রুমানার পরিবার ও সুজা মেমোরিয়াল কলেজ-২

July 2, 2020,

সায়েক আহমদ॥ রুমানার মৃত্যুতে শমশেরনগর সুজা মেমোরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকবৃন্দও মর্মাহত হয়েছেন। মর্মাহত হয়েছেন শমশেরনগরের শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষাদরদী ব্যক্তিবর্গ। কারণ রুমানার একমাত্র ভাই তানভীর আহমদ সুজার স্মৃতি রক্ষার্থেই কলেজটির নামকরণ করা হয়েছিল। সুজা মেমোরিয়াল কলেজটির নামকরণের প্রসঙ্গ আসায় চলে যেতে হবে ১৯৯৪ সালে। কারণ সুজা মেমোরিয়াল কলেজ এবং অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন সবর উদ্দিন আহমদ এর সাথে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্মৃতি জড়িত আছে। প্রথমে সুজা মেমোরিয়াল কলেজ স্থাপনের পটভূমি উল্লেখ করতেই হয়।
১৯৯৪ সালের ঘটনা। তখন পরপর বেশ কিছু ঘটনা চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছিল। প্রথমত শমশেরনগর উপজেলা বাস্তবায়ন আন্দোলন তখন বেশ স্পর্শকাতর অবস্থায় চলে গিয়েছিল। পাশাপাশি আন্দোলন চলছিল ওসমানগড় উপজেলা বাস্তবায়ন আন্দোলনও। শমশেরনগর উপজেলা বাস্তবায়ন আন্দোলন আরো জোরদার করার জন্য গঠন করা হয়েছিল শমশেরনগর উপজেলা বাস্তবায়ন যুব সমন্বয় কমিটি। সে কমিটির সভাপতি ছিলেন কবি শহীদ সাগ্নিক এবং সম্পাদক ছিলাম আমি। কাজেই শমশেরনগর শব্দটি আমাদের হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করত। আমি তখন এএটিএম হাইস্কুলের গণিত বিষয়ের সিনিয়র শিক্ষক। মুজিবুর রহমান রঞ্জু তখন শমশেরনগর রোজ কিণ্ডারগার্টেন স্কুলের অধ্যক্ষ। সেখানে চৌকষ আরো কিছু শিক্ষক এলাকার শিক্ষার মানোন্নয়নে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। আমিও অবসর সময়ে তাদেরকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করতাম। একদিন সকালে রোজ কেজি স্কুলে আমার ঘনিষ্ট বন্ধু সাইফুর রহমান কামরান জানালো তার পিতা সর্বজনশ্রদ্ধেয় ডা. মুজিবুর রহমানকে সভাপতি করে গঠন করা হয়েছে ওসমানগড় কলেজ বাস্তবায়ন কমিটি। সাথে সাথে আমাদের রক্তে ‘শমশেরনগর’ নামের জাতীয়তাবাদী সত্ত্বা মাথাঝাড়া দিয়ে উঠল। আমি সাথে সাথে বললাম, ‘যদি ওসমানগড় কলেজ বাস্তবায়ন কমিটি গঠন হয়, তবে শমশেরনগর কলেজ বাস্তবায়ন কমিটিও গঠিত হবে।’ সাথে সাথে কামরান জিজ্ঞেস করল, ‘কাদেরকে নিয়ে কমিটি হবে?’ আমি প্রস্তাব করলাম, ‘মুজিবুর রহমান রঞ্জু থাকবেন আহ্বায়ক, আর আমরা থাকব যুগ্ম আহবায়ক।’ তখন মুজিবুর রহমান রঞ্জু বললেন, ‘এক কাজ করো। আমি তোমাদেরকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করব। কিন্তু আহ্বায়ক হিসেবে আমার নাম বাদ দিয়ে তোমরা কাজ চালিয়ে যাও। কারণ আমার নামের প্রতি শমশেরনগরের অনেকেরই এলার্জি রয়েছে।’ অবশেষে আমি, কামরান এবং আমাদের আরেক বন্ধু ময়নুল ইসলাম খানকে যুগ্ম আহ্বায়ক করেই গঠিত হয়েছিল ‘শমশেরনগর কলেজ বাস্তবায়ন আহ্বায়ক কমিটি।’ ১৯৯৪ সালের ২৪ আগষ্ট শমশেরনগর হাজী মো. উস্তওয়ার গার্লস হাইস্কুলে এ কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সমস্যার কারণে ঐ সভায় ময়নু এবং কামরান উপস্থিত হতে পারেনি। তবে শমশেরনগরের বিশিষ্ট ৪২ জন ব্যক্তি ঐ সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন হাজী মো. উস্তওয়ার গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বশিরউদ্দিন আহমদ। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে তৎকালীন চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন খান (মসু মিয়া) কে সভাপতি এবং আমাকে সম্পাদক করে গঠিত হয়েছিল ‘শমশেরনগর কলেজ বাস্তবায়ন কমিটি’। সভাটির নোটিশ, উপস্থিতির স্বাক্ষর এবং কার্যবিবরণীর মূল খাতাটি এখনো আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
পরবর্তীতে কমিটির পক্ষ থেকে শমশেরনগরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শিব্বির আহমদের শমশেরনগর বাজারের বাসভবনে আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম। তাকে প্রস্তাবিত কলেজের ভূমিদানের জন্য আহ্বান জানানোয় তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়ে তার কেছুলিটিতে অবস্থিত বাড়ির জায়গা দান করার প্রতিশ্রতি প্রদান করেছিলেন। আমরাও এতে প্রচণ্ড উৎসাহিত হয়ে ‘শিব্বির আহমদ কলেজ’ নাম দিয়ে একটি সাইনবোর্ড লিখিয়েছিলাম। যেদিন শমশেরনগর ডাকঘর মাঠে ‘শিব্বির আহমদ কলেজ’ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার কথা সেদিনই শিব্বির আহমদ পারিবারিক কারণে ভূমিদানের ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করেন। বিকাল ৩টায় সভা অনুষ্ঠানের কথা ছিল। ‘শমশেরনগর কলেজ বাস্তবায়ন কমিটি’ এর নিকট ছিল সেটা একটা বিরাট আঘাতস্বরূপ। তখন ‘শমশেরনগর কলেজ বাস্তবায়ন কমিটি’ সদস্যরা খুবই অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম। তবে ঘাবড়ে না গিয়ে দ্রুত পরামর্শ সভায় বসলাম। ঐদিন ‘শমশেরনগর কলেজ বাস্তবায়ন কমিটি’ এর সভাপতি রাধানগরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে থাকবেন বিধায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঐদিনের সভায় সভাপতিত্ব করবেন এএটিএম উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জ্যোতিষ রঞ্জন পাল। সিদ্ধান্ত হল ময়নু এবং কামরান সভাটি চালিয়ে নিয়ে যাবে। আর আমি এবং মো. আব্দুস সালাম বিকেলের পারাবত ট্রেনযোগে ঢাকা চলে যাব। কিন্তু পারাবত ধরতে হলে হাতে সময় একদম নেই। কাজেই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে আমি এবং মো. আব্দুস সালাম দ্রুত সড়কপথে শমশেরনগর হতে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম। তখন বেলা ১টা বেজেছিল। সম্ভবত পারাবত ট্রেনটি শ্রীমঙ্গল হতে বিকাল ৩টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যেত। আমরা শ্রীমঙ্গল পৌঁছে টিকেট করেই ট্রেনটি ধরতে সক্ষম হয়েছিলাম।
রাত ৯টায় সুজা মেমোরিয়াল কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ বাবুল মোর্শেদ যে বাসায় থাকতেন আমরা সে বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। উল্লেখ্য, বাবুল মোর্শেদ ও আমি একই সাথে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কারণে আমাদের উভয়ের সম্পর্ক বেশ অন্তরঙ্গই ছিল। তখন টেলিফোন যোগাযোগ তেমন উন্নত ছিল না। কাজেই আমরা পৌঁছার পর সালাম মামু বাবুল মোর্শেদকে পুরো ঘটনাটি খুলে বললেন। আমরা তখন ঢাকা গিয়েছিলাম গ্রুপ ক্যাপ্টেন সবর উদ্দিন আহমদ এর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। এ পরামর্শটি ছিল অবশ্য মুজিবুর রহমান রঞ্জুর। কারণ সবরউদ্দিন সাহেব মুজিবুর রহমান রঞ্জুর আপন চাচা। শিংরাউলী রেলসংলগ্ন এলাকায় সবরউদ্দিন সাহেবের প্রায় ১ একর পরিমাণ জায়গা আছে। কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ঐ জায়গাটুকুই যথেষ্ট। এবার আমরা আটঘাঁট বেঁধেই এসেছি। যেভাবে হোক গ্রুপ ক্যাপ্টেন সবর উদ্দিন আহমদকে জায়গা দান করার ব্যাপারে রাজী করাতেই হবে। কারণ সবরউদ্দিন সাহেবের আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভাল। ঢাকায় সপরিবারে প্রতিষ্ঠিত অবস্থায়ই আছেন। কাজেই ঐ জায়গাটি কলেজের জন্য দান করে দিলে তাঁর খুব একটা ক্ষতি হবে না।
আমরা জানতাম তানভীর আহমদ সুজা ছিল সবরউদ্দিন সাহেবের একমাত্র ছেলে। গতবছরই তার অকালমৃত্যু হয়েছে। সে ছিল শমশেরনগর এলাকার জন্য গর্ব। কারণ তখন সে ছাড়া বুয়েটের আর কোন ছাত্র শমশেরনগরে ছিল না। বাবুল মোর্শেদ বারবার সতর্ক করে দিল সুজা প্রসঙ্গে কোন কথা বললে তিনি প্রচণ্ড ইমোশোনাল হয়ে যান। কাজেই কথাবার্তা বেশ সতর্কতার সাথে বলতে হবে।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com