রাজনগরে দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিংয়ে বিএনপিতে স্থবিরতা, ঐক্যবদ্ধ করতে নেই কোন উদ্যোগ
আউয়াল কালাম বেগ॥ দ্বন্দ্ব-গ্রুপিংয়ে সাংগঠনিক অবস্থা নড়বড়ে উপজেলা বিএনপির। অন্তর্কোন্দল প্রকট আকার ধারণ করেছে দলটিতে। বিদ্রোহ, পদত্যাগ ও শোকজের ঘটনায় টালমাটাল নেতাকর্মীরা।
২০১৯ সালে ৯ এপ্রিল গঠিত ১০১ সদস্য বিশিষ্ট দ্বিবার্ষিক কমিটিরও মেয়াদ উত্তীর্ণ। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাকের মধ্যে সমন্বয়হীনতায় মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বাড়ছে দূরত্ব।
এ কারণে পুরো উপজেলায় বিএনপি অগোছালো। দলের নীতিনির্ধারক থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা তিন গ্রুপে বিভক্ত নেতা-কর্মীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কোন্দল লেগেই আছে। উপজেলার ৮ টি ইউনিয়নেই বিএনপির সাংগঠনিক চিত্র প্রায় একই রকম।
দ্বন্দ্ব-গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে থাকা বিএনপি কেন্দ্রীয় কোন কর্মসূচি পালন করতে বা বড় কোন জমায়েত শোডাউন করতে এ উপজেলায় দেখা যায়নি দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির। কিছু কিছু নেতাকর্মী কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে জেলা সদরে গিয়ে জেলা সভাপতি নাসের রহমান গ্রুপ সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান গ্রুপে আলাদাভাবে অংশগ্রহণ করেন। অপরদিকে দীর্ঘদিন দলীয় কর্মকান্ড থেকে নিস্ক্রিয় থাকা কমিটি থেকে পদত্যাগীরা সরব হচ্ছেন তারা সকল ইউনিটের তৃণমূল নেতাকর্মীদেরদের সাথে সভা সমাবেশের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছেন।
খুব শীঘ্রই পাল্টা কমিটি ঘোষনা করবেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা জানান। উপজেলায় বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ দেখতে চান তৃণমুল থেকে উঠে আশা অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী। গ্রুপিং দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে এখনো কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি জেলা কিংবা কেন্দ্রীয় নেতাদের। এমন পরিস্থিতিতে আগামী দিনে খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ সরকার বিরোধী চুড়ান্ত আন্দোলন-কর্মসূচিতে ভাটা পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
সাংগঠনিক পরিস্থিতির করুণ দশার বিষয়ে উপজেলা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি নাসের রহমান সাংগঠনিক কাজে সময় না দিয়ে বেশির ভাগ সময় ঢাকায় অবস্থান করেন। স্থানীয় নেবৃবৃন্দের সাথে দুরত্ব বজায় রেখে চলেন। কমিটির সভায় কোনরকম আলোচনা বা মতামত না নিয়ে তিনি নিজের ইচ্ছা খুশি মত পদে নিয়োগ দেয়া, কয়েকদিন পর অব্যাহতি দেয়া, একই ব্যাক্তিকে পুনরায় স্বপদে বহাল রাখা, যাকে খুশি তাকে শোকজ করা, পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া বা শূণ্য পদ পুরণ করা সবই তার একক সিদ্ধান্তে হয়।
জেলা সভাপতির এমন কর্মকান্ডে ক্ষুদ্ধ হয়ে ২০২০ সালের ১ নভেম্বর উপজেলা কমিটি থেকে ৪৫ জন পদত্যাগ করেন। তারা হলেন-উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম এ হাকিম বকস, উপদেষ্টা ওয়াহিদ মুরাদ, যুগ্ম সম্পাদক জুবায়ের আহমদ চৌধুরী, আতাউর রহমান, প্রচার সম্পাদক জগলু তালুকদার, সহ-সম্পাদক মাসুক মিয়া, হিরা সেন অধিকারী, ছুরুক মিয়া, সৈয়দ ইকরাম হোসেন, আতাউর রহমান, দপ্তর সম্পদক মোস্তাফিজুর রহমান, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, সমাজসেবা সম্পাদক সৈয়দ ছানু আলী, সদস্য আছকর উদ্দিন, শ্রমিক দলের উপজেলা সভাপতি হোসেন আহমদ রাজা, টেংরা ইউনিয়নের বিএনপির সভাপতি আব্দুল মোত্তাকিন ও সদর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাহিদ খান প্রমুখ।
পদত্যাগপত্র থেকে জানা যায়, উপজেলা বিএনপি’র ১ম যুগ্ম সম্পাদক মোনায়েম খান গেদনের মৃত্যুতে শূণ্য হওয়া পদে সহ-সাগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক চৌধুরীকে ওই পদে দায়িত্ব দিতে জেলা বিএনপি’র সভাপতি এম নাসের রহামানের নির্দেশে চিঠি দিয়ে নিশ্চিত করেন উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। কয়েকদিন পর ওই পদ থেকে সড়িয়ে এনামুল হক চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ দিতে আবারো নির্দেশ দেন জেলা বিএনপি’র সভাপতি। এই নির্দেশনা অনুযায়ী তাকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদ দেয়া হয়েছে জানিয়ে আবারো পত্র দেয়া হয়।
এর কিছু দিন পর সম্পাদক এনামুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে সাংগঠনিক পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার নির্দেশ দেন জেলা বিএনপি’র সভাপতি। ৮ দিন পরে ২১ অক্টোবর আবারো এনামুল হক চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে বহাল করতে নির্দেশ দেন। এভাবে বারবার একই ব্যাক্তিকে বহাল আর অব্যাহতি দেয়ার নির্দেশের কারণে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে এবং দলের ক্ষতি হচ্ছে উল্লেখ করেন ঐ পদত্যাগ পত্রের মাধ্যমে।
সদর ইউনিয়ন বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইদ খান বলেন, ঐক্যবদ্ধ বিএনপি না হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাদের বিজয় কঠিন হয়ে পড়বে। উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক চৌধুরী বলেন, বড় দলে গ্রুপিং থাকতেই পারে। এম নাসের রহমানের নেতৃত্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি। ২০১৮ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ইকরাম হোসেন বলেন, দলের এই ক্রান্তিলগ্নে সকল পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান নেতা কর্মীর সমন্বয়ে নতুন একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করে রাজনগর উপজেলা বিএনপিকে শক্তিশালী করা এই মুহুর্তে খুবই দরকার।
উপজেলা বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এম আব্বাস আলি বলেন, কমিটির মেয়াদ প্রায় শেষ। আগামীতে সকলের মতামতের ভিত্তিতে নতুন নেতৃত্ব আসুক এটাই আমার দাবী। আমরা ঐক্যবদ্ধ না থাকলে এ উপজেলায় আমাদের রাজনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমএ হাকিম বকস বলেন, রাজনগর উপজেলা বিএনপির যে কমিটি আছে এটি একপেশে তথাকথিত পকেট কমিটি। জোড়া-তালির কমিটি দ্বারা একটি সংগঠন ভালোভাবে পরিচালিত হয় না। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রবীণ রাজনীতিবিদ আরো বলেন, সদরের অনেক ত্যাগী নেতাকে বাদ দিয়ে গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে অগণতান্ত্রিকভাবে মফশ্বল থেকে ধরে এনে সাংগঠনিক দায়িত্ব দিলে দলের অবস্থা এরকমই হয়।
জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি নাসের রহমান বলেন, রাজনগর উপজেলায় বিএনপিতে স্থবিরতা নেই। কমিটি থেকে পদত্যাগীদের দলে ফিরিয়ে নেয়া যায় কিনা সময় হলে দেখা যাবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। দলের গঠনতন্ত্রের ভিতরে থেকে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেই যে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।
জেলা কমিটির সদস্য ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান খান নাহাজ বলেন, জেলা বিএনপির সভাপতি এম নাসের রহমান সাংগঠনিক যে কোনো বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক ভিপি মিজানুর রহমান মিজানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা না করে তিনির এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি ইউনিট কমিটি গুলিতেও জেলা দপ্তর সম্পাদক এর সুপারিশ নিয়ে তিনি একক ভাবে অনুমোদন করেন। রাজনগর উপজেলা কমিটি একপেশে। কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের মুল্যায়ন করা হয়নি। যাহারা সভাপতি-সম্পাদক এর দায়িত্বে আছেন উনারা শুধু জেলা সভাপতি কোন প্রোগ্রামে এলে হাজিরা দেন নতুবা আর খুজে পাওয়া যায় না। তাই রাজনগর উপজেলা সদরে কোন কর্মসূচি পালন হয় না।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ভিপি মিজানুর রহমান বলেন, জেলা সভাপতি এম নাসের রহমান সাংগঠনিক কর্মকান্ডে সিদ্ধান্ত নিতে আমিসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের তোয়াক্কা করেননা। তিনি আরও বলেন, উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি সমাপ্ত করে। তৃণমূল নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে উপজেলায় একটি আহবায়ক কমিটি করে পরে সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা গেলে রাজনগরে বিএনপিতে প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে আসবে।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি জিতু মিয়া এ প্রতিবেদকের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তিনি বিভিন্ন প্রশ্ন কৌশলে এড়িয়ে যান।
মন্তব্য করুন