রোজাদারদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত সওয়াব

March 23, 2023,

এহসান বিন মুজাহির॥ রহমত মাগফেরাত আর নাজাতের দশক নিয়ে দুয়ারে কড়া নাড়ছে ১৪৪৪ হিজরির রমজান মাস। ২৩ মার্চ বৃহস্পতিবার দেশের আকাশে চাঁদ দেখা যাওয়ায় ২৪ মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজানুল মোবারক। মাহে রমজানের রোজা গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরজ ইবাদত। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের ওপর রমজান মাসে রোজা পালন ফরজ করে দিয়েছেন।

রোজার ইতিহাস দীর্ঘতর। পূর্ববর্তী উম্মতরাও যে রোজা পালন করতেন এবং তাদের ওপরও যে রোজা ফরজ ছিল, তা পবিত্র কুরআন কারিমের সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াত দ্বারা উপলব্ধি করা যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন-  রোজা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’। রোজার ফজিলত অপরিসীম। রোজাদারদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত সওয়াব। রোজার বিনিময় স্বয়ং আল্লাহ দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন।

হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। রোজা শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেবো। (মুসলিম: ২৭৬০)। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,‘তোমাদের কাছে রমজান উপস্থিত হয়েছে। রমজান এক বরকতময় মাস। আল্লাহ  তোমাদের ওপর এ মাসে সিয়াম পালন করা ফরজ করেছেন। এ মাসে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে অবাধ্য শয়তানদের শিকলবদ্ধ করা হয়। এ মাসে আল্লাহ এমন একটি রাত রেখেছেন, যা হাজার মাসের  চেয়ে উত্তম।

যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষেই বঞ্চিত’। (নাসায়ি : ২১০৬)। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, মানব সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, কিন্তু রোজার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা রোজা শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব। (মুসলিম : ১৫৫১)।  হজরত সাহল বিন সাদ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল(সা.) এরশাদ করেন, জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে, যার নাম রাইয়্যান। কেয়ামতের দিন  রোজাদারগণই শুধু সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে।

তাদের ছাড়া অন্য কেউ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। সেদিন  ঘোষণা করা হবে, রোজাদাররা কোথায়? তখন তারা দাঁড়িয়ে যাবে এবং  সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। যখন তাদের প্রবেশ শেষ হবে, তখন দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। ফলে তারা ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। (বোখারি : ১৭৯৭)। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ সম্পর্কে আরও এরশাদ করেন-শুধু পানাহার বর্জনের নাম রোজা নয়। রোজা হলো অনর্থক ও অশ্লীল কথা-কাজ বর্জন করার নাম।

কেউ তোমাকে গালি দিলে বা তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে তুমি তার সঙ্গে তেমনটি না করে  কেবল এটুকুই বলো– আমি রোজাদার’। (মুসলিম: ২৪১৬)। রমজান এমন একটি নেয়ামতের মাস, যে ব্যক্তি এ সময়কে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যবহার করবে সে ব্যক্তিই নাজাত পাবে। অর্জন করতে পারবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি, হতে পারবেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা। সুতরাং যে এ মাসটিকে আমল-ইবাদতে কাটাতে পারলো না সে যেনো ধ্বংসই হয়েগেলো। আর যে এ মাসটিতে নিজ তাকওয়া বৃদ্ধি করতে নিরন্তর চেষ্টা চালাতে থাকে সে ব্যক্তিই আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে জাহান্নাম থেকে নাজাত লাভ করতে পারে। রোজা মুত্তাকির জন্য এক অফুরন্ত নেয়ামতস্বরূপ।

কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে মুত্তাকি ক্ষুধা, পিপাসা, কাম, ক্রোধ, লোভ-লালসা পরিত্যাগ করে রোজা পালনে ব্রতী হন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমজানের রোজা পালন করতে গিয়ে রোজার সীমারেখা বুঝেনেবে এবংযে কর্তব্য রোজার ভেতর পালন করা বাঞ্ছনীয়, তা যথার্থভাবে পালন করে চলবে, তার এরূপ  রোজা বিগত গুনাহের ক্ষমার কাফফারা হয়ে যাবে। (বায়হাকি : ১১৩৪)। তাকওয়া অর্থ নিছক খোদাভীতিই নয়। বিশ্বপালনকর্তা হিসেবে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি নিয়ে যারাই দায়িত্ব পালন করে তারাই মুত্তাকী। তাকওয়া মানে খোদাভীতি, ভয় করা আল্লাহকে।

রোজার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়ার অধিকারী হওয়া এবং এরই আলোকে মানবজীবন পরিচালনার শক্তি লাভ করা। কুরআন কারীমে আল্লাহ স্পষ্ট বলেছেন-রোজার মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া হাসিল করা। রোজা পালন করলেই তাকওয়া বা মুত্তাকী হওয়া যায় না। মুত্তাকী হওয়ার জন্য মুত্তাকীর গুণাবলী অর্জন করতে হয়। আমাদের সমাজে মুত্তাকী বলতে বিশেষ পোশাকের মানুষকে মনে করা হয়। তাকওয়াকে বিচ্ছিন্ন কিছু মনে করা হয়। তাকওয়া গুটিকয়েক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মুত্তাকী হতে হলে কুরআন-হাদিসের নির্দেশনা পুরোপুরি অনুসরণ করতে হবে। মাসব্যাপী রোজা পালন করে যদি তাকওয়া অর্জন করা না যায় তাহলে এ রোজা অর্থহীন উপবাস ও নিছক আত্মপ্রবঞ্চনায় পর্যবসিত হয়। (মুসলিম: ২১৩৪)।

হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি বাজে কথা ও কাজ ত্যাগ করল না, তার পানাহার ত্যাগ নিছক উপবাস ছাড়া আর কিছু নয়’। (বুখারি : ১৮০৪)। হজরত রাসূলে কারীম এরশাদ করেন-অনেক রোজাদার এমন, যারা রোজা রেখে কেবল ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কিছুই পায় না; আর যারা রাত জেগে নামাজ আদায় করে তাদের মধ্যেও এমন বহু  লোক আছে, নামাজে দাঁড়িয়ে রাতজেগে কষ্ট করা ছাড়া যাদের আর কোনো লাভ হয় না। (ইবনু মাজাহ : ১৬৯০)।

শুধু না খেয়ে থাকাই সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং যাবতীয় পাপাচার থেকে নিজের নফস ও প্রবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে মুখ ও জিহ্বাকে সংযত রাখতে হবে। সংযমের পরিচয়ে দিতে হবে সবক্ষেত্রে। পানাহার থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সব ধরণের অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা রোজাদারদের অপরিহার্য কর্তব্য। রমজান মাসের রোজা পালনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করতে পারলেই মুত্তাকী হওয়া সম্ভব। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে জীবনের জানা-অজানা গোনাহের ক্ষমা লাভ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে।

রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাসে তাকওয়া অর্জন করে জীবনের যাবতীয় গুনাহ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজেকে মুত্তাকী বান্দাহ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই মাহে রমজানের তাকওয়া অর্জন করা সম্ভব হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে রোজার যথাযথ হক আদায় করার তাওফিক দান করুন।

লেখক পরিচিতি : প্রধান শিক্ষক, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মুহতামিম, সাইটুলা ইসলামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম মাদরাসা, শ্রীমঙ্গল। মোবাইল : ০১৭৩২০৯৬৪১২

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com