লীলা নাগের ৪৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী
সালেহ এলাহী কুটি॥ ১১ জুন রোববার উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিকন্যা ও নারী জাগরণের পথিকৃত লীলা নাগের ৪৭ তম মৃত্যুবার্ষির্কী। তাঁর গ্রামের পৈত্রিক বাড়িটি জবর দখল করে নিয়েছে রাজনগর শান্তিকমিটির তৎকালীন প্রভাবশালী চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আলাউদ্দিন চৌধুরী। এলাকার মানুষের দাবি বাড়িটি উদ্ধার করে সেখানে লীলা নাগের স্মৃতি রক্ষার উদ্যেগ গ্রহন করার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিল্পবী নারী এবং বাংলা ভাষায় মহিলা সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা মাসিক জয়শ্রী পত্রিকার সম্পাদিকা লীলা নাগের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রামে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর লীলা নাগ ও অনিল রায় দম্পতি পূর্ববঙ্গে বসবাস করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তৎকালীন মুসলিমলীগ শাসকেরা তাঁদেরকে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করে। মূলত ওই সময়েই লীলা নাগ এর পৈত্রিক বাড়িটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এবং স্থানীয় রাজাকার আলাউদ্দিন চৌধুরী শত কোটি টাকার ১৭ একর ফসলি জমি ও বাড়িটি দখলে নিয়ে লীলা নাগের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলছে। এলাকার চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আলাউদ্দিন চৌধুরী বাড়িটি জবরদখল করে লীলা নাগের সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলে পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণ করে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে। বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঐতিহ্যবাহী এ বাড়িটি জবরদখল মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। বাড়িটি দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করে লীলা নাগের স্মৃতি রক্ষার্থে সংরক্ষণ করে এখানে একটি জাদুঘর গড়ে তোলার দাবি করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।
লীলা নাগ স্মৃতি পরিষদের সম্পাদক মো: তোফায়েল আহমদ বলেন, লীলা নাগের স্মৃতি বিজরিত রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রামের পৈত্রিক বাড়িটি উদ্ধারে লীলা নাগ স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে সরকারের ঊর্ধবতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ পূর্বক অসংখ্য আবেদন নিবেদন করেও কোন ফল পাওয়া যায়নি।
লীলা নাগের বাড়ির সামনের বৈঠকখানা, যেখানে বহু আন্দোলন-সংগ্রামের ভিত রচিত হয়েছে এ বৈঠকখানাটি আজ ও তার স্মৃতিবহন করে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলেও এ ঘরটি সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ঘরটির অনেক স্থান খসে পড়ছে। যে কোন সময় শেষ স্মৃতিচিহ্ন বৈঠকখানাটিও ভেঙ্গে যেতে পারে । আলাউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে ,লীলা নাগের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত কুঞ্জলতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল মুনিম চৌধুরী জানান, বাড়িটি তারা জবর দখল করেননি। বাড়িটি নিয়ে আদালতে মামলা হলে হাইকোর্ট খাজনা প্রদাণের আদেশ দিয়েছেন। জানা গেছে আলাউদ্দিন চৌধুরী বাড়িটি রক্ষায় মৌলভীবাজার জেলা জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন। সে মামলায় তিনি পরাজিত হলে উচ্চ আদালতে আপীল করেছেন। মামলাটি এখনো চলছে।
লীলা নাগের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বাড়ির বৈঠকখানাটি ঝরাঝির্ণ অবস্থায় এখনো টিকে আছে। তাও ময়লা-আবর্জনায় পরিপূণ বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঐতিহ্যবাহী এ বাড়িটি জবরদখল মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। প্রয়াত যুদ্ধাপরাধী আলাউদ্দিনের পরিবারের হাত থেকে বাড়িটি উদ্ধার ও সরকারের সংলিষ্ট মহলের তত্ত্বাবধানে লীলা নাগের স্মৃতি রক্ষার্থে সংরক্ষণ করে এখানে একটি জাদুঘর গড়ে তোলার দাবি করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী। রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম বলেন সঠিকভাবে লিজ প্রদান করা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি বাড়িটি যাতে সরকারের পর্যবেক্ষনে রাখা যায় এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করা হবে ।
এলাকাবাসি জানান,আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৬ মে গভীর রাতে পাক হানাদার বাহিনীকে দিয়ে সংখ্যালঘু নিরীহ গ্রামবাসিকে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। লোকজনকে ধরে স্থানীয় দীঘির পাড়ে ব্রাসফায়ার করে নারী শিশুসহ ৫৯ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে দীঘিতে লাশ ফেলে দেয়। পরে লাশ উদ্ধার করে দীঘির পশ্চিমপাড়ে গণকবর দেয়া হয়। আলাউদ্দিন চৌধুরী বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত শুরু করলে এসময় আলাউদ্দিন চৌধুরী গাঁ ঢাকা দেন। পরে পলাতক থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
মৌলভীবাজার জেলার ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ মুমিনুল হক সম্পাদিত একাধিক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, উপমহাদেশের প্রথম বাঙালী মহিলা সাংবাদিক লীলা নাগের জন্ম ১৯০০ সালের ২১ অক্টোবর ভারতের আসাম প্রদেশের গোয়ালপাড়া গ্রামে।
তাঁর পিতা গিরীশচন্দ্র্র নাগ আসাম সরকারের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেই সুবাধে চাকুরী সূত্রে লীলা নাগের পরিবার আসামের বাসিন্দা হয়। মা কুঞ্জলতা নাগ ছিলেন সুগৃহিনী। ১৯০৫ সালে আসামের দেওগর বিদ্যালয়ে লীলা নাগের শিক্ষা জীবনের শুরু সেখানে দুই বছর অধ্যায়নের পর ভর্তি হন কোলকাতার ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে।
১৯১১ সালে ঢাকার ইডেন হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৭ সালে ওই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ১৯১৬ সালে লীলা নাগের পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ চাকুরী হতে অবসর গ্রহনের পর স্থায়ীভাবে সপরিবারে বাংলাদেশে চলে আসেন।
তবে ১৯১৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর লীলা নাগ উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের জন্য কোলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। সে কলেজে সেরা ছাত্রী ছাড়াও ছবি আঁকা, গান ও বিভিন্ন খেলাধুলায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এ জন্য কলেজের সবার মধ্যমণি ছিলেন লীলা নাগ। কলেজের রি-ইউনিয়নের উদ্যোক্তা হিসেবে সিনিয়র স্টুডেন্ট নির্বাচিত হয়ে সবাইকে চমকে দেন।
কলেজে শিক্ষাকালীন সময়ে লীলা নাগ ‘লোকমান্য তিলক’ র মৃত্যু দিবস উপযাপনকে কেন্দ্র করে কলেজ অধ্যক্ষর সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন এবং ছাত্র-ধর্মঘটের ডাক দেন। এছাড়া ‘বড়লাট’ কে নতজানু হয়ে অভিবাদন জানানোর প্রথা বাতিলের আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯২১ সালে লীলা নাগ মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এ পাশ করেন এবং পদ্মাবতী স্বর্ণপদকে ভূষিত হন।
ঐ বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেন। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষা অর্থাৎ সহ শিক্ষা চালু ছিলো না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. রবার্ট হার্টস লীলা নাগের মেধার প্রতি শুদ্ধা রেখে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী (মহিলা) হিসেবে ইংরেজী বিষয়ে মাষ্টার্স শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাবস্থায় লীলা নাগ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্লা চন্দ্র ও ঋষি রামানন্দের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯২৩ সালে লীলা নাগ ইংরেজী বিষয়ে দ্বিতীয় বিভাগে মাষ্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। লীলা নাগসহ তার অনেক বান্ধবী-সহপাঠী গোপন বিল্পবী দলের সদস্য ছিলেন।
১৯২৩ সালে লীলা নাগ আবহমান বাংলার নারী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের এনা রায়, সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অপূর্ব চন্দ্র দত্তের মেয়ে বীণা দত্ত ও সরোজ বসু, ব্যারিষ্ট্রার পি.কে বসুর মেয়ে কমলা বসু, তার বোন মনোরমা বসু, ব্রাহ্ম সমাজের ডাঃ নেপাল রায়ের মেয়ে লতিকা রায়, তার বোন লীলা রায়সহ ১২ জনকে নিয়ে গঠন করেন ‘দীপালি সংঘ’। এ সংগঠনের প্রচেষ্টায় নারী শিক্ষা মন্দিরসহ ১২টি অবৈতনিক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন। নারীদের স্বউপার্জিত করতে কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় দীপালি সংঘের উদ্যোগে।
নারীদের শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে লীলা নাগ প্রতিষ্ঠা করেন রাজধানীর আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয়, শেরেবাংলা মহাবিদ্যালয় এবং কামরুন্নেছা গার্লস হাইস্কুল। ১৯২৬ সালে লীলা নাগ ভারতের কোলকাতায় চলে যান। সেখানেও তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৯২৮ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কোলকাতা কংগ্রেস এবং বাংলার বিল্পবী দলগুলো একত্রিত হয়। সেখানে বিল্পবী লীলা নাগ ও অনিল রায় অংশ নেন। পরবর্তীতে লীলা নাগ আন্দোলন-সংগ্রামের সহযাত্রী অনিল রায়কে বিয়ে করে জীবনসঙ্গী করে নেন। লীলা নাগ বিপ্লবী আন্দোলনে এক বছরের মধ্যে প্রথম সারির নেত্রী হিসেবে আর্ভিভূত হন।
১৯২৭-২৮ সালে সমাজের অবহেলিত নারীদের আশ্রয় ও সাহায্যার্থে মহিলাদের আত্মরক্ষামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থার জন্য ‘নারী আত্মরক্ষা ফান্ড’ খোলেন। ১৯৩০ সালের জানুয়ারি মাসে লীলা নাগের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘মাসিক জয়শ্রী’ পত্রিকা। কবিগুরু ছাড়াও জয়শ্রীতে অভিনন্দনপত্র পাঠান পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বিজয়লক্ষী পন্ডিত, হাজরা বেগম, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ। ঐ বছরই লীলা নাগ ও আশালতা সেন এর নেতৃত্বে ঢাকার নারীরা লবন সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন।
এ অন্দোলনে লীলা নাগ মুল সংগ্রামের দায়িত্বে ছিলেন। ঐ বছরের ১৮ এপ্রিল মাষ্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাঘার দখল করেন। এরপর ইংরেজ সরকার বিপ্লবী দলের নেতৃস্থানীয়দের গ্রেফতার শুরু করে। শ্রীসংঘের অনিল রায়ও কারাবরণ করেন। ফলে শ্রীসংঘের সর্বময় দায়িত্ব গ্রহণ করেন লীলা নাগ। সূর্যসেনের পরামর্শে এ সময় অবিভক্ত ভারতের প্রথম নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা লীলা নাগের কাছে বিপ্লবীরা জীবনের পাঠ বা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লীলা নাগ কারান্তরীন ছিলেন। ১৯৩১ সালে ঢাকার গুলিবর্ষণের অভিযোগে ৩৩টি বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায়। এসময় লীলা নাগের বাড়ি আগুনে ভষ্মিভূত করা হয়। ঐ বছরের এপ্রিলে বিপ্লবীদের গুলিতে তিন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেড, আলিপুরের জেলা জজ ও কুমিল্লার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেড নিহত হন।
এ ঘটনায় ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর লীলা নাগকে গ্রেফতার করা হয়। লীলা নাগ ভারতবর্ষে বিনা বিচারে আটক প্রথম নারী রাজবন্দী। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার লীলা নাগের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক জয়শ্রী প্রকাশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। ১৯৩৭ সালের ৮ অক্টোবর কারামুক্তির পূর্ব পর্যন্ত লীলা নাগকে ঢাকা, রাজশাহী, সিউরী, মেদেনীপুর ও হিজলী জেলে বন্দী রাখা হয়।
কারামুক্তির পর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি দীর্ঘ পত্র লিখেন লীলা নাগকে। ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে পুনরায় মাসিক জয়শ্রী প্রকাশিত হয়। ‘জয়শ্রী’ পুনঃপ্রকাশিত হলে কবিগুরু একটি আশীর্বাদপত্র প্রেরণ করেন। ঐ বছরের ৩ আগষ্ট অনিল রায় কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর অনিল রায় ও লীলা নাগের শ্রীসংঘ রাজনৈতিক দলে রূপান্তরীত হয়। তাঁরা কংগ্রেসে যোগ দেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ট সহকর্মীরূপে তারা আর্ভিভূত হন।
এসময় ঢাকায় ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ (বর্তমান শেরেবাংলা স্কুল ও কলেজ) শিক্ষাভবন পূণঃগঠিত হয়। অনিল রায়ের মায়ের বাড়ি মানিকগঞ্জের রায়রা গ্রামে স্থাপন করা হয় একটি হাই স্কুল। যা শুধুমাধ্য মুসলিম সম্প্রদায়ের কৃষকদের সন্তানদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল।
১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে জলপাইগুড়িতে অনুষ্ঠিত ত্রিপুরা কংগ্রেসের জাতীয় দাবী সম্পর্কিত ‘চরমপত্র’ উপস্থাপন করেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তা সমর্থন করেন লীলা নাগ। ঐ বছরের ১৩ মে ৩৯ বছর বয়সে দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামের সহকর্মী ও সহযোদ্ধা অনিল রায়কে বিয়ে করেন লীলা নাগ।
বিয়ের পর লীলা নাগের নাম হয় প্রথানুসারে লীলা রায়। ঐ মাসেই অনিল রায় ও লীলা রায় (লীলা নাগ) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগদান করেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে সাথে নিয়ে ঢাকা, মানিকগঞ্জ সফর করেন তারা। ১৯৪০ সালের ২৭ জুন ফরোয়ার্ড ব্লকের সম্মেলনে মূল প্রস্তাব উপস্থাপন করেন লীলা রায়।
প্রস্তাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘোষণা ছিল। এর কয়েকদিন পর ঐ বছরের ২ জুলাই হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারন আন্দোলনে জড়িত অপরাধে পুলিশ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে, ৯ জুলাই অনিল রায়কে এবং ১০ জুলাই লীলা রায়কে গ্রেফতার করে। দেড় মাসের অধিককাল কারাবন্দী থাকার পর ২৯ আগষ্ট অনিল রায় ও লীলা রায় দম্পতি মুক্তিলাভ করেন। ঐ বছর সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন লীলা রায়।
১৯৪১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন শরৎচন্দ্র বসু। তাঁর গ্রেফতারে তীব্র নিন্দা জানিয়ে হাজরা পার্কে জনসভায় বক্তব্য রাখেন লীলা রায় ও অনিল রায়। এ অপরাধে তাদের পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর কারাভোগের পর ১৯৪৬ সালের জুন মাসে তারা কারামুক্তি লাভ করেন।
ঐ বছর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গাকালে উভয় সম্প্রদায়ের বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার ও নিরাপত্তা বিধানে নামেন লীলা রায় ও অনিল রায়। তারা হাজার হাজার মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপত্তা প্রদান করেন। ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে নোয়াখালির দাঙ্গার পর সেখানকার রামগঞ্জে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস ইনষ্টিটিউট’ খুলে ১৭টি ক্যাম্পের মাধ্যমে দীর্ঘদিন সেবা ও সহায়তা প্রদান করেন লীলা রায়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর লীলা নাগ (লীলা রায়) ও অনিল রায় দম্পতি পূর্ববঙ্গে বসবাস করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তৎকালীন মুসলিমলীগ শাসকেরা লীলা রায় ও অনিল রায়কে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করে। মূলত ওই সময়েই লীলা রায় (লীলা নাগ) এর মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও-এ অবস্থিত পৈত্রিক বাড়িটি মূলত পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
১৯৫১ সালে তৎকালীন ভারত সরকার উদ্বাস্তুু উচ্ছেদের বিল আনেন। এ বিলের প্রতিবাদ করায় গ্রেফতার হন লীলা রায় (লীলা নাগ)। ১৯৫২ সালে লীলা রায়ের স্বামী অনিল রায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিয়ের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় অকাল বৈধব্য এবং দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের সাথী স্বামী অনিল রায়কে হারিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েন লীলা রায়।
অল্পদিনের মধ্যে গভীর শোককে কাটিয়ে ওঠে তিনি সমাজ বিপ্লবেব সংগ্রামকে বেগবান করার কাজ শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে লীলা রায় জয়প্রকাশ নারায়নের সমাজবাদী শিবিরে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ মার্চ ‘পূর্ববাংলা বাঁচাও কমিটি’র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার অপরাধে পুলিশ লীলা রায়কে গ্রেফতার করে।
১৯৬৬ সালে মুক্তিলাভের পর তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। ১৯৬৮ সালের ৪ ফেরুয়ারি সকালে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাঁকে কোলকাতার পি.পি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৩ দিন পর সংজ্ঞা ফিরে এলেও বন্ধ হয়ে যায় তাঁর বাকশক্তি। শরীরের ডান অংশ সম্পূর্ণভাবে অচল হয়ে যায়।এ অবস্থায় আড়াই বছর চলার পর ১৯৭০ সালের ১১ জুন ভারতে উপমহাদেশের মহীয়সী নারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী, বাংলা ভাষায় মহিলা সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা মাসিক জয়শ্রী সম্পাদিকা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা বিপ্লবী লীলা নাগ ওরফে লীলা রায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
নায়িকা সুচিত্রা সেনের পাবনার বাড়ি দখলমুক্ত হওয়ার পর লীলা নাগের বাড়িটি দখলমুক্ত করার দাবি তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে রহস্যজনক কারণে নীরব রয়েছে প্রশাসন। এতে জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
মন্তব্য করুন