রোযায় ওএমএসের বরাদ্দ বৃদ্ধি ও ন্যায্যমূল্যের দোকান চালুর দাবি হাকালুকি হাওর পারের দূর্গত মানুষ চরম বিপাকে
আবদুর রব॥ হাকালুকি হাওর তীরের বড়লেখা, কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের বন্যা দূর্গত মানুষ চরম বিপাকে। নেই ত্রাণ, লাইনে দাঁড়িয়েও মিলে না ওএমএস এর চাল। ত্রাণ না দিলেও ওএমএসের চালের বরাদ্দ বৃদ্ধির সাথে হাওর পারে ন্যায্য মুল্যের ভ্রাম্যমান দোকান (টিসিবি) চালুর দাবি হ্ওার পারের ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধ লক্ষ কৃষক ও জেলে পরিবারের।
সরেজমিনে হাকালুকি হাওর তীরের বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নের মূর্শিবাদকুরা গ্রামে গেলে গ্রামের ফরিদা বেগম (৪০), লায়লা বেগম (৪৫), বাহার উদ্দিন জানান, প্রতি বৃহস্পতিবারে আমাদের ওয়ার্ডে দেয়া হয় ওএমএসের চাল। চাল আনতে হলে সকাল ৬টায় গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। ২ সপ্তাহ দাঁড়ানোর পর পেয়েছেন ৫ কেজি চাল। কিন্তু এতে লায়লা বেগমের ৯ সদস্যের পরিবারের চলে মাত্র ৪ বেলা। অর্থাৎ দিনও চলে না এই ওএমএস এর চালে। ফলে সপ্তাহে ৫দিনই তাদের অনাহারে অর্ধাহারে কাটাতে হয়।
একই কথা একই গ্রামের আশ্রব আলী (৬৫), ময়না মিয়া (৬০) ও মনির উদ্দিনের (৪৫)। ওএমএসএর চাল যদি প্রতিদিন ৫ কেজি হাওর পারের মানুষকে দেয়া হয়, তাহলে কিছুটা স্বস্তি পাবে মানুষ।
ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের জন্য বড়লেখা উপজেলায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩টি ইউনিয়নে চালু করা হয়েছে ওএমএস কার্যক্রম। এই ৩টি ইউনিয়নের মধ্যে তালিমপুর ইউনিয়ন অন্যতম। এই ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ বন্যায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ডিলার সফিক উদ্দিন ওএমএস দোকান খুলেছেন কানুনগো বাজারে। প্রতিদিন বিক্রীর জন্য ১ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে কেজি করে ২০০ মানুষকে দেয়ার জন।। কিন্তু দোকান খুলার সাথেই ২ থেকে ৫শ’ মানুষ জড়ো হন চাল নেয়ার জন্য। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ বোরো কৃষকরা ওএমএস এর চাল না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান।
গ্রামের জাহিদুর রহমান, মুসা মিয়া, মানিক মিয়া, নৃপন্দ্রে নাথ, জিতেন্দ্র দাস। রামপাশা গ্রামের রেনু মিয়া, তারা মিয়া, মিটুপুর গ্রামের রিয়াজ মিয়া, লিটন মিয়া, তোতা মিয়া অভিযোগ করেন, আমরা ৩দিন গিয়ে চাল না পেয়ে ফিরে এসেছি খালি হাতে। যদি ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের জন্য ওএমএস চাল দেয়া হয়, তাহলে আমরা পাচ্ছি না কেন।
বড়লেখার সুজানগর ইউনিয়নের ডিলার মক্তার আলী জানান, ওএমএসের চালের বরাদ্দ কম থাকায় লোকজন মারাত্মক সমস্যা করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ১০-১৫ হাজার হলেও চাল বিক্রীর ব্যবস্থা মাত্র ২০০ জনের কাছে। এতে চাল কিনতে এসে না পেলে তারা মনে করেন ডিলার বাহিরে বিক্রী করে দিয়েছে।
একই চিত্র হাওরপারের বর্নি ইউনিয়নের ডিলারের ক্ষেত্রেও। প্রায় ২০ হাজার মানুষ বোরো ফসল হারিয়ে দিশেহারা। নেই পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা। দূর্গত মানুষ হাহাকার করছেন।
কুলাউড়া উপজেলার জয়চন্ডী ইউনিয়নের ওএমএস ডিলার আব্দুস সালাম জানান, তার দোকান বিজয়া বাজারে। এখানে ফযরের নামাযের পর থেকে এসে লোকজন লাইনে দাঁড়ায়। চাল বিক্রি শুরু হওয়ার দেড় দুই ঘন্টার মধ্যে বিক্রি শেষ হয়ে যায়। ইউনিয়নের যেকোন স্থান থেকে লোকজন আসলে চাল পায়। যে এলাকায় অধিক বোরো ফলন হয় সেই এলাকার কিছু মানুষ চাল নিতে আসে। বাগানের লোকজন লাইনে দাঁড়ালে তাদেরকে তো আর ফেরৎ দেয়া যায় না। যারা আগে লাইনে এসে দাঁড়ায় তারাই পায়। প্রতিদিন ২শ মানুষ চাল পেলেও আর দেড় দুইশ লোক ফেরৎ যায়। চালের বরাদ্দ দ্বিগুন করলেও মানুষের পূরণ হবে না।
জুড়ী উপজেলার পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের বাছিরপুর বাজারের ওএমএসের ডিলার সুমন দে জানান, ২০০ মানুষের নিকট বিক্রীর জন্য বরাদ্দ থাকলেও প্রতিদিন ৫-৬ শ’ মানুষ জড়ো হন। চাল না পেয়ে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
ভুকশিমইল ইউনিয়নের ওএমএস চালের ডিলার মেসার্স আজমল ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী আজমল আলী জানান, ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওয়ার্ড ওয়ারী ভাগ করে দেয়ায় অনেকটা সুবিধা হয়েছে। তারপরও প্রতিদিন ৪ শতাধিক মানুষ লাইনে দাঁড়ায়। হতাশা নিয়ে মানুষ ফিরে যায়। ওয়ার্ড ভাগ করার আগে চাল নিতে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো দুষ্কর। গত বৃহস্পতিবার মাত্র দেড় ঘন্টায় ১ টন চাল বিতরণ করা শেষ হয়। তিনি মানুষের সুবিধার জন্য রেজিষ্টারে নাম লেখতে একজন, চাল মেপে দেয়ার জন্য দুই জন এবং মানুষকে লাইনে দাঁড়িয়ে যাতে সুশৃঙ্খলভাবে চাল নিতে পারে তার জন্য আর দুই জন স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে।
ভুকশিমইল ইউনিয়নে ওএমএস’র দোকানে ট্যাগ অফিসারের দায়িত্ব পালনকারী উপসহকারী কৃষি অফিসার কানাই লাল সরকার জানান, ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের লোকজনকে চাল নিতে এসে গাড়ী ভাড়া গুনতে হয় বেশি। ফলে সুবিধাজনক স্থান নির্ধারণ করে সপ্তাহে ১ বা ২ দিন সেই স্থানে চাল বিক্রি করা যেতে পারে।
হাকালুকি হাওর তীরের ইউনিয়নগুলোতে এখনও শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ ত্রাণ বঞ্চিত। বড়লেখা উপজেলার ৪ ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ২৫ হাজার। এরমধ্যে ৩ হাজার মানুষও ত্রাণ পাননি। ভুকশিমইল ইউনিয়নে অকাল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ তালিকাভুক্ত কৃষক ও জেলের সংখ্যা ৩ হাজার। এরমধ্যে আর ত্রাণ পেয়েছে ১৪ শ মানুষ। ভাটেরা ইউনিয়নে তালিকাভুক্ত ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা ১৮শ। আর ত্রাণ পেয়েছে মাত্র ৯শ জন ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ।
সুজানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নছিব আলী ও তালিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ কান্তি দাস জানান, যে দু’দফা ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে, তা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। রোযায় মানুষ বিপাকে পড়বে। এখন ওএমএস চালের যদি বরাদ্দ বাড়ানো না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিক্রীও বন্ধ। ন্যায্যমূল্যের দোকান যেমন-তেল, মরিচ, পিয়াজ এসব সামগ্রী দেয়া হলে রোযায় মানুষ স্বস্তিতে থাকবে। বিষয়টি বিবেচনার জন্য আমারা মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের দৃষ্ঠি আকর্ষন করছি।
এব্যাপারে বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ওএমএসের চালের বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আর টিসিবির দোকান হয়তো হাওর এলাকায় চালু করা সম্ভব হবে না। তবে উপজেলা পর্যায়ে রমযানের শুরুতেই টিসিবি পন্যের দোকান চালু হতে পারে।
মন্তব্য করুন