যাক রে তখত-তাউস
জাগ রে জাগ বেহুঁশ।
ডুবিল রে দেখ কত পারস্য
কত রোম গ্রিক রুশ,
জাগিল তা’রা সকল,
জেগে ওঠ হীনবল!
আমরা গড়িব নতুন করিয়া
ধুলায় তাজমহল!
চল্ চল্ চল্।।
পাকিস্তান আমলে এই কবিতাটি যখন স্কুলে পড়ানো হতো, তখন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সরকারি স্কুল পাঠ্যপুস্তকে ‘মহাশ্মশান’- এর পরিবর্তে ‘গোরস্থান’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল।
জেনারেল ওসমানী মাত্র ২৩ বছর বয়সে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সর্বকনিষ্ট মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৪২ সালে তিনিই ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি তার প্রমোশনের ব্যাপারে বিরাট টালবাহানা শুরু করে। ওসমানীর অনেক জুনিয়রকে প্রমোশন দিয়ে ওসমানীকে তারা বিরাট অপমান করে। দুর্দান্ত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ওসমানীকে যেখানে আলাদা করে মূল্যায়ন করা হত, সেখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে তাঁকে মারাত্মকভাবে অবমূল্যায়ন করা হত। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুষ্টিমেয় বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের কাছে তিনি ছিলেন দেবতুল্য। তাকে তখনকার সময়ই ‘পাপা টাইগার’ নামে অভিহিত করা হত।
জেনারেল ওসমানী ছিলেন আজীবন গণতন্ত্রী, ধার্মিক ও খাঁটি দেশপ্রেমিক। মূলত তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টর সৈন্যদের বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে এবং মনোবল বাড়ানোর জন্য একটি উদ্দীপক সঙ্গীত নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি এটাকে তো কোনভাবেই মেনে নেবে না। এ কারণে তিনি তার নিয়ন্ত্রণে থাকা শুধুমাত্র তার রেজিমেন্টের জন্যই এ কবিতাটিকে রণসঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি কর্মকর্তাদের ওপর জেনারেল ওসমানীর ছিল একচ্ছত্র প্রভাব। এ কারণে রণসঙ্গীতটিও অতি দ্রুত সবাই গ্রহণ করেছিলেন। পরে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণে এই রণসঙ্গীতটি ব্যবহার করেছিলেন। ওসমানীর এ সিদ্ধান্ত বাঙ্গালী সৈনিক এবং কর্মকর্তাদের উপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধেও এ রণসঙ্গীতটি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল দৃঢ়ভাবে বৃদ্ধি করেছিল। এ কারণে দাদরা তালের এই সঙ্গীতটি ১৯৭২ সালের ১৩ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের তৎকালীন মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই বাংলাদেশের রণ-সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সিলেট সফর ছিল সবদিক দিয়েই একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করতে গেলেও নজরুলের এ সিলেট সফরটিকে অবশ্যই সামনে নিয়ে আসতে হবে। এ সফরে সিলেটবাসী গোঁড়ামি ও কুসংস্কারকে ঘৃনাভরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। মুসলিম নারীগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পুরুষের পাশাপাশি নজরুলের অনুষ্ঠানে যোগদান করে বাংলাদেশের নারী স্বাধীনতায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। সিলেটবাসীরা ধর্মীয় গোঁড়ামিকে পাশ কাটিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটিয়েছিল এবং রাজনীতিসচেতন হয়েছিলেন। সর্বোপরি জেনারেল ওসমানীর মনেও নজরুলের প্রভাব বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট। এ কারণেই নজরুলের গানটিকে রণসঙ্গীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ওসমানীর ভূমিকা ছিল চিরস্মরণীয়।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন