শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির দাবী কমলগঞ্জের শহীদ আব্দুল আজিজের কথা এখন আর কারো মনে নেই
কমলগঞ্জ প্রতিনিধ্॥ আজ থেকে ৪৫ বছর পূর্বে ১৯৭১ সালের ১৬্ই ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্ম প্রকাশ করে। আর এর জন্য বিসর্জন দিতে হয়েছে অগনিত তাজা প্রাণ। এদেরই একজন শহীদ আব্দুল আজিজ। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা সদরের চন্ডিপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। তৎকালীন সময়ের কট্টর আওয়ামী লীগার ফিরোজ মিয়ার বাড়ীর সন্তান হিসাবে আব্দুল আজিজ ছিলেন ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। ১৯৬১ সালে তিনি মৌলভীবাজার থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। ১৯৬৯ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় কমলগঞ্জে ছিলেন একজন অগ্রসারির ছাত্রনেতা। ১৯৭০ সালে তিনি কমলগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্সে একজন স্বাস্থ্য সহকারী হিসাবে যোগ দেন।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি কর্মরত ছিলেন তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) জগন্নাথপুর উপজেলার রাণীগঞ্জ বাজার এলাকায়। আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসাবে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীনতার ডাক দিলেন তখন তিনি আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি। দেশ মাতৃকার টানে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি তার কর্মস্থলে গোপনে যুদ্ধাহত মুক্তিযুদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে থাকেন। বিষয়টি আর বেশীদিন গোপন থাকেনি। এক সময় স্থানীয় রাজাকাররা এই খবরটি স্থানীয় পাক সেনাদের কাছে পৌঁছায়।
১ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে পাকবাহিনী হানা দেয় তার কর্মস্থল সেই সরকারী হাসপাতালে। তখন হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা দিচিছলেন একজন যুদ্ধাহতকে। হাসপাতালের অন্যান্যদের সাথে তাকেও ধরে নিয়ে আসা হয় স্থানীয় পাকসেনা ছাউনীতে। চালানো হয় নির্যাতন। পরদিন ২রা সেপ্টেম্বর সকালে আরও কয়েকজন বন্দী মুক্তিযোদ্ধাসহ আব্দুল আজিজকে হাাঁত পাাঁ বাধা অবস্থায় সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় বাজার সংলগ্ন কুশিয়ারা নদীর তীরে । সেখানে তাদের এক সারিতে দাড়িয়ে গুলিকরে হত্যা করে পাক হানাদাররা। গুলিবিদ্ধ হলেও তখন প্রাণে বেঁচে যান আব্দুল আজিজ। মৃত ভেবে পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঐদিনই কমলগঞ্জের গ্রামের বাড়ীতে পৌছে দেয়। বাড়ীতে গোপনে কিছু দিন চিকিৎসা নিয়েও শেষ রক্ষা হলোনা তার। শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটায় ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখে পরিবারের লোকজন তাকে ভর্তি করেন সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। দেশের জন্য তার এই আত্মোৎসর্গের পরবর্তী দিনগুলোতে স্ত্রী ফাতেমা খানম আড়াই বছরের শিশুপুত্র মোশাহীদ আলী ও সাড়ে চার বছরের শিশুকন্যা লাকী বেগমকে সাথে নিয়ে অনাহারে- অর্ধাহারে দিন যাপন করলেও কেউ তাদের খোজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। মিলেনি জীবন যাপনে প্রয়োজনীয় কোন সরকারী-বেসরকারী সহায়তা। তেমনি দেশের জন্য আত্মউৎসর্গকারী আব্দুল আজিজও পাননি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি শোকবার্তা ও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের মাধ্যমে ১ হাজার টাকা সহায়তা পেলেও পরবর্তী সময়ে অদ্যবধি পর্যন্ত কোন সরকারী সহায়তা পাননি। অবস্থা এমন যেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজের কথা এখন আর কারো মনে নেই। আলাপকালে শহীদ আব্দুল আজিজের পুত্র মোশাহীদ আলী বলেন, আমাদের কোন চাওয়া পাওয়া নেই, সরকারের কাছে একটাই দাবী, আমাদের পিতাকে যেন একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয়।
মন্তব্য করুন