লাউয়াছড়ার দূর্ঘটনা এড়াতে ২৫ হাজার গাছ কর্তনের চিঠি 

June 20, 2016,

সাইফুল ইসলাম॥ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকার বনের ভিতর দিয়ে বুকচিরে বয়ে যাওয়া রেললাইনের দু-পাশের ২৫ হাজার গাছ কর্তনের জন্য চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
জুন মাসের পর রেললাইনের দুইপাশের গাছ কাটতে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে লোকবল চেয়ে চিঠি দিয়েছে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল বিভাগ।
অনুমতি পেলেই প্রাথমিকভাবে রেললাইনের উপর বেঁকে থাকা, হেলে থাকা গাছ কাটা শুর” হবে বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলী আরমান হোসেন।
তবে বনবিভাগ বলছে, রেলকর্তৃপক্ষ চাইলেই গাছ কাটতে পারবে না। যদি গাছ কাটে তাহলে বন আইনের বিধি অনুযায়ী তাদের বির”দ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

l
এদিকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের রেললাইনের দুই পাশের গাছ কাটতে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগকে দুই দফা চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বনবিভাগ বলছে, এতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ হাজারের বেশি গাছ কাটা পড়বে।
এই গাছ কাটা পড়লে বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ।
তাদের মতে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সরকারঘোষিত সংরক্ষিত এলাকা এবং এই বনাঞ্চল থেকে সব ধরনের গাছ কাটা ও অপসারণ নিষিদ্ধ।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আরমান হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি তাদের দেওয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, ঢাকা-সিলেট রেললাইনের শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ২৯৩/১ থেকে ২৯৮/১ কিলোমিটারের পাহাড়ি এলাকায় ঝড়-বৃষ্টিতে গাছ উপড়ে ও ভেঙে রেললাইনের ওপর পড়ছে। এতে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ও যাত্রীসাধারণের প্রাণহানি ঘটতে পারে।
চিঠিতে বলা হয়, গত বছরের ২১ এপ্রিল রাতে ঝড়ে ৩০-৩৫টি গাছ রেললাইনের ওপর ভেঙে পড়ে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। এছাড়া চলতি বছরের ৭ এপ্রিল রাতে ঝড়ে আরও ৩০টির মতো গাছ রেললাইনের ওপর পড়ে। এতে উপবন এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনের একটি হেডলাইট ভেঙে যায় ও ট্রেনটি আটকা পড়ে। এ অবস্থায় উদ্যান এলাকার রেল লাইনের উভয় পাশের ন্যূনতম ৫০ ফুট পর্যন্ত গাছ কাটতে হবে।

h
একইভাবে রেললাইনের রশিদপুর-সাতগাঁও বিভাগের ২৭১/২ থেকে ২৭৯/৭ কিলোমিটার পর্যন্ত উভয় পাশের গাছও কাটতে হবে। নইলে পরবর্তী সময়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ‘দ্য রেলওয়েজ অ্যাক্ট, ১৮৯০’-এর ১২৮ ধারা মোতাবেক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
রেলওয়ের চিঠির জবাব দিয়েছেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো।
১২ মে পাঠানো চিঠিতে তিনি লিখেছেন, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া উদ্যানটি ১৬৭ প্রজাতির বৃক্ষ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ীসহ অসংখ্য বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল। এর ভেতরে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের রেললাইনের ২৯৩/১ থেকে ২৯৮/১ এই পাঁচ কিলোমিটারের উভয় পাশে ৫০ ফুট এলাকার মধ্যে জরিপে দেখা গেছে, এখানে পাঁচ বছর থেকে শতবর্ষী ও তার অধিক বয়সী ২৫ হাজারের বেশি গাছ আছে।

o
এ ছাড়া এই এলাকার প্রতি বর্গমিটারে আছে ২০টি করে চারাগাছ ও অন্যান্য লতাপাতা-ঝোপঝাড়। যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য বন্যপ্রাণী বাস করে। এসব গাছ কাটা হলে বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাতœক হুমকির মুখে পড়বে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গেজেটে প্রোটেকটেড এলাকা হিসেবে ঘোষিত হয় এবং উক্ত বনাঞ্চল হতে সকল ধরনের গাছ কর্তন ও অপসারণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
চিঠিতে আরও বলা হয়, পত্রে ০৭/০৪/২০১৬ইং তারিখে দিবাগত রাত ১২.৩৫ ঘটিকায় প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে রেল লাইনের উপরে ৩০টি গাছ পতিত হওয়ার যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা অতিরঞ্জিত। কেননা উক্ত দিনে ঝড়ের প্রভাবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অভ্যন্তরে ২৯৩/৫-৬পয়েন্ট ১টি বনাক গাছ,২৯৩/৮-৯ পয়েন্টে ১টি শিমুল গাছ এবং ২৯৪/১-২ পয়েন্টে ১টি লালী গাছ ভেঙ্গে পড়ে। মূলত : ৩টি পয়েন্টে ভেঙ্গে পড়া বনাক গাছের কারণে উপবন ট্রেনটি আটকা পড়ে। তবে উপবন ট্রেনটি নিরাপদ দূরত্বে অর্থাৎ মাগুরছড়া গ্যাস ফিল্ডের মোড়ে ব্রীজের উপর অবস্থান করেছিল।’
চিঠিতে বলা হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট বিচ্ছিন্ন ২/১টি ঘটনার জন্য লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যানের হাজার হাজার গাছ কর্তন ও জীববৈচিত্র্য ধবংস করা কোন ক্রমেই যুক্তিযুক্ত ও আইনসম্মত নয়।
মিহির কুমারের চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান অসংখ্য বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, প্রজননক্ষেত্র। কিন্তু এ বনাঞ্চলের বুক চিরে চলা যাওয়া রেললাইনে প্রতিনিয়ত বিকট শব্দে ট্রেন চলাচল করায় বনাঞ্চলে বিদ্যমান বন্যপ্রাণী স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, প্রজনন ও চলাচলে মারাত্মক বিঘœ ঘটছে।
চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, রেললাইনের পাশের জমি বাংলাদেশ রেলওয়ের লিজ গ্রহীতারা বনের পাশের বিদ্যমান ঝোপ-জঙ্গল ধবংস করে লেবু বাগানসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার প্রচেষ্টা গ্রহন করেছে। যা সার্বিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
মিহির কুমারের এই চিঠির পর ১৮ মে রেলওয়ে থেকে বন কর্মকর্তাকে পুনরায় চিঠি দিয়ে বলা হয়, রেলপথের উভয়পাশের গাছপালা কাটার অনুরোধ জানানো হলেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে গাছগুলো না কাটলে রেলওয়ে আইন অনুযায়ী রেল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু রবিবার পর্যন্ত রেলওয়ের পক্ষ থেকে গাছ কাটার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে মিহির কুমার দো বলেন, প্রথমতো আমরা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি রেল কর্তৃপক্ষ চাইলেও গাছ কাটতে পারবে না। যদি গাছ কাটে তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকার বিভাগীয় প্রকৌশলী আরমান হোসেন বলেন, রেললাইনে গাছ পড়ে রেল চলাচল বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তাই নিরাপদ দূরত্ব পর্যন্ত গাছ কাটতে বলা হয়েছে।

w
এ বিষয়ে মিহির কুমার দো বলেন, বনের ভেতর দিয়ে রেললাইন থাকলে কিছু ঝুঁকি থাকবে। ঝুঁকি এড়ানোর জন্য রেললাইন শিফট করতে হবে। রেললাইনের পাশে বিপুলসংখ্যক গাছ আছে। এসব গাছ কাটা হলে পরিবেশ, উদ্ভিদ ও জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় চিঠির জবাব এখনো দেওয়া হয়নি। সরকারি গাছ চাইলেই কাটা যাবে না।
বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা বিভাগীয় প্রকৌশলী আরমান হোসেন বলেন, ‘আমরা জানিয়েছিলাম। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল। যদি তারা (বনবিভাগ) গাছ না কাটে তাহলে আমাদের লোকবল নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গাছগুলো কাটার ব্যবস্থা করব। যেহেতু আমাদের গাছ কাটার স্পেশাল লোক নাই। এ জন্য আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে লোকবল চেয়ে চিঠি দিয়েছি। এখনো অনুমতি পায় নাই। অনুমিত পেলেই গাছ কাটা হবে।
কতটি গাছ প্রাথমিকভাবে কাটার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, খুব বেশি না। রেললাইনের দিকে বেঁকে আছে, হেলে আছে, রেল লাইনের দিকে পড়ে যেতে পারে এমন গাছই কাটা হবে।
তিনি বলেন, আমরা তো ২৫ হাজার গাছ কাটার জন্য বলি নাই। আমরা চিঠি দিয়েছিলাম যেসব গাছ ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো কাটতে। এ রকম গাছ ৫০/৬০টি হবে। তবে আমি চেষ্টা করবো জুনের পরে বন বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে যৌথ জরিপে বসার জন্য।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com