লেখক হতে হলে বর্ণচুরী ছাড়তে হবে!
এহসান বিন মুজাহির॥ কপি-পেস্টের এখন স্বর্ণযুগ চলছে। প্রবন্ধ-নিবন্ধ-ফিচার, কলাম থেকে শুরু করে এমনকি ফেসবুকের স্ট্যাটাস-কমেন্টও কপি-পেস্ট হচ্ছে। কার আগে কে কপি করে সংবাদ পোর্টালে পাবলিশ করবে এনিয়েও চলছে প্রতিযোগিতা। আজকের সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে কপি পেস্ট ও আনুষাঙ্গিক প্রসঙ্গে আলোকপাত করবো। ভূমিকা না টেনে মুল কথায় চলে আসি। কলাম-নিবন্ধ, কিম্বা নিউজ বা স্ট্যাটাসই বলেন, লেখালেখি কিন্তু সহজ বিষয় না। আবার খুব কঠিনও না। যেকোনো বিষয়ে লেখতে হলে আগে প্রচুর পড়তে হয়, পরে লেখতে হয়। পাঠক না হয়ে লেখক হওয়া যায় না। একজন লেখক অনেক কষ্ট, পরিশ্রম, সময়ের বিনিমিয়ে একটি কলাম লেখেন। ছাপা হয় বিভিন্ন প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ায় কিন্তু কিছু অসাধু লেখক আছেন যারা পড়তেও নারাজ, লেখতেও নারাজ। কপি চাই কপি! কপিবাজ লেখকরা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সাহিত্যের মানে উত্তীর্ণ লেখাগুলোকে হুবহু কপিপেস্ট করে শিরোনাম ও মুল লেখকের নাম পরিবর্তন করে তাদের নামে চালিয়ে যাওয়ার অপপ্রয়াসে লিপ্ত আছে। অনেক পত্রিকায় তাদের নামে লেখা ছাপাও হচ্ছে! এতে তারা তৃপ্ত, লেখক হিসেবে ছাপার অক্ষওে তাদের নাম প্রকাশিত হচ্ছে এটাই তাদের কাছে অনেক বড়! লেখক হওয়ার স্বপ্ন তাদের পূরণ হচ্ছে! কিন্তু এতে করে যে তাদের মেধা-প্রতিভা বিনষ্ট হচ্ছে এবিষয়ে তাদেরকোনো মাথাব্যথা নেই! অনেক সময় দেখা গেছে যে, কপিপেস্ট লেখদের কারণে মুূল লেখক বিড়ম্বার শিকার হচ্ছেন পাঠকমহলে। একই লেখা যখন দু’জন লেখক দাবি করেন তখন পাঠক-সম্পাদকও বিব্রতবোধ করেন। দৃষ্টিকটু লাগে লেখক-পাঠক-সম্পাদকদের কাছেও! অমিসহ আমার পরিচিত অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকও এমন বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন অনেকবার! অনলাইনপোর্টালে অহরহ এমন ঘটনা ঘটেছে;এমনকি জাতীয় দৈনিকেও ঘটে! বিষয়টি খুব দু:খজনক ও চরম নিন্দিতি। সম্প্রতি একটি অনলাইনপোর্টালে এমন ঘটনা ঘটেছে। পাঠকসমম্মুখে ঘটনাটি উপস্থাপনের প্রয়াস করছি। ১২ এপ্রিল অনলাইনপোর্টাল সিলেটের আলাপ ও বৈশাখী নিউজ টুয়েন্টিফোর-ডটকমে মাওলানা আব্দুর রহমান নামের জনৈক লেখক ইসলামের দৃষ্টিতে পহেলা বৈশাখ শিরোনামে একটি আর্টিকেল লেখেন। যে আটিকেলটির মুল লেখক আমি। আমার এ আর্টিকেল ঢকা থেকে প্রকাশিত মাসিক আন নাবা ২০১২ সালের এপ্রিল সংখ্যায় ( ২১ নাম্বার পৃস্টা) পয়লা বৈশাখ: অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবল শিরোনামে ছাপা হয়েছে। এমনকি আন নাবার প্রচ্ছদেও আমার লেখার শিরোনাম ছিলো। ২০১৩ সালে ও এপ্রিলে চট্রগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসার মাসিক মুখপত্র মাসিক মুঈনুল ইসলামে (৪১ নাম্বার পৃস্টায়) বর্ষবরণ সংস্কৃতি: ইসলামী দৃষ্টিকোণ শিরোনামে আমার এলেখাটি প্রকাশিত হয়। এমনকি মুঈনুল ইসলামের প্রচ্ছদেও আমার লেখার শিরোনাম ছিলো। ২০১৫ সালের ১৭ এপ্রিল, শুক্রবার, ৪ বৈশাখ, ১৪২২, দৈনিক জনতার সম্পাদকীয় পাতায় পহেলা বৈশাখ এবং ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমার এলেখাটি প্রকাশিত হয়। এছাড়া অনলাইনপোর্টাল ইসলামিক নিউজ ২৪ ডটনেটে ২০১৪ সালের ৮ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি শিরোনামে আমার লেখাটি প্রকাশিত হয়।কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, আমার লেখা হুবহু কপি পেস্ট করে শুধু শিরোনাম পরিবর্তন করে ৯ এপ্রিল আব্দুর রহমান নামের একটি ফেসবুক পেইজ এবং সিলেটের দুটি অনলাইন পোর্টাল সিলেটের আলাপ ও বৈশাখী নিউজ টুয়েন্টিফোর-ডটকমে যখন দেখতে পেলাম। তখনই বিব্রতবোধ করলাম। পাঠকরাও বিব্রতবোধ করলেন। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট সম্পাদকদের মুঠোফোন এবং ইমেইলে যোগাযোগ করে আমার লেখার দাবির পক্ষে প্রকাশিত প্রিন্টমিডিয়া এবং অনলাইন পোর্টালগুলোর লিঙ্ক, তথ্য-প্রমাণ স্ক্রিনশর্ট দিলাম। আব্দুর রহমান নামের কোনো লেখক সিলেটে আছেন বলে সিলেটের প্রতিষ্ঠিত লেখক-সাংবাদিক, কলামিস্টদেরও জানা নেই। অনেকের সাথে আমি যোগাযোগ করলাম, তার সর্ম্পকে জানার চেষ্ঠা করলাম কিন্তু ব্যর্থ হলাম। এমনকি গুগলেও এই লেখকের দ্বিত্বীয় কোনো আর্টিকেল খুঁজে পেলাম না! এশ্রেণীর লেখকরাই মুল লেখকদের বিড়ম্বনায় ফেলে! ওরাই ভালো মানুষের দোষচর্চা ও অপ্রপ্রচাওে লিপ্ত থাকে! কপি-পেস্ট আর অপ্রপ্রচার করাই যেন তাদেও রুটিন ওয়ার্ক!এই বললাম আনলাইন বিড়ম্বনার কথা। প্রিন্টমিডিয়ায় যে হয় না এমন না। প্রিন্টমিডিয়ারএকটি উদহারণ দিয়ে সামনে আগাবো। ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪। দৈনিক ইনকিলাবের মুক্তাঙ্গন পাতায় এনার্জি ড্রিংকস শিরোনামে আমার কলাম ছাপা হয়। ওইদিনের পত্রিকাটি হাতে নিয়ে মুক্তাঙ্গন পাতায় চোখ বুলাতে গিয়েই হঠাৎ দৃষ্টিনিবন্ধ হলো মাদক প্রতিরোধে ইসলাম শিরোনামের কলামের দিকে। প্রবন্ধের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলাম মনযোগসহকারে। নির্বাক হয়ে গেলাম কলামটি পড়ে! একটি শব্দেরও কোনো পরিবর্তন নেই লেখকের নাম ব্যতিত! মাদক প্রতিরোধে ইসলাম শিরোনামে আমার এ কলামটি অনলাইনপোর্টাল ইসলামিক নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট নেট ও ক্রাইম রিপোর্ট টুয়েন্টি ফোর ডটকমে প্রকাশিত হয়েছিে ২৩ আগস্ট শনিবার ২০১৪। ২৩ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইনকিলাবে আমার হুবহু লেখা অন্য লেখকের নামে ছাপা হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলাম ইনকিলাব সহকারী সম্পাদক একেএম ফজলুর রহমানের কাছে। তিনি দরদী কন্ঠে আমাকে বলেন, দোস্ত, বিষয়টি খুব দু:খজনক! আমরা অনেক চেষ্ঠা কওে যাচ্ছি কপিবাজ লেখদের রুখতে। এতা যাচাই বাছাই করার পরও ওদেরকে রুখতে পারছি না। মন খারাপের কিছুই নেই। আমি অফিসে যাচ্ছি। বিষয়টি আমি সংশোধন করে দেবো। আর আগামিতে ওই কপিপেস্ট লেখকের লেখা ছাপা হবে না কোনদিন। আপনি নিয়মিত রেখছেন সব দৈনিকে। ইনকিলাবে নিয়মি লিখবেন এপ্রত্যাশা আমাদের। শুধু যে আমার লেখাই যে কপি হয় বিষয়টি এমন না! এমন অভিযোগ অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকেরও। এমুহুর্তে যাদের নাম স্মরণ হচ্ছে তন্মধ্যে বিশিষ্ট লেখক শেখ উসমান গনি। যিনি দৈনিক প্রথম আলো, আলোকিত বাংলাদেশে লিখেন নিয়মিত। তিনি বলেন, এহসান ভাই, আপনার লেখা যেভাবে কপি হয়ে অন্যের লেখকের নামে ছাপা হয় সেভাবে আমার লেখাও কপি হয়ে ্অন্য লেখকের নামে ছাপা হয়। তিনি বলেন, আপনার লেখা যেভাবে দৈনিক ইনকিলাবে অন্য লেখকের নামে ছাপা হয়েছিলো বছর। আমার লেখাও দৈনিক ইনকিলাবে মনজুর হোসেন খান নামের একজন লেখকের নামে ছাপা হয়েছিলো। এমন অভিযোগ লেখক বন্ধু, টিভি আলোচক খতিব যুবায়ের আহমদ ভাইয়ের। তিনি বলেন এহসান ভাই গত দুইমাস আগে আমার লেখা মনজুর হোসেন খান নামের সিলেটের এক লেখকের নামে প্রকাশিত হয় ইনকিলাবে। তিনি হুবহু আমার লেখা কপি করে শিরোনাম পাল্টিয়ে পত্রিকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। পত্রিকাওয়ালারাও ছাপিয়েছে! একই অভিযোগ করেন লেখকবন্ধু মিযানুর রহমান জামিল ভাই। তিনি বলেন আমার একটি লেখা হুবহু কপি করে শিরোনাম পাল্টিয়ে অন্য এক লেখকের দৈনিক ইনকিলাবে ছাপা হয়! আসলেই এখন কপি-পেস্টের স্বর্ণযুগ চলছে। তাই করার কিছু নেই! কপিপেস্ট লেখকদের কারণেই মূল লেখকগণ বিব্রত হন। কপিবাজ লেখকদের কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। বরং এশ্রেণীর লেখকদের দৌরাত্ম দিনে দিনে বেড়েই চলছে। কপিপেস্ট করে সাময়িক সময়ের জন্য নিজেকে লেখক পরিচয় দেয়া গেলেও লেখালেখির অঙ্গনে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। যোগ্যতা অর্জন হয় না এবং প্রতিভাও বিকাশ হয় না। একবার দুইবার এভাবে তিনবারের সময় বর্ণচোররা সম্পাদক ও মুল লেখকদের চোখে ধরা পড়ে যায়! তখন অসত্যের আশ্রয় আর নত হওয়া ছাড়া তাদের কিছু করার থাকে না। ইজ্জতও যায়, প্রতিভাও বিনাশ হয়! লেখা আল্লাহর দান। আল্লাহ তায়ালা সকলকে সব বিষয়ে লেখার যোগ্যতা দান করেননি। এই কারণেই সবাই সব বিষয়ে লিখতে অপারগ। আল্লাহ তায়ালা কাউকে কাব্যপ্রতিভা দিয়েছেন, আবার কাউকে সাহিত্যপ্রতিভা দিয়েছেন। কেউ গল্প লিখতে পাওে, কেউ উপন্যাস, কেউ গবেষণাধর্মী লেখা, কেউ বর্ণনাধর্মী লেখা লেখতে পারদর্শী। সবাই কিন্তু লেখক না। কেউ কেউ লেখক। পাঠক ছাড়া লেখক হওয়া যায় না! দুনিয়াতে বড় লেখক হয়ে কেউ জন্ম নেয় না। আবার কেই হঠাৎ করেই বড় লেখক হয়ে যেতে পারে না। কেউ কেউ ভালো লেখক, কিন্তু ভালো বক্তা না। কেউ কেউ ভালো বক্ত,া তবে লেখক না। আল্লাহ সকলকে লেখার যোগ্যতা দান করেননি। এমন অনেক শিক্ষাবিদ আছেন, যাদের লেখা বই পড়ে অন্যরা ভালো বক্তব্য দিতে পারেন। কিন্তু তিনি কারো সামনে দুইয়েক মিনিটও কথা বলতে পাওে না। কারো সামনে বক্ত্য দিতে দাঁড়ালে বলার মতো শব্দ খুঁজে পান না। তবে বিপরীত এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা চমৎকার বক্তব্য দিতে পারেন, কিন্তু দ’ুএক কলম লেখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। এভাবে আল্রাহ তায়ালা একেকজনকে একক ধরণের প্রতিভা দান করেছেন। শুধু কপিপেস্ট করলেই লেখক হওয়া যায় না। যদি বর্ণচুরী করে লেখক হওয়া সহজ হতো তাহলে পৃথিবীতে লেখকের সংখ্যা গণনা করা দরূহ ব্যাপার হতো! লেখার কিছুটা যোগ্যতা যাদের আছে তাদের লেখাকে অভ্যাসে পরিণত করলে ভালো ফলাফল আশা করা যায়। লেখালেখি করাটা সামাজিক দায়বদ্ধতারই একটি অংশ তাই একজন লেখক তাঁর সাহিত্য কর্মকে কেবল মনীষার বাহনরূপে নয়, ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্বের প্রকাশ মাধ্যম রূপে, সমাজ চৈতন্যের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতিমা রূপে দেখতে হবে। লেখককে অনস্বীকার্যভাবে কুসংস্কার, ভীরুতা, জরাজীর্ণতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সত্য ও সুন্দরের আরাধনা করতে হবে, বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যায় নিমগ্ন হতে হবে।
নিয়মিত লেখালেখির অভ্যাস থাকলে সময়ের ব্যবধানে লেখক হওয়া যাবে। তবে হুবহু কোনো বই বা লেখা কপিপেস্ট করার অভ্যাস থাকলে আজীবন লেখলেও লেখক হওয়া যাবে না। লেখালেখির রাজপথে সবাই সফলতা অর্জন করতে পারে না। একমাত্র তারাই পারে যাদের রয়েছে প্রশস্ত মন, সৎ সাহস ও অসীম ধর্য। সাহিত্যযুদ্ধে সাফল্য অর্জনে প্রয়োজন সাধনা, নিরন্তর প্রচেষ্ঠা, অক্লান্ত পরিশ্রম, তীব্র ইচ্ছা, অদম্য স্পৃহা, প্রশস্ত মন ও অসীম ধর্যশক্তির।
শেষ কথা, লেখক হতে হলে প্রচুর পড়তে হবে। সাধনা করতে হবে। অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে এবং কপিপেস্ট বর্জন করতে হবে। আল্লাহপাক আমাদেরকে আদর্শ লেখক-সাহিত্যিক হিসেবে কবুল করুন।
লেখক: নির্বাহী সভাপতি সৃজনঘর সাহিত্য ফোরাম, মৌলভীবাজার
মন্তব্য করুন