রমজানের ফজিলত ও রোজার মাসায়িল
এহসান বিন মুজাহির॥ মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআন কারিমে ইরশাদ করেন-‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছিল, যাতে করে তোমরা মুত্তাকি হতে পার’।
(সুরা বাকারা-১৮(
হাদস কুদসিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-‘আসসাওমু-লী ওয়া আনা আজযী” অর্থাৎ রোযা আমার জন্য এবং আমি তার প্রতিদান দেব।
হযরত সালমান ফারসী (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেছেন মহানবী (সা:) শাবান মাসের শেষ দিন আমাদেরকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন, “হে লোক সকল! তোমরা মনযোগ দিয়ে শোনে রাখ, তোমাদের সামনে এমন একটি মাস সমাগত। যে মাস মহা পবিত্র, রহমত-বরকত ও নাজাতে ভরপুর। এই মাসের রোযাকে আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের উপর ফরয করেছেন। যে লোক এই মাসে আল্লাহর সন্তোষ ও তার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে রোযা রাখবে আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিবেন। (-বুখারী শরীফ)
যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করবে সে সত্তর টি ফরযের সওয়াব পাবে, আর যে ব্যক্তি একটি সুন্নাত আদায় করবে সে একটি ফরযের সওয়াব পাবে, আর যে একটি নফল আদায় করবে সে একটি সুন্নাতের সওয়াব পাবে। এই মাসে আল্লাাহ তা’য়ালা পূণ্যকে বর্ধিত করতে থাকেন। এই মাসে যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে আল্লাহ তা’য়ালা তার গুনাহ মাফ করে দিবেন, আর সে ব্যক্তিকে রোযাদারের সওয়াব দিবেন। কিন্তু সে জন্য প্রকৃত রোযাদারের সওয়াবের মধ্যে কোন কমতি করা হবে না। (বুখারী শরিফ)
মহনবী সা:) ইরশাদ করেন, “আসসাওমু জুন্নাতুন মিনাননার” অর্থাৎ রোযা প্রকৃত ঈমানদারের জন্য ঢাল সরূপ। (-মিশকাত শরীফ)। মহানবী (সা:) ইরশাদ করেন, “রমজান মাসের প্রথম রাত উপনীত হলেই মহান আল্লাহ তা’য়ালা শয়তানও দুষ্ট জ্বিনগুলোকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন এবং জান্নাতের দরজা খুলে দেন। (- তিরমিযি শরীফ)
হযরত সাহল (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা:) ইরশাদ করেন কিয়ামতের দিন রোযাদারদের জন্য বেহেশতের একটি দরজা “রাইহান” যা দিয়ে তাদেরকে সর্ব প্রথম প্রবেশ করতে দেওযা হবে। রোযাদার ছাড়া আর কেউ উক্ত দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।( -তিরমিযি
হযরত আবু হুরায়রা (রা:) হইতে বর্ণিত নবী করিম (সা:) ইরশাদ করেন, “রোযাদারের মুখের দূর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশকে আম্বরের সুগন্ধের চেয়েও অনেক উৎকৃষ্ঠ”। (-বুখারী শরীফ
রোজার মাসায়িল:
রোযার সংজ্ঞা: সুবহে ছাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইবাদতের নিয়তে যাবতীয় পানাহার ও স্ত্রী সহবাস হতে বিরত থাকার নামই রোযা। প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক, জ্ঞান সম্পূন্ন মুসলমান নর-নারীর উপর রমজানের রোযা ফরজ। তবে মহিলাদের ঋতুস্রাব (মাসিক) ও নেফাস গ্রস্থ থাকা কালীন সময়ে মহিলাদের জন্য রোযা রাখা ফরয নয়। তবে পরবর্তী সময়ে রোযার কাযা আদায করতে হবে।
রোযার নিয়ত: রমজানের রোযার জন্য পৃথক ভাবে নিয়ত করা জররি। রোযার নিয়ত রাত্রেই করে নেয়া ভাল। সূর্য ঢলার দেড় ঘন্টা পর্যন্ত রমজানের রোযার নিয়ত করা যেতে পারে। নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা জরুরি নয়। কেবল মনের ইচ্ছা তথা রোযা রাখার সংকল্প করাকেই নিয়ত বলে গণ্য হবে।
সাহরী: সাহরী খাওয়া সুন্নাত। অনেকেই অলসতা করে সাহরী না খেযে রোযা রেখে ফেলে, এটা ঠিক নয়। সাহরী খাওয়ার মধ্যে অনেক বরকত ও সওয়াব রয়েছে। রাতের শেষ ভাগে সাহরী খাওয়া উত্তম, তবে এর আগে খেয়ে নিলে কোন অসুবিধা নেই।
ইফতার: সূর্য অস্তমিত হয়ে যাওয়ার পর ইফতার করা উত্তম। অনেকে ইফতারের সময় হওয়ার পরেও ইফতার করতে বিলম্ব করে। সময় হওয়ার পর বিলম্ব করে ইফতার করা মাকরুহ্। আবার অনেকেই ইফতার না করে আগে নামায পড়ে তার পর ইফতার করে এটাও মাকরুহ্, বরং আগে ইফতার তার পরে নামায পড়াা উত্তম। সম্ভব হলে খেজুর দ্বারা ইফতার করা।
তারাবীহ: রমজান মাসে তারাবীর নামায বিশ রাকাত পড়া প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুন্নতে মুআক্কাদা। অনেকে রোযা রাখে ঠিক কিন্তু তারাবীর নামায পড়তে অলসতা করে। পুরষদের জন্য মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে তারাবীর নামায পড় ওয়াজিব।
তিনটি কাজে রোজা ভঙ্গ হয়না: হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স:) বলেছেন তিনটি কাজে রোজা ভাঙ্গে না। (১) শিঙ্গা লাগান (২) বমি হওয়া (৩) স্বপ্নদোষ হওয়া। (তিরমিজী, আবু দাউদও বাইহাকী) কোন ব্যক্তি সফরে থাকলে (মুসাফির) সে পরবর্তী সময় রোজা কাজা করে দিবে। সফরকালীন সময় রোজা রাখা তার জন্য বাধ্যতামুলক নয়। (বাকার:১৮৫) দিনের বেলায় কোন কাফের যদি ইসলাম গ্রহন করে কোন বালক-বালিকা যদি বালেগ হয়ে যায় এবং কোন পাগল যদি ভাল হয়ে যায় তাহালে তারা রোজার হুকুমের আওতায় এসে যাবে এবং সুর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত তাদেরকে পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে পূবেরর্ রোজাগুলোর কাজা করা তাদের জন্য বাধ্যতামুলক নয়। যেহেতু আগেরগুলোতে তাদের উপর রোজা ওয়াজিব ছিলনা। (ফতোয়ায়ে আরকানুল ইসলাম) রোজা ভাঙ্গার কারণ: ১) রোজা রেখে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাস করা ২) কোন ধরনের খাবার গ্রহন করা ৩) উত্তেজনার সাথে বীর্যপাত করা ৪) খাদ্যের অন্তর্ভূক্ত এমন কিছু গ্রহন করা। যেমন সেলাইন ইত্যাদি। ৫) ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা ৬) শিঙ্গা লাগিয়ে রক্ত বের করা ৭) হায়েজ বা নেফাছের রক্ত প্রবাহিত হওয়া (ফতোয়ায়ে আরকানুল ইসলাম ৮) ইচ্ছকৃত মুখ ভরে ভুমি করা। ৯) সহবাস ছাড়া অন্য কোন পন্থায় বির্যপাত ঘটানো । ১০) ধুমপান করা রাত আছে মনে করে সুবহে ছাদিকের পর পানাহার করা। ১১) ভুলবশত পানাহার করে রোযা ভেঙ্গে গেছে মনে করে ইচ্ছা করে পানাহার করা।
যেসব কারণে কাযা ও কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব: রোযা রাখা স্মরণ অবস্থায় কোন পানাহার বা স্ত্রী সাথে সহবাস করা। তা হলে এমতাবস্থায় কাযা ও কাফফারাহ উভয়ট ওয়জিব। যে সকল কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না: মিসওয়াক করা। চোখে সুরমা লাগানো ্ স্বপ্নদোষ হওয়া। দাত হতে রক্ত বাহির হওয়া। জুনবী তথা নাপাক অবস্থায় সেহরী খাওযা। চোখে ওষুধ লাগানো। ভুলবশত পানাহার করা। অনিচ্ছাকৃতভারেব অল্প ভুমি হওয়া।
যেসব কারণে রোযা মাকরুহ: মুখে থুথু জমা করে গিলে ফেলা। টুথপেষ্ট দিযে দাত ব্রাশ করা। কয়লা মাজন দ্রব্য দিয়েদাত মাজা । নাপাক অবস্থায় গোসল ছাড়া সারাদিন থাকা। স্ত্রীর সাথে হাসি টাট্টা করা যাতে সহবাস বা বির্যনির্গত হওয়ার আশংকা হয়। রোযা রাখা অবস্থায় গোনাহের কাজ করা ্ অযথা কোন জিনিস চিবানো। গিবত করা। চুগলখোরী করা। অশ্লীল কথাবার্তা বলা। সিঙ্গা লাগানো।
এতেকাফ: রমজানের শেষ দশকে মহল্লার জামে মসজিদে এ’তেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। যে ব্যক্তি এখলাছের সাথে এ’তেকাফ করবে তার পিছনের সমস্ত গোনাহ আল্লাহ মা করে দিবেন। এ’তেকাফরত অবস্থায় প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না। প্রয়োজনে প্রশ্রাব পায়খানা, জানাবতের গোসল ও জরুরত পরিমাণ বের হতে পারবে।
শবে কদর: রমজানের ২১,২৩,২৫,২৭ ও ২৯ তথা শেষ দশকের বেজোর যে কোন রাত সমূহে শ’বে কদর তালাশ করা। বেজোড় যে কোন রাত শ’বে কদর হতে পারে। শবে কদরের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আল্লাহ তা’য়ালা এ রাত্রিকে ‘ভাগ্য নির্ধারণী’ রাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ সম্পর্কে সুরায়ে ‘কাদর’ নামে একটি সুরা নাযিল করেছেন। হাজার রাতের ইবাদতের চেয়ে উত্তম বলে এ রাত্রিকে আখ্যায়িত করেছেন। এ রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিব্রীল আ.) তাদের পালনকর্তার আদেশক্রমে প্রত্যেক কল্যাণময় বস্তু নিয়ে পৃথিবীতে অবতরন করেন। যে রাত পুরোটাই শান্তি যা ফজর হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।-সূরা কদর (সূরা কাদর: ৩-৫)
শেষ কথা, রমজান মাসের প্রতিটি মুহুর্তই ঈমানদার মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। তাই মুমিনের উচিত মহিমান্বিত রমজান মাসকে যথায ইবাদত-আমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করা।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
মন্তব্য করুন