লাউয়াছড়ার মৃত্যুর প্রহর গুনছে ২৫ হাজার গাছ ॥ মুখোমুখি রেল ও বন বিভাগ
ইমাদ উদ দীন॥ মুখোমুখি রেল ও বন বিভাগ। উভয় পক্ষ যার যার অবস্থানে অনড়। লাউয়াছড়ার ২৫ হাজার গাছ কাটা আর রক্ষা নিয়ে চলছে দু’পক্ষের ঠান্ডা লড়াই। আগে থেকে বিষয়টি নিয়ে একে অপরকে মৌখিক ও লিখিত ভাবে জানালেও এখন চলছে চিঠি চালাচালি। স্থানীয় পর্যায়ে সিন্ধান্ত না হওয়ায় এখন তা গড়িয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পর্যন্ত। গাছ কাটার প্রয়োজনীয়তা অপ্রয়োজনীয়তা আর লাভ ক্ষতির চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে দু’পক্ষের। একে অপরকে লিখিত ভাবেই এমন হিসেব নিকাশও জানাচ্ছেন। দিন যত গড়াচ্ছে বিষয়টি তত জানাজানিও হচ্ছে। আর এ নিয়ে সোচ্চারও হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্ধা,সমাজকর্মী ও সুশিল সমাজ। বসে নেই প্রকৃতিপ্রেমী ও পরিবেশবাদীরা। ইতিমধ্যে তাদের উদ্দ্যোগে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষায় গাছ কাটা রোধে বিভাগীয় শহরে হয়েছে মানববন্ধন। অপেক্ষা করছে নানা আন্দেলন কর্মসূচীও।
জানা যায় সমপ্রতি কমলগঞ্জের রাজকান্দি রেঞ্জ এলাকার সংরক্ষিত বনের দুই কিলোমিটার ও পাশের ৩ কিলোমিটার এলাকায় রেলপথের দু’পাশের সামাজিক বনায়নের প্রায় চার হাজার গাছ কাটা শুরু হয়েছে। এবার দেশের “রেইন ফরেষ্ট” খ্যাত নানা জীববৈচিত্রে ভরপুর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায় রেলপথের দু’পাশের গাছ কাটতে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। নির্বিঘেœ ট্রেন চলাচল ও দুর্ঘটনা এড়াতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগ। বন্যপ্রাণী বিভাগের কর্মকর্তা ওই চিঠির জবাবে জানিয়েছেন উদ্যানের ভেতরে প্রায় ২৫ হাজারেরও বেশি গাছ কাটা পড়বে। এতে অসংখ্য বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল লাউয়াছড়া জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় মৌলভীবাজার ফরেস্ট রেঞ্জের আওতাধীন ২,৭৪০ হেক্টর আয়তনের পাহাড়ী টিলার এই বনের মধ্যে ১৯৯৬ সালে পশ্চিম ভানুগাছের সংরক্ষিত বনের ১২৫০ হেক্টর জায়গা নিয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। বনবিভাগের তথ্যমতে এই বনে রয়েছে বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণির আবাসস্থল। এমনিতেই জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর থেকেই এখানে গাছ চুরির মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এরই মধ্যে ট্রেনে দুর্ঘটনার ঝূঁকি এড়ানোর জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ ষ্টেশন পর্যন্ত রেলপথের দু’পাশের ৫০ ফুট পর্যন্ত গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রেলওয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক লাউয়াছড়া বনের সংযুক্ত রাজকান্দি রেঞ্জের সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে রেলপথের দু’পাশে দুই কিলোমিটার ও পাশের ৩ কিলোমিটার এলাকায় সামাজিক বনায়নের গাছ কাটা শুরু হয়েছে। কমলগঞ্জের রাজকান্দি রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রায় চৌধুরী রেলপথের ৫ কিলোমিটার এলাকায় সামাজিক বনায়নের প্রায় ৪ হাজার গাছ কাটার সত্যতা নিশ্চিত করে মানবজমিনকে জানান ইতিমধ্যেই মাগুরছড়া এলাকায় প্রায় ৫ শতাধীক গাছ কাটা হয়েছে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ মো. আরমান হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বলা হয়েছে ঢাকা-সিলেট রেলপথের শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ২৯৩/১ থেকে ২৯৮/১ কিলোমিটারের পাহাড়ি এলাকায় ঝড়-বৃষ্টিতে গাছ উপড়ে ও ভেঙে রেলপথের ওপর পড়ছে। এতে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ও যাত্রীসাধারণের প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় গত বছরের ২১ এপ্রিল রাতে ঝড়ে ৩০-৩৫টি গাছ রেলপথের ওপর ভেঙে পড়ে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। এছাড়া চলতি বছরের ৭ এপ্রিল রাতে ঝড়ে আরও ৩০টির মত গাছ রেলপথের ওপর পড়ে। এতে আন্ত:নগর উপবন এক্সপ্রেস ইঞ্জিনের একটি হেডলাইট ভেঙে যায় ও ট্রেনটি আটকা পড়ে। এমতাবস্থায় উদ্যান এলাকার রেললাইনের উভয় পাশের নূন্যতম ৫০ ফুট পর্যন্ত গাছ কাটার প্রয়োজন। তা না হলে পরবর্তী সময়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ‘দ্য রেলওয়েজ অ্যাক্ট, ১৮৯০’-এর ১২৮ ধারা মোতাবেক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ১২ মে রেলওয়ের চিঠির জবাবে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো চিঠিতে লিখেছেন মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া উদ্যানটি ১৬৭ প্রজাতির বৃক্ষ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ীসহ অসংখ্য বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল। এর ভেতরে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের রেললাইনের ২৯৩/১ থেকে ২৯৮/১ এই পাঁচ কিলোমিটারের উভয় পাশে ৫০ ফুট এলাকার মধ্যে জরিপে দেখা গেছে এখানে পাঁচ বছর থেকে শতবর্ষী ও তার অধিক বয়সী ২৫ হাজারের বেশি গাছ রয়েছে। এ ছাড়া এই এলাকার প্রতি বর্গমিটারে আছে ২০টি করে চারাগাছ ও অন্যান্য লতাপাতা-ঝোপঝাড়। যেখানে বাস করে অসংখ্য বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী। এসব গাছ কাটা হলে বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। তাদের মতে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত এলাকা এবং এই বনাঞ্চল থেকে সব ধরনের গাছ কাটা ও অপসারণ নিষিদ্ধ। পরবর্তীতে সর্বশেষ ১৮ মে রেলওয়ে থেকে বন কর্মকর্তাকে পুনরায় চিঠি দিয়ে বলা হয় রেলপথের উভয় পাশের গাছপালা কাটার অনুরোধ জানানো হলেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সাত কার্যদিবসের মধ্যে গাছগুলো না কাটলে রেলওয়ে আইন অনুযায়ী রেল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সিলেটের সহাকারী নির্বাহী প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চিঠি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন রেললাইনে গাছ পড়ে রেল চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গাছ কাটার বিষয়ে দুই বছর আগ থেকে লেখালেখি হয়েছে। বৃহত্তর জনস্বার্থে গাছগুলো কাটতে হবে। বন্যপ্রাণী বিভাগ এগুলো না কাটলে রেলওয়ে ডিপার্টমেন্ট কেটে ফেলবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো মানবজমিনকে বলেন বিষয়টি এখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দেখছেন। ১৮ তারিখের পর ওদের পক্ষ থেকে আর কোন চিঠিও আসেনি। তিনি বলেন বনের ভেতর দিয়ে রেললাইন থাকলে কিছুটা ঝুঁকি থাকবেই। রেললাইনের পাশে বিপুলসংখ্যক ভালো গাছ আছে।এসব গাছ কাটা হলে পরিবেশ, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্রের মারাত্মক ক্ষতি হবে। তিনি জানান সরকারি গাছ চাইলেই কাটা যাবে না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য আইনগতভাবে ভ্রান্ত। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিজে গাছ কেটে ফেলার উদ্যোগ নিলে রিজার্ভ ফরেষ্ট এ্যাক্ট আইনে মামলা করা হবে বলে তিনি জানান। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর জাতীয় পরিষদ সদস্য ও মৌলভীবাজার জেলা সমন্বয়ক আ.স.ম ছালেহ সুহেল, মৌলভীবাজার জেলা পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সৈয়দ মহসীন পারভেজ ও সাধারণ সম্পাদক নরুল মোহামীন মিল্টন বলেন রেল বিভাগের এমন তুঘলকি সিন্ধান্ত বিপন্ন লাউয়াছড়াকে ধ্বংসের নামান্তর। তারা বলেন রেলওয়ের ১৫৭ নং রেল সেতুটি দীর্ঘ দিন থেকে ত্রুটিজনিত ও ভারী বর্ষনের কারণে ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে ৪ বার দীর্ঘসময় ট্রেন আটকা পড়লেও ব্রীজটি নতুন করে তৈরী করা হয়নি। অথচ টুনকু অভিযোগে র্দূঘটনা এড়ানোর নামে ২৫ হাজার গাছ কেটে জীববৈচিত্রের অভায়াশ্রম নষ্ট করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তারা হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেন এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হলে বসে থাকবেনা পরিবেশ, প্রকৃতিপ্রেমী ও এ অঞ্চলের সাধারণ জনগণ। এমন হটকারী সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা রমজানের পর আন্দোলনে নামছেন বলেও জানান।
লাউয়াছড়া থেকে রেললাইন সরানোর দাবিতে মানববন্ধন:এদিকে ২৫ হাজার গাছ কাটার চিঠির জবাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে রেললাইন সরানোর চিঠি দিতে বন বিভাগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সিলেটের তিনটি পরিবেশবাদী ও প্রাণী অধিকার সংগঠন। ১৯ জুন রোববার বিকেলে সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), ভূমিসন্তান বাংলাদেশ ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী অধিকার-বিষয়ক সংগঠন প্রাধিকার-এর যৌথ উদ্যোগে মানব বন্ধন কর্মসূচি থেকে এ আহ্বান জানানো হয়।এতে পরিবেশবাদী সংগঠনের সদস্য ছাড়াও পরিবেশ ও প্রকৃতি সচেতন বিভিন্ন শ্রেণী -পেশার মানুষ অংশগ্রহন করেন। ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশরাফুল কবীরের সভাপতিত্বে ও প্রাধিকারের সভাপতি মনজুর কাদের চৌধুরীর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট বিভাগীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম। সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকরামুল কবির, নারীমুক্তি সংসদের সভাপতি ইন্দ্রানী সেন, সারী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবদুল হাই আল-হাদী, সিলেট কল্যাণ সংস্থার সভাপতি এহছানুল হক, ছড়ামঞ্চ সিলেটের সভাপতি সিরাজ উদ্দিন প্রমুখ।
মন্তব্য করুন