শনিবার কমলগঞ্জে মণিপুরী মহারাসলীলা ৩ দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন

November 2, 2017,

প্রণীত রঞ্জন দেবনাথ॥ “দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ” বৃহত্তর সিলেটের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্যতম বিশ্বনন্দিত সাংস্কৃতিক ধারক মণিপুরী সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব “মহারাসলীলা” ৪ নভেম্বর শনিবার অনুষ্ঠিত হবে। এবারে মনিপুরী মহারাসলীলা উৎসব ১৭৫তম। ১৭৫ তম বর্ষপুর্তিতে তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
২ নভেম্বর বৃহষ্পতিবার মৌলভীবাজার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সকাল ১০টায় আনন্দ র‌্যালী মধ্য দিয়ে তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম ও বিকালে কমলগঞ্জের মাধবপুর শিববাজারে উন্মুক্ত মঞ্চে হোলি উৎসব অনুষ্টিত হচ্ছে।  মুল অনুষ্ঠান মহারাসলীলা ৪ নভেম্বর শনিবার অনুষ্টিত হবে। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মণিপুরী সম্প্রদায়ের মাঝে বিরাজ করছে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। অপর দিকে আদমপুর ইউনিয়নের তেতইগাঁও সানাঠাকুর মন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মৈ-তৈ সম্প্রদায়ের আয়োজনে এবার ৩২ তম রাসোৎসব পালিত হবে। উৎসব উপলক্ষ্যে উভয় স্থানে বসবে বিরাট মেলা। নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আয়োজন দুই জায়গাতে হলেও বার্তা একই বিশ্বশান্তি, সম্প্রীতি ও মানবপ্রেম। রাসোৎসবকে কেন্দ্র করে কমলগঞ্জের মণিপুরী অধ্যুষিত গ্রামগুলোর ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ চলছে। পাড়ায় পাড়ায় গত কয়েক দিন ধরে চলে রাসনৃত্য ও রাখালনৃত্যের মহড়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। কমলগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী মহারাসলীলাকে কেন্দ্র করে গোটা কমলগঞ্জ উপজেলা উৎসবে পরিণত হয়। বিভিন্ন শ্রেনি ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ সমবেত হন। তাদের পদচারণায় দিনরাত অপূর্ব এক মিলনমেলায় পরিণত হয় মাধবপুরের জোড়ামন্ডপ প্রাঙ্গণ এবং আদমপুর সানাঠাকুর মন্ডপ।

আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র মণিপুরে প্রথম এই রাসমেলা প্রবর্তন করেন। আর মণিপুরের বাইরে ১৮৪২ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়ামন্ডপে রু হয় রাসমেলা; যা এখনো চলছে। এটি এই অঞ্চলের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। ‘রাস’ শব্দটা এসেছে শ্রীকৃষ্ণের ১২ ধরনের রস থেকে। তবে ১২টি রসের মধ্যে রাসলীলায় সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর এই তিনটি রসের উপস্থাপনই হয়ে থাকে। রাস উৎসব সফল করতে প্রায় মাস খানেক ধরে পাড়ায় পাড়ায় রাসনৃত্য এবং রাখালনৃত্যের প্রশিক্ষণ ও মহড়া চলে। মাধবপুরে তিনটি জোড়ামন্ডপের আওতায় এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। মন্ডপের পুরোহিতের পরামর্শে একজন প্রশিক্ষক ধর্মীয় বিধিবিধানমতো গোপী বা শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। প্রশিক্ষক শিল্পীদের ঠিক করেন। এরপর সামাজিক বিধানমতো শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণের বাইরেও কেউ চাইলে রাসনৃত্যে অংশ নিতে পারেন। এই গোপীদের বয়স ১৬ থেকে ২০ বা ২২ বছর। শুধু রাধার বয়স ৫ থেকে ৬ বছর। নৃত্যের প্রতিটি দলে ন্যূনতম ১২ জন অংশ নিয়ে থাকে। একইভাবে রাখালনৃত্যেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তিনটি অংশে চলে এই রাখালনৃত্য। প্রতিটি দলে ২০ থেকে ২২ জন ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী বালক অংশ নিয়ে থাকে। এই পুরো বিষয়টি সমন্বয় করে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবাসংঘ। মাধবপুরেই বড় অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে। এ বছর মাধবপুরে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মো: আব্দুস শহীদ এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ তোফায়েল ইসলাম, জেলা পরিষদ প্রশাসক মোঃ আজিজুর রহমান, পুলিশ সুপার শাহজালাল, কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সদস্য অধ্যাপক মোঃ রফিকুর রহমান, কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মাহমুদুল হক, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এম, মোসাদ্দেক আহমেদ মানিক, মণিপুরী সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি প্রতাপ চন্দ্র সিংহ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন মণিপুরী মহারাসলীলা সেবাসংঘের সভাপতি প্রকৌশলী যোগেশ্বর সিংহ। আয়োজকেরা জানিয়েছেন, বেলা ১১টা থেকে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য’ দিয়ে শুরু হবে মূল উপস্থাপনা। গোষ্ঠলীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালকবেলাকে তুলে ধরা হবে। গোধূলি পর্যন্ত চলবে রাখালনৃত্য।
রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রীশ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা অনুসরণ; চলবে ভোর (ব্রাহ্ম মুহূর্ত) পর্যন্ত। এই রাসনৃত্যে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের মধুরলীলা গানে, সুরে ও কথায় প্রকাশ করা হয়। উৎসব ঘিরে বসবে মেলা। অপর দিকে আদমপুর ইউনিয়নের তেতইগাঁও সানাঠাকুর মন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মৈ-তৈ সম্প্রদায়ের আয়োজনে এবার ৩২ তম রাসোৎসবের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য মো: আব্দুল মতিন।
মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে উঠে একদিনের সাথে আরো দুইদিনের এই আনন্দে। শেষ দিন শনিবার ৪ নভেম্বর মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশী-বিদেশী  পর্যটক, বরেণ্য জ্ঞাণী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনিক উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠে মণিপুরী পল্লী। রাসোৎসবের জন্য তৈরী সাদা কাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলো একটি রাত্রির জন্য হয়ে উঠে মানুষের মিলনতীর্থ। মনিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুন নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের। রাত ভর চাঁদের আলোয় মায়াবী জোৎনায় নূপুরের সিঞ্চনে মুদ্রা তুলবে সুবর্ণ কঙ্কন পরিহীতা রাধা ও গোপিনী রূপের মণিপুরী তরুনীরা। সুরের আবেশে মাতাল হয়ে উঠবে কমলগঞ্জের প্রকৃতি ও মানুষ। দিন দিন রাসোৎসবের আকর্ষণ বাড়ছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উৎসবে দর্শনার্থীর সমাগম। তুমুল হৈচৈ, আনন্দ উৎসাহ ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খ ধ্বনীর মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের অবতার পুরুষ শ্রী কৃষ্ণ ও তার সখি রাধার লীলাকে ঘিরে  এই এক দিন বছরের আর সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জবাসীর জন জীবনে।

 
মণিপুরী মহারাসলীলা সেবাসংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, বাংলাদেশে মণিপুরীদের এক গৌরবময় দিন মহারাসলীলা। মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘ। ১৭৫ তম রাসপূর্ণিমা কে স্বরনিয় করে রাখতে তিন দিন ব্যাপি রাস উৎসব উদযাপনের আয়োজন করেছে। ‘হেমন্তকাল মানেই রাসপূর্ণিমা, রাস উৎসব। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আমরা তেমন ভাবছি না। আমাদের এখানে উৎসব চলাকালে কোনো গন্ডগোল বা অঘটন ঘটেনি।’ অপরদিকে আদমপুরেও একইভাবে মাস খানেক ধরে অনুষ্ঠানের প্রস্ততি চলে। একটি মন্ডপ ঘিরে চলে একই রকম আয়োজন। এখানে মণিপুরী রাজ্য থেকে কয়েকজন অতিথি আসবেন। থাকবে গুণীজন সংবর্ধনা, মার্শাল আর্ট প্রদর্শন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
আয়োজক কমিটির সদস্যসচিব হেমন্ত কুমার সিংহ জানান, মণিপুরী সংস্কৃতি, কৃষ্টি, আভিজাত্যে মহিমান্বিত। মণিপুরী নৃত্যশৈলী আন্তর্জাতিক মানের ও বিশ্বজনীন। ‘আমাদের প্রস্তুতি ভালোই। নিরাপত্তা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই।’
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মাহমুদুল হক ও কমলগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ বদরুল হাসান বলেন, আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তার জন্য দুই জায়গাতেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনুষ্টানে নিরাপত্তায় পুলিশের তিন স্তরের ব্যবস্থা গ্রহন করেছে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com