রমজান, বাজারে বাড়তি চাহিদা : লেবুর ‘রাজ্যেই’ প্রতি হালি ১২০
বিশেষ প্রতিনিধি॥ লেবুর রাজ্য হিসেবে পরিচিত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় লেবুর দাম আকাশছোঁয়া। রমজান, বাজারে বাড়তি চাহিদা ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সপ্তাহখানেক ধরে চলছে এ অবস্থা।
মহিউদ্দিন বলেন বলেন, ‘এখানে তো প্রক্রিয়াজাত করে রাখার ব্যবস্থা নাই, যদি সেই ব্যবস্থা থাকতো তাহলে দাম থাকতো না। আমরা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা অবগত করেছি। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে এখানে প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
পাইকারি বাজারে লেবুর হালি ৪০-৬০ টাকা থাকলেও খুচরা বাজারে তা ১০০-১২০ টাকা ছুঁয়েছে। বাজারে পর্যাপ্ত লেবু থাকার পরও চড়া দামে তা বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
কমলগঞ্জে রয়েছে শতাধিক লেবুর আড়ত। এলাকায় প্রতি দিন লাখ লাখ টাকার লেবু পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গলেও একই চিত্র। কয়েকটি আড়ত ও দোকান ঘুরে পাওয়া গেছে দাম নিয়ে অস্বস্তির খবর।
আড়তদাররা বলেছেন, গত ৯ মাস লেবুর তেমন চাহিদা ছিল না। কৃষকদের খেতের মধ্যেই লেবু পড়ে ছিল। শ্রমিকদের টাকা দেয়া তাদের জন্য কষ্টকর হয়েছে। ১-২ মাস লেবুর চাহিদা থাকে, তখন দামও একটু থাকে। তা ছাড়া রমজান মাস থাকার কারণে লেবুর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম বেড়েছে। অথচ এ লেবুর হালি কিছুদিন আগেও বিক্রি হয় ১০-১৫ টাকায়।
সরেজমিন কমলগঞ্জের ভানুগাছ বাজার, আদমপুর বাজার ও শমসেরনগর বাজার ও শ্রীমঙ্গলের পুরান ও নতুন বাজারে দেখা যায়, প্রতিটি লেবু পিস বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা। হালি বিক্রি হচ্ছে ঠিক ১১০-১২০ টাকায়। তবে ছোট লেবুর দাম কিছুটা কম।
বাজারে লেবু কিনতে আসা ডলি বেগম বলেন, ‘আমার পরিবারের সবসময় লেবুর দরকার হয়। তা ছাড়া রমজান মাস। ইফতারের সময় লেবুর শরবত করে আমরা সবাই খাই। এখন ভানুগাছ বাজারে আসলাম লেবু নেয়ার জন্য। কিন্তু যে লেবু নিয়েছিলাম দুই দিন আগে ১৫-২০ টাকা করে হালি। এখন সেই লেবু কিনতে বাজারে এসে দেখি ১০০ টাকা। অবাক লাগে কী করে এমন দাম হঠাৎ করে বাড়ল। কিন্তু আমার লেবুর প্রয়োজন থাকায় লেবু এত দামে নিতে বাধ্য হচ্ছি।’
শ্রীমঙ্গলের মা বাণিজ্যালয়ের আড়তদার রাজিব আহমদ বলেন, ‘লেবু তিন ধরনের রয়েছে। বড়, ছোট ও মাঝারি। আমরা প্রতিটা পিস লেবু ৮ টাকা থেকে ১৫ টাকা করে পাইকারি বিক্রি করছি। কিছুদিন ধরেই লেবুর বাজার চড়া। যার কারণ হলো, ৯ মাস লেবুর চাহিদা থাকে না। এই ২-১ মাস লেবুর চাহিদা থাকে। যার কারণে লেবুর এই দাম। এবার লেবুর ফলন ভালো হলেও সঠিক সময়ে কৃষক লাভ করতে পারেনি। ৯ মাস লেবুর চাহিদা থাকে না। ফলে কৃষকরা ক্ষতির মধ্যে থাকে। এখন সরবরাহও কম। তাই দাম চড়া। এখানে বিক্রেতাদের কিছু করার নেই। চাহিদা আর সরবরাহের কথা বিবেচনায় দামের এই চড়া ভাব আরও বেশ কিছুদিন থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার লেবু দাম দিয়ে রাখি। কিছু টাকা হাতে রেখে বিক্রি করে ফেলি। কিন্তু প্রশাসন আমাদের মাঝে মাঝে এসে জরিমানা করে। এতে যেমন আমাদের ক্ষতি হয় তেমন ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতেও মন চায়।’
ভানুগাছ বাজারের লেবু বিক্রেতা আলীম মিয়া বলেন, ‘আমরা পাইকারি বাজার থেকে হালি ৮০-১২০ টাকায় কিনে আনি। অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে তাই ১০০-১৫০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিক্রিও কমেছে সমান হারে। রমজানের জন্য লেবুর শরবতে উপকারিতা থাকায় লেবুর চাহিদা প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাজারে লেবুর দাম বেড়েছে।’
শ্রীমঙ্গলের প্রবীণ লেবু চাষি ছামছুল হক বলেন, ‘আমি ২০-২৫ বছর ধরে লেবুর চাষ করি। এ বছর লেবুর চাষ করেছি ১৫ একর জমিতে। যার জন্য প্রায় খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকার মতো। এই পর্যন্ত বাজারে বিক্রি করেছি ৩-৪ লাখ টাকার মতো। জমিতে কিছু লেবু আছে। যা বিক্রি করলেও আমার মূল টাকা বেরিয়ে আসবে না। ১০ মাস লেবুর দাম পাইনি। বাজার নিয়ে আসলেও কেউ জিজ্ঞাসটাকুও করে না। লেবু বিক্রি করে আমার লাভ হয়নি বরং ক্ষতি হয়েছে।
‘এখন লেবুর শেষ সময়। আর এই মাসটাই আমাদের একটু লাভ হয়। এই লেবু চাষ করতে গিয়ে আমাদের অনেকে কষ্ট করতে হয়। কেউ সেটা বুঝবে না। আমরা বাজারে টেলা গাড়ি ও জিপ গাড়ি হিসেবে বিক্রি করি। প্রতিটা টেলা গাড়ি বিক্রি করছি এখন ৬ হাজার ৪শত টাকা (৮০০ লেবু) ও জিপ গাড়ি বিক্রি করছি ১৪ হাজার ৬০০ টাকা (২ হাজার লেবু)। সবদিন আবার এক যায় না।’
তিনি বলেন, ‘তবে ৪ মাস আগে প্রতিটা টেলা গাড়ি বিক্রি হয় ৪০০ টাকা মাত্র (৮০০ লেবু) ও জিপ গাড়ি বিক্রি করছি ১ হাজার ২০০ টাকা (২ হাজার লেবু)। কিছুদিন আগেও আমি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সবাইকে বলেছি ফ্রি লেবু দেব। তখন চাহিদা ছিল না। বাগানেই লেবু পচে থাকতো। আসলে শুধু লাভটা সবাই দেখে, ক্ষতি কেউ খুজে না। এখন ৩-৪টা গাছ খুঁজে একটা লেবু পাওয়া যায়। প্রতিটা গাছ থেকে লেবু সংগ্রহ করে বাজারে নিয়ে আসতে হয় গাড়ি করে নিয়ে আসতে হয়। তা পাইকারি বাজারে বিক্রি করে কিছু টাকা বের হয়। সেটা খরচও হয় না। হয়তো কিছুদিন পর লেবু চাষ করা ছেড়ে দিতে হবে।’
ছামছুল হক আরও বলেন, আমি লেবুর পাশাপাশি নাগা মরিচের চাষ করি। যা লেবু গাছের সাথী ফসল। সেগুলো আবার লটারির মতো। লাগলে লাগছে না লাগলে নাই। তবে এবছর আমার নাগা মরিচ ভালো হয়েছে। যার কারণে লেবুতে ক্ষতি হলেও মরিচে পুষিয়ে নিতে পারবো। তবে তুলনায় লাগ কম হবে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (কৃষিবিদ) মো: মহিউদ্দিন বলেন, ‘শ্রীমঙ্গলে এ বছর ৮০০ ও কমলগঞ্জে চাষ হয়েছে ১৪০ হেক্টর জমিতে লেবু চাষ হয়েছে।’
এত লেবু চাষ হওয়ার পর কেন এত দাম কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সারা বছর লেবুর চাষ হয়। কিন্তু কৃষকরা তো সারা বছর লাভ করতে পারে না। প্রায় ১০ মাস তারা খরচটা বের করে আনা দায় হয়ে পড়ে। এই দুই মাস লেবুর একটু চাহিদা। তাই এই সময়টাতে তারা কিছুটা লাভ করে।
মহিউদ্দিন বলেন বলেন, ‘এখানে তো প্রক্রিয়াজাত করে রাখার ব্যবস্থা নাই, যদি সেই ব্যবস্থা থাকতো তাহলে দাম থাকতো না। আমরা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা অবগত করেছি। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে এখানে প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
মন্তব্য করুন