শমশেরনগর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, নবধারা, ক্লিন এণ্ড বিউটিফুল এবং একটি হাসপাতাল
সায়েক আহমদ॥ করেনা সংক্রমণের মহামারীর সময় সারাবিশ্বের মানুষ দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদল স্বার্থপরের মত নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের জঘন্য কার্যকলাপসমূহ বিসর্জন দিতে পারেনি। অন্যদল নিজ জীবন উৎসর্গ করে মানবতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পত্র-পত্রিকা, মিডিয়ার কল্যাণে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত আমরা এসব সংবাদ চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি।
বিগত কিছুদিন ধরে শমশেরনগরে মানবতার কিছু কার্যক্রম লক্ষ করে আমার মনে হয়েছে এখনো অনেক কাজ করা সম্ভব। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ, সারাবিশ্বকে হতবাক করে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়েছিল শমশেরনগরের মুক্তিপাগল জনতা। ঐদিন শমশেরনগর চৌমুহনায় ক্যাপ্টেন মুজাফফর আহমদের নেতৃত্বে বিদ্রোহী ইপিআর সদস্যসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলের বাহিনীকে কচুকাটা করেছিল। সেটা ছিল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাক বাহিনীর উপর প্রথম সশস্ত্র এবং সফল আক্রমণ।
অতীতে শমশেরনগরের মানবতাবাদী, সমাজসেবক এবং অগ্রসর চিন্তার অধিকারী এমন কিছু লোক এমন কিছু কাজ করে গেছেন, যা শমশেরনগরকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। যুক্তরাজ্যের একজন ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট নজরুল ইসলাম এর ফেসবুক ওয়াল থেকে জানতে পারলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জে. ইরভিং গ্রোভ নামক একজন আমেরিকান ভদ্রলোক শমশেরনগর বিমানবন্দরে কাজ করেছিলেন। তিনি তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘শমশেরনগরের প্রত্যেকেই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল এবং এটি দেখে মনে হয়েছিল যে আমরা জাপানিজদের হাত থেকে এই অঞ্চলটি রক্ষা করতে এসেছি। শমশেরনগর ছিল বিভিন্ন দোকান এবং ব্যবসায়ীদের কাছে আকর্ষণীয় জায়গা। সাপ দিয়ে খেলা, সার্কাস, যাদুকর, ফকির-দরবেশ এমনকি একবার আমি একটি হিন্দু বিবাহের মিছিল দেখেছি এবং আমি সমস্ত কিছুর ছবি তুলেছিলাম।’ জে. ইরভিং গ্রোভ শমশেরনগরকে বর্ণনা করেছেন, ‘সবুজ এবং মনোরম। লোকেরা এখানে ছিল খুব দয়াবান।’ তিনি ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন শমশেরনগর আবার ঘুরে আসার জন্য। তিনি তৎকালীন সময়ে দেখেছেন প্রত্যেকে একে অপরের সাথে ভাতৃত্ববোধের বন্ধনে আবদ্ধ।
সেই ভ্রাতৃত্ববোধটা আমার চোখেও ধরা পড়েছে। কাতারে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন শমশেরনগরের প্রাণোচ্ছল তরুণ নাজিবুল বাশার (কাইয়ুম)। নাজিবুল বাশার এর মরদেহ দেশে তার পরিবারের কাছে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল শমশেরনগর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট কাতার। সংগঠনটির সভাপতি রইছউদ্দিন, সহ-সভাপতি লায়েক আলী, মুহিবুর রহমান ইজার, সাধারণ সম্পাদক জাহিদ ইস্কান্দর, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুনায়েম আহমদ লেব,ু সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফ খান, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম, কোষাধ্যক্ষ সুয়েজ মাহমুদ, তথ্য প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক এম এ শাহীন, মিজানুর রহমানসহ শমশেরনগর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট কাতার এর সদস্যগণ অতি দ্রুত মরদেহ দেশে পাঠিয়ে একটি মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশজুড়ে সাধারণ ছুটি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারসমুহে চরম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছিল। বিগত ৯ মে শমশেরনগর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ইউ.কে এর পক্ষে ৫শ’ পরিবারকে মানবিক সহায়তা হিসাবে খাদ্য সামগী বিতরণ করেন স্থানীয় প্রতিনিধিরা। ৩৫০টি পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী বিতরণকালে শমশেরনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জুয়েল আহমদ, শমশেরনগর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ওসি (তদন্ত) অরুপ কুমার চৌধুরী, ইউপি সদস্য শেখ রায়হান ফারুক, আজিজুর রহমান, রুহেল আহমদ উপস্থিত ছিলেন। ৭৫ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে খাদ্য সামগ্রী বিতরণকালে শমশেরনগর বণিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি আব্দুল হান্নান, সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান মোশাহিদ ও সহ সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম বড় ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। ৫ জন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী বিতরণকালে কমলগঞ্জ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি নূরুল মোহাইমীন, সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান উপস্থিত ছিলেন। ৭০টি হতদরিদ্র পরিবারকে ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পক্ষে খাদ্য সামগ্রী বিতরণকালে ট্রাস্টের স্থানীয় প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে ছিল ৬ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ১ কেজি পেয়াজ, ১লিটার তেল, ১ কেজি লবন, ১ কেজি ডাল ও ১টা সাবান।
শমশেরনগর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ইউ.কে এর সভাপতি মইনুল ইসলাম খান ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শরফুদ্দীন রুমেল ভবিষ্যতেও মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছিলেন। এখানে একটা বিষয় আমার চোখে পড়ল। সেটা হল সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। সবচেয়ে বড় কথা খাদ্যসামগ্রী বিতরণের সময় তারা শমশেরনগরের জনপ্রতিনিধি-ব্যবসায়ী-গণমাধ্যমকর্মীসহ সর্বস্তরের জনগণকে একসূত্রে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন।
নবধারা, শমশেরনগর নামক আরেকটি সংগঠনের কর্মতৎপরতা সবাইকে মুগ্ধ করেছে। সংগঠনটির সদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রমে শমশেরনগর বধ্যভূমি সংস্কারসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। গত ২ জুন শমশেরনগরের জমজম কমিউনিটি সেন্টারে আনুষ্ঠানিকভাবে নবধারার উদ্যোগে একশত ৬টি হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে “ঈদ আনন্দ উপহার” বিতরণ করা হয়। সংস্থাটির সদস্য শওকত জুয়েলের সভাপতিত্বে ‘ঈদ আনন্দ উপহার’ বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শামছুল হক মিন্টু, কামরুল হাসান মারুফ, সাংবাদিক জয়নাল আবেদীন, আব্দুস সামাদ সামাইল, সমরেন্দ্র সেনশর্মা, মাহমুদুর রহমান আলতা, আবু সাদাত মোঃ সায়েম. তারিকুজ্জামান সুমন, মুকরামিন চৌধুরী মুকুল, গোলাম রাব্বি, আব্দুল বারি মনন, আব্দুল কাদির সাজু, গোপাল বর্মা মনি, শফিউল আলম উজ্জল প্রমুখ। তারা ১০৬টি হতদরিদ্র পরিবারের মধ্যে পরিবারপ্রতি ১টি শাড়ী, ১টি লুঙ্গি, ১ প্যাকেট সেমাই, ১ কেজি ময়দা, ১ কেজি চিনি, ১ লিটার সয়াবিন তেল ও ১ প্যাকেট দুধ বিতরণ করেন।
শমশেরনগরের আরেকটি সংগঠন ‘ক্লিন এন্ড বিউটিফুল, শমশেরনগরকে’ও মাঝে মাঝে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায়। সংগঠনটির তৎপরতা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। ‘শমশেরনগর খেলোয়ার কল্যাণ সমিতি’ এর মত সিলেট বিভাগের একটি শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে, যে সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে থানা-পুলিশের সহায়তা ছাড়াই সুশৃঙ্খলভাবে বৃহত্তর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা পরিচালনাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রতিনিয়ত ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। এছাড়া আরো কিছু সামাজিক সংগঠন রয়েছে যারা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছেন।
শমশেরনগরে অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে শমশেরনগরের উন্নয়নে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। অনেক বরেণ্য ব্যক্তি না ফেরার দেশে চলে গেলেও তাদের কর্মতৎপরতা এখনো সর্বমহলে আলোচিত হয়। বর্তমান সময়েও শমশেরনগরের এমন কয়েকজন কৃতি সন্তান আছেন, যাদের কারণে দেশ বিদেশে শমশেরনগরের নাম উচ্চারিত হয়। কাজেই সবাইকে যদি একসূত্রে গাঁথার একটি দুঃসাহসিক কর্ম সম্পাদন করা সম্ভব হয়, তাহলেই হয়ত শমশেরনগরের অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।
শমশেরনগরবাসীর একটি আক্ষেপ দীর্ঘদিন বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সেটা হচ্ছে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করেও শমশেরনগরকে উপজেলাতে উন্নয়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। শমশেরনগরের আরেকটি আক্ষেপ ছিল শমশেরনগরে কোন কলেজ ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে সে আক্ষেপ থাকার পর ১৯৯৪ সালে তৎকালীন রোজ কেজি স্কুলে বসে আমরা তিন তরুণ ময়নুল ইসলাম খান, সাইফুর রহমান কামরান ও আমি যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলাম- তারই ধারাবাহিকতায় শমশেরনগরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘সুজা মেমোরিয়াল কলেজ’। কাজেই বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই শমশেরনগর আবার তার হারানো তারুণ্য ফিরে পাবে। তবে বর্তমান তারুণ্যকে সহযোগিতা করতে হবে অতীতের তরুণদেরকে, যারা এখন স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
শমশেরনগরের অতীত হয়ে যাওয়া তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ বর্তমানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়। সেখানে গিয়েও তারা জন্মস্থানকে ভুলে যাননি। তাইতো দেখা যায় শমশেরনগর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট নামে একটি সংগঠন জন্ম নিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কোথাও হয়ত শমশেরনগর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, ইউকে কোথাও বা শমশেরনগর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, কুয়েত কিংবা শমশেরনগর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, কাতার ইত্যাদি নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মানবতার কাজে তাদের আত্মত্যাগকে আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে শমশেরনগরে একটি হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যাচ্ছে। উপজেলায় উন্নীত হলে হয়ত একটি হাসাপাতাল সরকারিভাবে নির্মিত হত। কিন্তু সেজন্য আমাদেরকে অনন্তকাল বসে থাকলে চলবে না। উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এখনই কিন্তু তা নির্মাণ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে আমি আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ময়নুল ইসলাম খানের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। সে শমশেরনগর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, ইউকে এর সভাপতি। প্রস্তাবটি পেয়েই সে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। মনে হল চলে গেছে হারানো অতীতে। সাথে সাথেই সে এরকম একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে এক লক্ষ টাকা দান করার প্রতিশ্রুতি দিল। শুধু তাই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শমশেরনগর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সদস্যবৃন্দের নিকট থেকেও হাত পেতে চল্লিশ/পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ডোনেশন করার ব্যাপারেও আন্তরিক সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করল।
ময়নুল ইসলাম খানের প্রতিশ্রুতিতে আমি প্রচণ্ড আশান্বিত হয়েছি। আশা করি শমশেরনগরের আবাল-বৃদ্ধা-বণিতাও খুশি হবেন। তবে এখন প্রয়োজন শমশেরনগরের তরুণ সমাজের এগিয়ে আসা। তরুণদের পাশাপাশি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকেও এগিয়ে আসতে হবে। নবীন-প্রবীণের মিলনমেলায় আবারো শমশেরনগর জমজমাট হয়ে উঠবে। প্রবীণদের প্রাজ্ঞ দিক নির্দেশনায় এবং নবীনদের দুঃসাহসিক নেতৃত্বে শমশেরনগরে অচিরেই একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা সম্ভব হবে- এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। শমশেরনগরে যে সকল বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন, তাদের নাম উল্লেখ করে তাদেরকে বিব্রত করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না। তবে আশা করছি অচিরেই এ ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গৃহীত হবে।
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন