শতভাগ উপবৃত্তি প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ

January 22, 2018,

মোহাম্মদ আলী॥ শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আর শিক্ষার মেরুদন্ড বা ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। তাই যে দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি যত মজবুত সে দেশ তত উন্নত। বিশেষ করে আধুনিক যুগে মানসম্মত শিক্ষা সারা বিশ্বে আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় গত এক দশকে পরিসংখ্যানগত বা আন্তর্ভূক্তিমূলক দিক থেকে প্রভূত সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তদুপরি মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা এখনো রয়েছে নাগালের বাইরে। তাই সরকার এসডিজি বাস্তবায়নে মানসম্মত প্রাথমিক নিশ্চিতকল্পে নানামূখী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণে বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প থেকে দেশব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিকৃত সকল ছাত্র-ছাত্রীর মায়েদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে এক ইতিবাচক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ১ মার্চ ২০১৭ সন থেকে মোবাইলের মাধ্যমে উপবৃত্তির অর্থ পরিশোধের এ মহাকর্মযজ্ঞ শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

মূলত “প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প” সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহে ভর্তিকৃত সকল ছাত্র/ছাত্রীর মায়েদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের এক ইতিবাচক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিশেষ করে বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন “প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প (৩য় পর্যায়)” পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনসহ দেশের সকল এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মায়েদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হার বৃদ্ধি, উপস্থিতি বৃদ্ধি, ঝরে পড়ার হার রোধ, শিক্ষাচক্রের সফল সমাপ্তির হার বৃদ্ধি, পুনরাবৃত্তির হার হ্রাসকরণ, শিশু শ্রম রোধ, দারিদ্র বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার এবং প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

এতদিন পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকা উপবৃত্তি কমূসূচির বাইরে ছিল। অথচ পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দরিদ্র পরিবার ও বস্তিবাসীদের সন্তানরাই লেখাপড়া করে। আর উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সন্তানেরা পড়ে কিন্ডারগার্টেন বা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। তাই পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু করার দাবী ছিল দীর্ঘদিনের। বর্তমান অর্থ বছর থেকে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকাকে উপবৃত্তি প্রকল্পের আওতাভূক্ত করায় গোটা দেশে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পথ সুগম হয়েছে।

২০০২ সাল থেকে চালু হওয়া উপবৃত্তি কর্মসূচি বাস্তবায়নে, সুবিধাভোগী নির্বাচন ও অর্থ বিতরণসহ নানান ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা যেমন বিরাজমান ছিল তেমনি উপবৃত্তির টাকা আত্মসাতের মত ঘটনা ও ঘটত। কাজেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে উপবৃত্তির অর্থ বিতরণের মহান উদ্যোগ বিদ্যমান সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে। এতে সরকারি অর্থ অপচয়ের পথ বন্ধ হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে দেশে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণে উপবৃত্তি কর্মসূচি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথে কিছু সমস্যাও বিদ্যমান রয়েছে। বিশেষ করে দরিদ্র মায়েদের সকলের মোবাইল ফোন না থাকায় সকলের নিকট মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করা যাচ্ছে না। কাজেই এ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে মায়েদের মোবাইল ফোনে সরবরাহ করা প্রয়োজন। আবার বর্তমানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠান “শিওর ক্যাশ” এর মাধ্যমে উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী এ সংস্থার এজেন্সী মাঠ পর্যায়ে কম থাকায় অভিভাবকগণ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত উপবৃত্তির অর্থ নগদায়নে সমস্যায় পড়ছেন। এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন বলে অভিভাবকগণ মনে করেন। তাছাড়া মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে মায়েদের উপবৃত্তি কর্মসূচির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বছরে অন্তত একবার স্কুল ড্রেস, ব্যাগ ও উপকরণ প্রদানের কর্মসূচি চালু করা অত্যাবশ্যক বলে শিক্ষাবিদগণ মনে করেন। 

২০ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের স্মারক নং- ৩৮.০০.০০০০.০০৯. ১৪.০১৫.১৬.২১৬ এর মাধ্যমে জারি করা পরিপত্রের ৬নং দফায় উপবৃত্তির মাসিক হার সংক্রান্ত ৬.১ এ বলা হয়েছে যে এই প্রকল্পের আওতায় সুবিধাভোগী পরিবারের এক সন্তান অধ্যয়নরত থাকলে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির জন্য ৫০/- (পঞ্চাশ) টাকা এবং অন্য শ্রেণির হলে মাসিক ১০০/- (একশত) টাকা, দুই সন্তান বিশিষ্ট পরিবারকে মাসিক ২০০/- (দুইশত) টাকা, তিন সন্তান বিশিষ্ট পরিবারকে মাসিক ২৫০/- (দুইশত পঞ্চাশ) টাকা, চার সন্তান বিশিষ্ট পরিবারকে মাসিক ৩০০/- (তিনশত) টাকা হারে উপবৃত্তি প্রদান করা হবে। উপবৃত্তির মাসিক হারের এ নীতিমালা সরকারি জাতীয় জনসংখ্যা নীতির পরিপন্থী। জনসংখ্যা নীতির সাথে সঙ্গতি রেখে সরকার প্রজাতন্ত্রে কর্মরত মহিলাদের সর্বোচ্চ ২ সন্তানের জন্য ৬ মাস করে মাতৃত্ব ছুটি প্রদান করে থাকেন। আবার সর্বোচ্চ ২ সন্তানের জন্য বর্তমানে ১০০০/- (এক হাজার) টাকা হারে মাসিক শিক্ষা সহায়ক ভাতা প্রদান করা হয়। কাজেই ২ সন্তানের অধিক সন্তান গ্রহণে মায়েদের নিরুৎসাহিত করণে ২ এর অধিক সন্তানদের জন্য পূর্বের ন্যায় তথা এক সন্তান বিশিষ্ট পরিবারের জন্য ১০০/- (একশত) টাকা এবং ২ বা তার অধিক সন্তান বিশিষ্ট পরিবারের জন্য ২০০/- (দুইশত) হারের মাসিক উপবৃত্তির টাকা নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।

কিছু সীমাবদ্ধতা থাকার পরও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সকল শিশুদের মায়েদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পরিশোধের ইতিবাচক সিন্ধান্তের ফলে প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক চিত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভর্তি ও উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে উপবৃত্তি কর্মসূচি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এতে কারো দ্বিমত নেই।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com